অস্ট্রেলিয়ার প্রতিরক্ষা বাহিনীতে আত্মহত্যার হিড়িক পড়েছে। প্রশান্ত মহাসাগরীয় এই দেশটির বাহিনীর সাবেক ও বর্তমান সদস্যদের মধ্যে বেড়েছে আত্মহত্যার হার।
মূলত একটি যুগান্তকারী প্রতিবেদনে অস্ট্রেলিয়ার প্রতিরক্ষা বাহিনীর সাবেক ও বর্তমান সদস্যদের মধ্যে আত্মহত্যার উচ্চ হারের বিষয়টি উঠে আসার পর এটিকে ‘একটি জাতীয় ট্র্যাজেডি’ হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার (১১ আগস্ট) এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি।
সমীক্ষায় দেখা গেছে, ২০০১ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত সময়ে অস্ট্রেলিয়ায় চাকরিরত অথবা সাবেক এমন ১২০০ সেনাকর্মী আত্মহত্যা করেছেন। গবেষণা বলছে, সাধারণ মানুষের চেয়ে অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যে আত্মহত্যার হার অনেক বেশি।
এর কারণ খুঁজতে করা ‘দ্য রয়্যাল কমিশন ইনটু ডিফেন্স এন্ড ভেটেরান সুইসাইড ফাউন্ড’ জানিয়েছে, আমলাতন্ত্র আর অবসরের পর সহায়তার অভাবেই এই পথ বেছে নিচ্ছে বর্তমান ও সাবেক সেনা সদস্যরা।
এই তদন্তে অংশ নেওয়া সিনেটর জ্যাকি ল্যাম্বি জানিয়েছেন, সেনাবাহিনীতে থাকার সময় তিনিও তার ছেলেকে বিদায়ী চিঠি লিখেছিলেন এবং আহত অবস্থায় আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন।
জ্যাকি ল্যাম্বি বলেন, ‘বেঁচে থাকার কোনো কারণ খুঁজে পাওয়াটা আমার জন্য বেশ কঠিন ছিল। এমনকি আমার ছেলেদের জন্যও। (বেঁচে থাকতে) আমার মধ্যে কোনো লড়াই আর বাকি ছিল না।’
অস্ট্রেলিয়ার আরেক সাবেক সৈনিক রয়্যাল কমিশনের শুনানিতে বলেন, আফগানিস্তান থেকে ফিরে আসার পরে তিনি যা দেখেছিলেন তা সামলাতে না পেরে তার জীবন কীভাবে বিষিয়ে উঠেছিল।
বিবিসি বলছে, অস্ট্রেলিয়ার প্রতিরক্ষা বাহিনীতে আত্মহত্যার হার নিয়ে দ্য রয়্যাল কমিশন ইন ডিফেন্স অ্যান্ড ভেটেরান সুইসাইড’র অন্তর্বর্তী রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে বৃহস্পতিবার। সদ্য প্রকাশিত এই প্রতিবেদনে, কমিশনাররা প্রতিরক্ষা বাহিনীর মধ্যে ‘সাংস্কৃতিক সমস্যা’ এবং আত্মহত্যার উচ্চ হার মোকাবিলায় সরকারের নিষ্ক্রিয়তার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত আট মাস ধরে কয়েকশ লোকের সাক্ষাৎকার নিয়েছে অস্ট্রেলিয়ার শীর্ষ সরকারি একটি তদন্ত সংস্থা। রাজকীয় কমিশনের নেওয়া ওই সাক্ষাৎকারে দেখা গেছে, অত্যাধিক জটিল প্রশাসনিক পদ্ধতির কারণে অস্ট্রেলিয়ার চাকরিজীবী নারী ও পুরুষরা কার্যত সংগ্রাম করছেন এবং চাকরি থেকে অব্যাহতির পর নানামুখী সহায়তা-সমর্থনের অভাবে জীবনযাপন করছেন।
এদিকে এই রিপোর্ট প্রকাশের পরপরই ক্ষমা চেয়েছে অস্ট্রেলিয়ার সরকার। একইসঙ্গে রিপোর্টে উল্লেখ করা সুপারিশগুলোর বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ারও প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তারা।
এটি খুবই বিপর্যয়কর যে গত ২০ বছরে আফগানিস্তান ও ইরাকে যুদ্ধের সময় অস্ট্রেলিয়া যত সেনা হারিয়েছে, তার চেয়ে বেশি সাবেক ও বর্তমান সেনা আমরা হারিয়েছি আত্মহত্যার কারণে।’
অস্ট্রেলিয়ার ভেটেরান্স বিষয়ক মন্ত্রী ম্যাট কিয়োগ বলেছেন, ‘এটি খুবই বিপর্যয়কর যে গত ২০ বছরে আফগানিস্তান ও ইরাকে যুদ্ধের সময় অস্ট্রেলিয়া যত সেনা হারিয়েছে, তার চেয়ে বেশি সাবেক ও বর্তমান সেনা আমরা হারিয়েছি আত্মহত্যার কারণে।’
অবশ্য সাড়া ফেলে দেওয়া এই রিপোর্ট সামনে আসার পরপরই ক্ষমা চেয়েছেন অস্ট্রেলিয়ার মন্ত্রী ম্যাট কিয়োগ। তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, রিপোর্টে কমিশনের উল্লেখিত সুপারিশগুলো তার সরকার ‘অগ্রাধিকার ভিত্তিতে’ সমাধান করবে। আর এ লক্ষ্যে গত মে মাসে ক্ষমতায় আসার এই সরকার ইতোমধ্যে অতিরিক্ত ৫০০ জন কর্মীও নিয়োগ করেছে।
দ্য রয়্যাল কমিশন ইন ডিফেন্স অ্যান্ড ভেটেরান সুইসাইড’র পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন প্রকাশ হবে ২০২৪ সালের জুন মাসে। তবে এর আগে আরও শুনানি করবে রাজকীয় এই কমিশন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, যারা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে, তারা নিজ চোখের সামনে এত বেশি মৃত্যু দেখেছে যে, মৃত্যুকে তাদের কাছে আর অস্বাভাবিক কিছু বলে মনে হয় না। বরং তাদের মনে এমন ধারণা জন্মে গিয়েছে যে, মৃত্যুই পারে যেকোনো সমস্যার চিরস্থায়ী সমাধান বয়ে আনতে। আর যেহেতু সামরিক বাহিনীতে কাজ করার সুবাদে তাদের মনোবল গড়পড়তা নাগরিকদের তুলনায় অনেক বেশি দৃঢ়, তাই আত্মহত্যার সিদ্ধান্তের বাস্তব প্রয়োগ ঘটাতে তাদের খুব বেশি বেগ পেতে হয় না।
চিকিৎসাবিজ্ঞান বলছে, একজন মানুষের মস্তিষ্কের পক্ষে সর্বোচ্চ একটি বা দুটি নিকটবর্তী বিস্ফোরণের চাপ সহ্য করা সম্ভব। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যে যারা যুদ্ধ করতে গিয়েছিল, তারা প্রায় সকলেই এর অনেক বেশি নিকটবর্তী বিস্ফোরণের সাক্ষী হয়েছে, যা তাদের মস্তিষ্ককে অনেক ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। বারবার বিস্ফোরণের চাপ সহ্য করায় তাদের মস্তিষ্ক হয়তো স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে, যে কারণে তারা ভালো-মন্দ চিন্তা না করে আত্মহত্যা করে ফেলছে।
কেবল যে যুদ্ধ ফেরত সেনারাই এই পথ বেছে নিচ্ছে তা নয়। সেনাবাহিনীর মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা দেখেছেন যে আত্মহত্যাকারীদের এক-তৃতীয়াংশকে কখনো কোনো যুদ্ধেই পাঠানো হয়নি। এরপরেও কেন আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছে সেটি একটি বিরাট প্রশ্ন।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪১৮
আপনার মতামত জানানঃ