দিন দিন আরও বেপরোয়া হয়ে উঠছে আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগ। বিতর্ক যেন কিছুতেই পিছু ছাড়ছে না। অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের পাশাপাশি ভিন্নমতের ছাত্র সংগঠন ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গেও দ্বন্দ্ব ও সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ছে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এছাড়া একশ্রেণীর নেতাকর্মীর চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, অপহরণ, ধর্ষণ, প্রশ্নফাঁসসহ নানা কার্যকলাপের কারণে নিয়মিতই আলোচনায় থাকছে ছাত্রলীগ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা না নেয়ায় এ ধরনের ঘটনার পুুনরাবৃত্তি হচ্ছে। এখনই লাগাম টেনে না ধরলে আগামী জাতীয় নির্বাচনে সংগঠনটির এমন নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের প্রভাব পড়তে পারে বলে মনে করছেন তারা।
এরই ফলশ্রুতিতে এবার মহাসড়কে সশস্ত্র মহড়া দিয়ে জনমনে ভয়-ভীতি সৃষ্টি, মহাসড়কে যানবাহন চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি ও বাড়িঘর ভাঙচুরের অভিযোগে ফরিদপুর সদর উপজেলার কানাইপুর ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকসহ পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করেছে ফরিদপুর কোতোয়ালি থানা–পুলিশ।
গতকাল শনিবার রাত থেকে আজ রোববার সকাল পর্যন্ত বিভিন্ন গ্রামে অভিযান চালিয়ে ওই পাঁচ ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়।
এ ঘটনায় ওই ছাত্রলীগ নেতাসহ ১৩ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতনামা আরও ১০ জনকে আসামি করে আজ সকালে ফরিদপুর কোতোয়ালি থানায় মামলা করেন কানাইপুর ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি এ এফ এম আসলাম (২৮)।
ওই মামলায় গ্রেপ্তার পাঁচ আসামি হলেন কানাইপুর ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাব্বির (২৪), একই ইউনিয়নের কাশিমাবাদ গ্রামের নাজমুল (২৪), পাশের কৃষ্ণনগর ইউনিয়নের ভোলাবাজ গ্রামের মো. সাগর ব্যাপারী (২৫), একই গ্রামের মো. রাকিব খান (২২) ও ভাটি কানাইপুর গ্রামের তুষার (২৩)।
আজ রোববার বেলা দুইটার দিকে জেলা পুলিশের উদ্যোগে সংবাদ সম্মেলন করে এসব তথ্য জানানো হয়। এতে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন পুলিশ সুপার মো. শাহজাহান।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে পুলিশ সুপার বলেন, এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে কানাইপুর ইউনিয়ন ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল চলছে। এতে এক পক্ষের নেতৃত্ব দিচ্ছেন কানাইপুর ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাব্বির ও থানা ছাত্রলীগের সহসভাপতি সৌরভ। অপর পক্ষের নেতৃত্বে আছেন ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি এস এম আসলাম ও ছাত্রলীগের কর্মী সোহাগ।
এই দুই পক্ষের বিরোধকে কেন্দ্র করে ২৫ আগস্ট ফরিদপুর সদরের কানাইপুর বাজার–সংলগ্ন ঢাকা-খুলনা মহাসড়কে ইউনিয়ন ছাত্রলীগের একাংশ সশস্ত্র মহড়া দিয়েছে। আসলাম ও সোহাগকে ভয় দেখানোর জন্য থানা ছাত্রলীগের সহসভাপতি সৌরভ স্থানীয় সন্ত্রাসী খায়রুজ্জামান ওরফে খাজা গ্রুপের দিদার, শহীদ, সোহেলসহ কয়েকজনকে নিয়ে মহাসড়কে দেশীয় অস্ত্র নিয়ে মহড়া দেয়।
পুলিশ সুপার মো. শাহজাহান বলেন, রাজনীতির নামে যারা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করে, তাদের প্রতিহত করা হবে। কেননা রাজনীতি ও সন্ত্রাস একসঙ্গে চলতে দেওয়া হবে না। এ কারণে দেশি অস্ত্র নিয়ে মহাসড়কে মহড়া দেওয়ার ঘটনায় দ্রুত বিচার আইনে মামলা হয়েছে এবং এ মামলার আসামিদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। এ পর্যন্ত এ ঘটনায় জড়িত পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অন্যদের দ্রুত গ্রেপ্তার করা হবে।
সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ সুপার মো. শাহজাহান আরও বলেন, ফরিদপুর শহরে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সব অভিযান চলমান থাকবে এবং আরও বেগবান করা হবে।
এ মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ফরিদপুর কোতোয়ালি থানার উপপরিদর্শক মাহাবুব করিম বলেন, গ্রেপ্তার ওই পাঁচ ব্যক্তির প্রত্যেকের জন্য পাঁচ দিন করে রিমান্ডের আবেদন জানিয়ে আজ বিকেলে তাঁদের ফরিদপুরের ১ নম্বর আমলি আদালতে হাজির করা হয়। আদালত রিমান্ডের শুনানির তারিখ পরে নির্ধারণ করার সিদ্ধান্ত দিয়ে তাদের জেলা কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।
এদিকে রাজনৈতিক বিশ্লেষক, শিক্ষাবিদ ও সাবেক ছাত্রলীগ নেতারা মনে করছেন, সম্পদ উপার্জনে অধিক মনোযোগী হওয়াই ছাত্রলীগের বেপরোয়া ও নিয়ন্ত্রণহীন হওয়ার মূল কারণ। অর্থবিত্ত অর্জনের লক্ষ্য থেকেই বিভিন্ন সময় তারা বিভিন্নভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। অন্যদিকে অপরাধীদের বিরুদ্ধে কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা না নেয়া এবং ফৌজদারি অপরাধের ক্ষেত্রে আইনানুযায়ী শাস্তি না হওয়ায় তাদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড কমছে না।
পাশাপাশি ক্যাম্পাসে বিরোধী সংগঠনের নিষ্ক্রিয়তা বা কার্যকর অবস্থান না থাকায় ছাত্রলীগের নেতিবাচক কর্মকাণ্ড বাড়ছে। এছাড়া অনুপ্রবেশকারীরাও নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের অন্যতম কারণ বলে মনে করেন তারা।
ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ডে বিরক্ত হয়েই ২০০৯ সালের ৩ এপ্রিল সংগঠনটির সাংগঠনিক নেত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ওবায়দুল কাদের ছাত্রলীগ নেতাদের সতর্কও করেছেন বহুবার।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সর্বশেষ সম্মেলনে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘ছাত্রলীগ যখন পত্রিকায় অপকর্মের শিরোনাম হয় তখন সরকারের সব অর্জন ম্লান হয়ে যায়। টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, হলের সিট ভাগাভাগি ও রুম ভাগাভাগি বন্ধ করতে হবে।’ এছাড়া সংগঠনটির বিভিন্ন কর্মসূচিতে গিয়েও ছাত্রলীগের এমন কর্মকাণ্ডের প্রকাশ্য সমালোচনা করেন তিনি।
এসডব্লিউ/এসএস/২০১০
আপনার মতামত জানানঃ