অভিযোগ রয়েছে শত শত নারী জঙ্গিসদস্য তার কাছ থেকেই অস্ত্র চালানো ও প্রশিক্ষণ নিয়েছিল। মঙ্গলবার (৭ জুন) যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়া অঙ্গরাজ্যের একটি আদালতে সাক্ষ্য দেয়ার সময় আইএসে যোগদান, গোষ্ঠীটিতে নিজের অবস্থান ও এসম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য দিয়েছেন মার্কিন ওই নারী।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে মার্কিন সেনাদের হাতে বন্দি হওয়ার আগ পর্যন্ত আইএসের অঘোষিত রাজধানী রাক্কাভিত্তিক নারী ব্যাটালিয়ন খাতিবাহ নুসায়বাহর প্রধান ছিলেন অ্যালিসন। কিভাবে তিনি সুদূর সিরিয়ায় গিয়েছিলেন এবং কেমন ছিল তার পুরো যাত্রা; চলুন জানা যাক সে সম্পর্ক।
যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিমাঞ্চলীয় অঙ্গরাজ্য ক্যানসাসে জন্মগ্রহণকারী অ্যালিসন ফ্লুকে-ইকরেন ২০০৮ সালে দেশ ত্যাগ করেন। এর আগে, চরমপন্থা অধ্যয়নকারী গবেষকরা বলছেন, শত শত পশ্চিমা মহিলা ইসলামিক স্টেটে যোগ দিয়েছেন বা সমর্থন দিয়েছেন।
কিন্তু ফ্লুক-এক্রেনই প্রথম মার্কিন মহিলা যাকে ইসলামি জঙ্গিগোষ্ঠীতে নেতৃত্বের ভূমিকার জন্য বিচারের মুখোমুখি করা হয়। ক্যানসাস বিশ্ববিদ্যালয়ে জীববিদ্যায় অধ্যয়ন করেন অ্যালিসন। এরপর ইন্ডিয়ানা কলেজে শিক্ষকতায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জনের পর ফ্লুক-এক্রেন তার সন্তান এবং দ্বিতীয় স্বামীর সঙ্গে ২০০৮ সালে মিশরে চলে যান।
সেখান থেকে তিনি ইরাক, লিবিয়া এবং সিরিয়ায় আরও ৬ বছর অবস্থান করেন। ছয় বছরেরও বেশি সময় ধরে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে সহায়তা করতে শুরু করেন তিনি।
অ্যালিসন ফ্লুকে-ইকরেনের এক প্রাক্তন বন্ধু বলেছিলেন, তিনি এবং ফ্লুক-এক্রেন একসাথে লিবিয়া থেকে কায়রোতে চলে এসেছিলেন এবং শিক্ষক হওয়ার জন্য আবেদন করেছিলেন। বছরখানেক পর যখন ফ্লুক-এক্রেন তুরস্কে গিয়েছিলেন, তখন তার লক্ষ্য এবং মানসিকতা পরিবর্তন হয়ে যায়।
তিনি বলেন, অ্যালিসন ইসলামিক খিলাফত সম্পর্কে কথা বলতে শুরু করেছিলেন এবং আমাদের কীভাবে তাদের সাহায্য করা উচিত। সে জানতে চাইতো আমার কী মতামত ছিল? আমি বিভ্রান্ত ছিলাম।’
আন্তর্জাতিক এই জঙ্গিগোষ্ঠীতে যোগ দেয়ার পর নিজের নাম পাল্টে নতুন নাম নেন মনিকের উমম মোহাম্মেদ আল-আম্রিকি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগ থেকে প্রকাশিত তথ্যানুযায়ী, আইএস-সহ একাধিক সংগঠনের প্রায় ১০০ জনের বেশি নারী ও তরুণীকে অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণ দেন তিনি। ওই নারী তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ স্বীকার করেছেন।
ওয়াশিংটন পোস্টের বরাত দিয়ে জানা যায়, আইএসে যোগ দেয়ার পর অল্প সময়ের মধ্যেই বন্দুক চালানো, গ্রেনেড ছোড়া ও বোমা হামলায় দক্ষ হয়ে ওঠেন অ্যালিসন ফ্লুক-এক্রেন। দক্ষতা ও গোষ্ঠী নেতৃত্বের প্রতি আনুগত্যের কারণে খুব দ্রুত আইএসে তার পদোন্নতিও হতে থাকে।
এফবিআই বলছে, আইএসের মিসর, ইরাক ও তুরস্ক শাখায় কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে ফ্লুক-এক্রেনের। ওই তিন দেশের শতাধিক নারী ও কিশোরী জঙ্গি সদস্যকে একে-৪৭ রাইফেল চালানো, গ্রেনেড ছোড়া ও সুইসাইড ভেস্ট প্রস্তুত ও তা ব্যবহারের বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন।
১০-১১ বছর বয়সী কিশোরীরাও ছিল তার প্রশিক্ষণ দলের মধ্যে। ২০১৬ সালে রাক্কাভিত্তিক আইএস নারী ব্যাটালিয়ন খাতিবাহ নুসায়বাহর প্রধান হন এই অ্যালিসন ফ্লুকে-ইকরেন।
আইএসের সঙ্গে যুক্ত থাকা অবস্থায় তিনি তার পরিবারের কাছে নিজের ভূয়া মৃত্যু সংবাদ পাঠান। মার্কিন সরকার যাতে তাকে শনাক্ত করার চেষ্টা না করে সেজন্যই তিনি এমন গুঞ্জন রটান। এর মাঝে অ্যালিসনের পরিবার মার্কিন আদালতে মেয়ের নিখোঁজ হওয়ার কথা জানায়।
অ্যালিসন তার যে স্বামীর সঙ্গে সিরিয়ায় গিয়েছিলেন তিনি এক বিমান হামলায় নিহত হন। তবে তার স্বামীও ওই জঙ্গিগোষ্ঠীতে বেশ সুনাম অর্জন করেছিলেন। দ্বিতীয় স্বামীর মৃত্যুর পর, ফ্লুক-এক্রেন একজন বাংলাদেশি আইএসআইএস সদস্যকে বিয়ে করেছিলেন বলে মনে করা হয়।
ধারণা করা হয় ওই ব্যক্তি ড্রোন তৈরিতে পারদর্শী ছিলেন। যদিও ওই জঙ্গি সদস্য ২০১৬ এর শেষে কিংবা ২০১৭ সালের শুরুতে মারা যান। মার্কিন গোয়েন্দাদের দাবি, তিনি সিরিয়ায় দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন আইএসের একজন বড় নেতাকে। কারণ ততদিনে তিনি ওই সন্ত্রাসী সংগঠনে বেশ বড় পর্যায়ে পৌঁছে যান।
এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তিনি মোট পাঁচবার বিয়ে করেছেন এবং তার পাঁচটি সন্তান রয়েছে।
এফবিআইয়ের প্রথম অভিযোগ ছিল, ২০১২ সালে লিবিয়ায় ৪ জন মার্কিন নাগরিককে হত্যায় সাহায্য করেছিলেন ওই মার্কিন নারী। আদালতে সারসংক্ষেপ প্রদান করে অ্যালিসন বলেছিলেন, তার স্বামী বেনগাজিতে একটি মার্কিন কম্পাউন্ড থেকে চুরি করেছিলেন। তবে ফ্লুক-একরেনের বিরুদ্ধে হামলায় জড়িত থাকার অভিযোগ ছিল না।
২০১৯ সালে আইএসের অঘোষিত রাজধানী রাক্কায় মার্কিন সেনাদের হাতে গ্রেফতার হন অ্যালিসন। সেখানে প্রায় ৭ মাস একটি কারাগারে বন্দি রাখা হয় তাকে। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে তাকে হস্তান্তর করা হয়। বিচার কার্য শুরু হলে তিনি নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের জন্য কিছু যুক্তি দাঁড় করান।
তিনি প্রথমে সরাসরি শিশুদের অস্ত্রের প্রশিক্ষণ দেয়ার বিষয়টি অস্বীকার করলেও নারীদের প্রশিক্ষণ দেয়ার বিষয়টি স্বীকার করেন। তিনি নিজেকে নির্দোষ দাবি করে তার প্রয়াত স্বামীদের জঙ্গিগোষ্ঠীতে সম্পৃক্ততার দায় নিতে অস্বীকৃতি জানান।
তবে আদালত ঘোষণা করেন, সরকারের নিকট তার দোষ প্রমাণ করার জন্য ‘যথেষ্ট প্রমাণের চেয়ে বেশি’ সংগ্রহ রয়েছে। শেষবার শুনানিতে একটি কালো হিজাব এবং সাদা মুখোশ পরে আদালতে হাজির হন অ্যালিসন। তবে তার সন্তানদের কথা উল্লেখ করার সময় কাঁদতে শুরু করেন।
যাইহোক, তার বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একাধিক হামলার পরিকল্পনার অভিযোগের প্রমাণ পেয়েছে মার্কিন আদালত। জঙ্গিগোষ্ঠীতে সম্পৃক্ততার অভিযোগে অ্যালিসন ফ্লুকে-ইকরেনের ২০ বছরের কারাদণ্ড হতে পারে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৮৪৫
আপনার মতামত জানানঃ