সাইফুল বাতেন টিটো
নিজের দেখা একটা ঘটনা দিয়েই লেখাটা শুরু করছি। ২০১২ সালে আমি প্যাসিফিক মটরর্সের ওয়ার্কশপে ঢুকলাম ট্রেইনি সার্ভিস ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে। নিশান গাড়িই আমরা বেশি সার্ভিসিং করতাম। এছাড়া আমাদের নিজেদের ছিলো ল্যাণ্ড রোভার, রেঞ্জ রোভার, হুন্দাই। আর নিশান তো ছিলোই। ২৪ ঘণ্টা ওপেন ওয়ার্কশপ। গভীর রাতে কিছু গাড়ী আসতো। যেসকল গাড়ীর এই দেশে অনুমোদন ছিলো না সেইসব গাড়ী। যেমন পোরসে, রোলস রয়েস, ফেরারি এমন আরো অনেক গাড়ী। এইসব গাড়ী সার্ভিসিং করতো আমাদের খুবই সিনিয়র মেকানিকরা যাদের কোনো ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াশুনা নাই, নামটাও ভালোভাবে লিখতে পারেন না। কিন্তু কথা সেটা না। এইসব গাড়ীর ছোটখাটো পার্টস এইদেশের কোনো পার্টসের দোকানে পাওয়া যেতো না। তখন আমরা কী করতাম জানেন? একজনকে সোজা পাঠিয়ে দিতাম ধোলাইখালে। সাথে নিয়ে যেতো নষ্ট পার্টসটা। গিয়ে সেটার হুবহু একটা ফ্রেশ কপি বানিয়ে নিয়ে আসতো। যাদের অল্পবিস্তর মেকানিলক্যাল সেন্স আছে তারা বুঝতে পারবেন একটা গাড়ির পার্টস যদি কেউ নতুন করে বানিয়ে গাড়িতে লাগাতে চায় তাহলে সেই পার্টসে এক ন্যনোমিটার এদিক সেদিক হলে আর কোনো ভাবেই ঐ পার্টসটা কাজে লাগানো যাবে না। একদিন আমার ওস্তাদ কোরবান আলী আমাকে বলল ‘‘স্যার চলেন ধোলাই খালে যাই। আপনাকে একটা ম্যাজিক দেখাইয়া নিয়া আসি।’’ আমি গেলাম। আসলে যা দেখলাম তা দেখার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না। আমার জন্য ম্যাজিকই ছিলো।
পার্টসটা তেমন জটিল কিছুই না, ইনলেট ভালভ আর একটা এক্সজস্ট ভালভ। এগুলো সাধারণত নতুন কিনে লাগানো হয়। বিশেষ করে ইঞ্জিন ওভার হোলিংএর সময়। কিন্তু এই গাড়ীর পার্টস এখানে পাওয়া যাবে না। বানিয়ে ব্যবহার করতে হবে। যাই হোক আমরা দোকানে এনামুল নামে একজন মেকানিকের জন্য ওয়েট করছি যে কিনা ভালভ বানাবে। ছোট্ট একটা ওয়ার্কশপে। আটদশ মিনিট পর একজন ত্রিশপয়ত্রিশ বছরের নারী ঢুকলেন একটা মোটাসোটা ৮/১০ বছরের শিশুকে কোলে নিয়ে। শিশুটিকে চেয়ারে বসানোর সময় দেখলাম তার বাম পায়ের পাতায় ব্যান্ডেজ। এরমধ্যে ওয়ার্ক শপের মালিক চেঁচিয়ে বলল ‘‘ এ এনামুল আইছে ওর জন্য চা আর রুডি আন’’। আমি এদিক সেদিক তাকিয়ে এনামুলকে খুঁজতে লাগলাম। যে আমাদের পার্টস বানাবে সে এনামুল। আমার মাথায় একজন যুবক বা কিশোরের চিত্র। কিন্তু না! এই পিচ্চিই এনামুল! আমি অবাক হয়ে কোরবান ওস্তাদকে বললাম ওস্তাদ ও বানাবে? এই কথা শুনে ফেলল ওয়ার্কশপের মালিক। বলল ও বানাবে মানে? ওরে আপনি সব ঠিকঠাক দিলে ও ফুল ইঞ্জিল হুদ্দা বানাইয়া স্টার দিয়া দেবে।’’ আমি মাথায় হাত দিলাম। বলে কি? তখন মালিক আবার বলল পায়ে হেদিন ক্যানশ্যাপ পড়ছে (ক্রাঙ্ক শ্যাফ্ট)। সে এইখানের সাবাইর ওস্তাদের ওস্তাদ। ওর মায় এইখানের সবাই দোকানে পানি দেয়, ঝাড়ুটারু দেয়। ও ওর মায়র লগে আইতো। দোকানে সাবাইর কাম দেইখা শিক্ষা ফালাইসে। অয় আমার চাইতে বড় ওস্তাদ হইবো।’’
আমি পুরো সময় অবাক হয়ে ওর কাজ দেখলাম!
আজ পত্রিকায় একটা নিউজ এসেছে। গুলিস্তানে স্বপন নামে একজন ধরা পরেছে। তার অপরাধ সে বিভিন্ন ব্রান্ডের মোবাইল নকল করে চায়না ও ফিনল্যান্ডের স্টিকার লাগিয়ে বিক্রি করতো। এই কাজটি নিঃসন্দেহে একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। পুঁজিবাদি সমাজে এই অপরাধে তার সাজা হবে। কারণ রাষ্ট্রের অনেক বড় একটা দায়িত্ব পুঁজিপতিদের পুঁজির পাহারা দেয়। তাতে যদি কারো মেধাকে দমন করতে হয় তো করা হবে। কিন্তু আমরা একথাটি অস্বীকার করতে পারবো না যে এই স্বপন প্রচন্ড মেধাবী একটি ছেলে। একটি বেসরকারি অফিসের পিয়নের কাজ করা স্বপনের ছোট বেলা থেকেই প্রযুক্তিগত দিকে আগ্রহ ছিল। একজনের মোবাইলফোন মেরামতের সূত্রে গুলিস্তান এলাকার এক মেকানিকের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। এরপর সেই মেকানিকের মাধ্যমে স্বপন জানতে পারেন মোবাইলফোন মেরামতের ব্যবসাটি লাভজনক। তখন তিনি বিনা বেতনে একটি সার্ভিসিং দোকানের মেকানিকের সঙ্গে কাজ শিখতে শুরু করেন। পরবর্তীসময়ে স্বপন মোবাইল সার্ভিসিংয়ের ওপর বেশ দক্ষতা অর্জন করেন। পাশাপাশি এ বিষয়ে জানার জন্য অনলাইনে বিভিন্ন ভিডিও দেখেন। একপর্যায়ে স্বপন নিজেই ভিন্ন দেশ থেকে যন্ত্রাংশ এনে মোবাইল ফোন তৈরি ও আইএমআইহ নম্বর পরিবর্তনের কাজ শুরু করে। (তথ্যসূত্রঃ র্যার ও বিভিন্ন পত্রিকা)
দেখেন এই স্বপন হয়তো সুযোগ পেলে আজ বুয়েটে ট্রিপল ই’তে পড়তে পারতো। কিন্তু সে সুযোগ পায়নি। কিন্তু যখনই শেখার সুযোগ পেয়েছে, কাজে লাগিয়েছে এবং সে বেশ ভালোভাবেই শিখতে পেরেছে।
এটা আপনি পারবেন? আমি পারবো? ক’জন পেরেছে? আমার কথা হচ্ছে সে কেন এই অন্যায় কাজটি করেছে? সেকি চাইলেই এদেশে একটি মোবাইল কারখানা করে তারপর বিজনেস করতে পারতো? পারতো না। কারণ তার অনেক কিছুই নেই। স্বভাবতই সে তার প্রতিভা, জ্ঞানকে যেভাবে পেরেছে ব্যবহার করেছে। কিন্তু তা রাষ্ট্রিয় আইনে অনৈতিক, অপরাধ। এতে ওর অবশ্যই সাজা হবে।
কিন্তু তার ফলাফলটা কী হবে? আমার মনেহয় খুব খারাপ ফলাফল হবে। স্বপনের কারখানায় তৈরি ১০ হাজার মোবাইল দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিক্রি হয়েছে। এই মোবাইল বিক্রির ৩০ লাখ টাকারও বেশি দিয়ে নিজ গ্রামে জমি কিনেছেন স্বপন। সেখানে নিশ্চই তার সাজানো সংসার আছে। সেখান থেকে তুলে নিয়ে তাকে সাজা দিলে তার জেদ চেপে যাবে। যে অপরাধ সে করেছে তাতে তার ফাঁসি কিংবা দীর্ঘদিন সাজা হবে না। সে যেটা করেছে সেটা জামিন যোগ্য অপরাধ। তাকে সাজা দিলে তার জেদ চেপে যাবে। সে মুক্তির পর তার জ্ঞান খাটিয়ে আরো বড় অপরাধ করবে। এখন দেশের সকল জেলখানা ফুলজঙ্গি, হাফ জঙ্গি, মৌলবাদি দিয়ে ভরা। কে জানে জেলে ও কার সাথে থাকবে? তখন যদি ও বড়কোনো জঙ্গি গোষ্ঠিতে ভীড়ে যায়? ও তখন ওর জ্ঞানকে জেহাদের কাজে লাগাবে! তখন কী হবে?
দেশে প্রতিদিন অনেক বড় বড় অপরাধ হয়, অপরাধী পার পেয়ে যায়, আরামে খায়দায় ঘুরে বেড়ায় আর অপরাধ করেই যায়। আজ দেখলাম আওয়ামীলীগ ও তাদের বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের লীডার ও সেই সরকারের বিভিন্ন কর্মকর্তা কর্মচারী বিগত দশ বছরে মোট সাড় ছয় লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছে। যা এই দেশেই টাকা, আপনার আমার ঘামের টাকা।
স্বপনকে সাজা দিলে এখন ক্ষতি, ওকে সাজা না দিয়ে প্রথমে ওকে মটিভেশনের মাধ্যেমে বোঝান যে ও যে কাজটি করেছে সেটি কেন অপরাধ। তারপর তার যোগ্যতা ও ক্যাপসিটি সম্পর্কে জানুন। জিজ্ঞেস করুন ও কতো টাকা হলে একটা মান সম্পন্ন কারখানা তৈরি করতে পারবে। ও যে পুঁজি নিয়ে ওর কাজ শুরু করে আজ দৈনিক ৫০টি মোবাইল তৈরির করতে পারে। আমার ধারণা ওকে দেড় দুইশ কোটি টাকা স্বল্প সুদে সহজ শর্তে ঋণ দিলে ও এদেশে মোবাইল শিল্পে বিপ্লব ঘটাতে পারবে। দরকার হলে ও উচ্চতর প্রশিক্ষনের জন্য বিদেশে যাবে। এমনটা কি হতে পারে না? আইসিটি খাতে তো কোটি কোটি টাকা পরে আছে। যারা সরকারের উচ্চাপর্যায়ে আছেন বা আইসিটি মিনিস্ট্রি সবাই মিলে বিষয়টি ভেবে দেখলে পারেন কিন্তু। সেটাই মনে হয় সবচাইতে ভালো হবে। না হলে একটি মেধা নষ্ট হবে তো হবেই উল্টো তার শিক্ষা ব্যবহার করে সে ভবিষ্যতে দেশ ও মানুষের ক্ষতিই করবে। উপকার আর করবে না। তাই আমি অনুরোধ করবো স্বপনের স্বপ্নকে এগিয়ে নিতে ওর হাতে হাতকড়া নয় ক্ষুদ্র ঋণ দেয়া হোক।
আপনার মতামত জানানঃ