ফিলিস্তিনে ভয়াবহ বোমা হামলা অব্যাহত রেখেছে ইসরায়েল।ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় গতকাল শনিবার দ্বিতীয় দিনের মতো ইসরায়েলের সেনাবাহিনীর বিমান হামলায় ছয় ফিলিস্তিনি শিশুসহ অন্তত ২৪ জন নিহত হয়েছেন। এছাড়া আহত হয়েছেন আরও দুই শতাধিক ফিলিস্তিনি।
ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ এই ভূখণ্ডটিতে গত দুই দিন ধরে চলা বিমান হামলায় হতাহতের এই ঘটনা ঘটে। রোববার (৭ আগস্ট) এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে বার্তাসংস্থা এএফপি ও আল-জাজিরা।
গাজা উপত্যকার উত্তরাঞ্চলের জাবালিয়া শহরে একটি শরণার্থীশিবিরে এ হামলা চালানো হয়েছে বলে দাবি করেছে হামাস। এই হামলার জন্য ইসরায়েলি সেনাদের দায়ী করছে তারা। তবে জাবালিয়ায় হামলা চালিয়ে শিশুসহ বেসামরিক মানুষজনকে হত্যার ঘটনা অস্বীকার করেছে ইসলায়েল। দেশটির দাবি, ওই এলাকায় হামলা চালানো হয়নি। বরং ফিলিস্তিনি জিহাদিরা রকেট হামলা চালাতে গিয়ে ব্যর্থ হওয়ায় বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। আর এতে প্রাণহানি হয়েছে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে দুই দিনের সংঘর্ষে ২০৩ জন আহত হয়েছেন।
গাজার আশপাশের এলাকায় গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে খানিকটা শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতি বিরাজ করছিল। গত শুক্রবার ইসরায়েলি সেনাদের হামলায় ইসলামিক জিহাদের জ্যেষ্ঠ কমান্ডার নিহত হওয়ার পর সেখানে আবারও সংঘর্ষ শুরু হয়েছে।
ইসরায়েলি অভিযানে নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ছিলেন উম ওয়ালিদ নামের ৭৩ বছর বয়সী এক নারী। তিনি তার ছেলের বিয়ের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। বেইত হানুন শরণার্থীশিবিরে একটি গাড়িতে হামলায় তিনি মারা যান।
ইসরায়েলি হামলার জবাবে ফিলিস্তিনি যোদ্ধারা ৪০০টিরও বেশি রকেট ছুড়েছে। যদিও এগুলোর বেশির ভাগই ঠেকিয়ে দেয় ইসরায়েল। এসব রকেট হামলায় গুরুতর কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি বলে দাবি করেছে ইসরায়েল।
প্রায় ২৩ লাখ ফিলিস্তিনি সংকীর্ণ উপকূলীয় গাজা উপত্যকায় বসবাস করেন। ইসরায়েল এবং মিসর ওই এলাকার ভেতরে এবং বাইরে মানুষ ও পণ্যের চলাচল কঠোরভাবে নজরদারি করে এবং নিরাপত্তার অজুহাত দেখিয়ে নৌযান চলাচলের ওপর অবরোধ আরোপ করেছে।
ইসরায়েল গত শুক্রবার হামলা শুরুর আগমুহূর্তে গাজায় পরিকল্পিতভাবে জ্বালানি সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। এর ফলে ওই অঞ্চলের একমাত্র বিদ্যুৎকেন্দ্রের কার্যক্রমে বিঘ্ন ঘটে। প্রতিদিন প্রায় চার ঘণ্টা বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ থাকছে।
স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীরা জানিয়েছে, এমন পরিস্থিতি চললে কয়েক দিনের মধ্যে হাসপাতালগুলো মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পরিচালক মেদহাত আব্বাস বলেন, ‘(ইসরায়েলিরা) বেসামরিক লোকদের ওপর আক্রমণ করছে, তারা বিভিন্ন স্থাপনার চত্বর, আবাসিক এলাকায় হামলা চালাচ্ছে।’
ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী সতর্ক করেছে যে, ইসলামিক জিহাদের বিরুদ্ধে তাদের এই হামলা এক সপ্তাহ স্থায়ী হতে পারে। তবে মিশরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি বলেছেন, গাজায় চলমান এই সহিংসতা কমাতে উভয় পক্ষের সঙ্গে ‘চব্বিশ ঘণ্টা’ কথা বলছে কায়রো।
সর্বশেষ এসব ঘটনা গত এক বছরের মধ্যে ইসরায়েল এবং গাজার মধ্যে সবচেয়ে গুরুতর সহিংসতা। গত বছরের মে মাসে ১১-দিনের লড়াইয়ে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার আগে সহিংসতায় ২০০ জনেরও বেশি ফিলিস্তিনি এবং এক ডজন ইসরায়েলি নিহত হয়েছিলেন।
সর্বশেষ সংঘাতে শনিবার ইসরায়েলের শহরগুলোতে রকেট হামলার সতর্কতার সাইরেন বাজতে থাকে। ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর দাবি জানাচ্ছে, গাজা থেকে ইসরায়েলকে লক্ষ্য করে রাতভর প্রায় ২০০টি রকেট ছোঁড়া হয়েছে।
তবে সেগুলোর বেশিরভাগই ইসরায়েলের ‘আয়রন ডোম’ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দিয়ে ধ্বংস করা হয়। এসব হামলায় কোনো ইসরায়েলি হতাহতের ঘটনা ঘটেনি বলে জানা যাচ্ছে।
জাতিসংঘের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, গাজায় দুই দিন ধরে চলমান ইসরায়েলি হামলায় উদ্বাস্তু হয়েছে অন্তত ৪০টি ফিলিস্তিনি পরিবার। এ ছাড়া স্থানীয় ৬৫০টির বেশি আবাসন হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং ১১টি বাড়ি ধ্বংস হয়ে গেছে বলে জানিয়েছে ফিলিস্তিনের আবাসন মন্ত্রণালয়।
গাজায় দুই দিন ধরে চলমান ইসরায়েলি হামলায় উদ্বাস্তু হয়েছে অন্তত ৪০টি ফিলিস্তিনি পরিবার। এ ছাড়া স্থানীয় ৬৫০টির বেশি আবাসন হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং ১১টি বাড়ি ধ্বংস হয়ে গেছে
এদিকে বিমান হামলায় প্রাণহানির ঘটনায় সৃষ্ট উত্তেজনা প্রশমনে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনির মধ্যে মধ্যস্থতার চেষ্টা করছে মিসর। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়, গাজায় মানুষের জীবন ও সম্পদ রক্ষার চেষ্টা চালানো হচ্ছে। এ জন্য দুই পক্ষের সঙ্গেই নিবিড় যোগাযোগ রাখছে কায়রো। বিবৃতিতে বিস্তারিত আর কিছু বলা হয়নি।
ইসরায়েল ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডের ওপর ‘পূর্ণাঙ্গ নিয়ন্ত্রণ’ কায়েমের চেষ্টা করছে। ফিলিস্তিনে দখলদারত্ব অবসানের কোনো ইচ্ছাই নেই ইসরায়েলের। এনিয়ে চলতি বছরের রমজান মাস থেকে ইসরায়েল–অধিকৃত ফিলিস্তিনের মাটিতে বড় ধরনের উত্তেজনা দেখা দিয়েছে।
পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেমে ইসরায়েলি সেনাদের হাতে গত বছরের (২০২১) চেয়ে চলতি বছরের (২০২২) প্রথম ছয় মাসে বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৪৬ শতাংশ বেশি।
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক স্থানীয় কার্যালয়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ৬০ ফিলিস্তিনিকে হত্যা করা হয়েছে। গত বছরের একই সময়ে নিহত হয়েছিলেন ৪১ জন।
জাতিসংঘ বলছে, ২০২১ সালে ইসরায়েলের সেনাদের হাতে নিহত ফিলিস্তিনির সংখ্যা ছিল ৭৮। আর ২০২০ সালে ২৪ জন।
আন্তর্জাতিক আইন পরিপন্থি এ কাজ করার জন্য প্রতিবেদনে আইডিএফ, বর্ডার পুলিশ এবং পুলিশের মতো ইসরায়েলের নিরাপত্তা সংস্থাগুলোকে অভিযুক্ত করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘বহু ঘটনায় দেখা গেছে, ইসরায়েলের সেনারা শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা না করে শুরু থেকেই প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করেছে।’
আন্তর্জাতিক আইনের তোয়াক্কা না করে অধিকৃত পশ্চিম তীরের ৭৯ শতাংশ স্থাপনা নিজেদের দখলে নিয়েছে ইসরায়েল। পূর্ব জেরুজালেমের ২০ শতাংশ স্থাপনা তাদের কবজায়। জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা সমন্বয়বিষয়ক কার্যালয়ের (ওসিএইচএ) তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯ সাল থেকে চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় ফিলিস্তিনি মালিকানাধীন অন্তত ৮ হাজার ৪১৩টি স্থাপনা ধ্বংস হয়েছে। এতে সর্বস্ব খুইয়ে পথে বসেছেন প্রায় সাড়ে ১২ হাজার ফিলিস্তিনি। বিপরীতে অধিকৃত পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেমে এ পর্যন্ত সাড়ে সাত লাখ ইহুদিকে বসতি গড়ে দিয়েছে ইসরায়েল সরকার।
বিশ্লেষকরা বলছেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন হলোকাস্টের নির্মমতাও যেন ছাপিয়ে গেছে ইসরায়েলের বর্বর কর্মকাণ্ডে; নাৎসিদের থেকেও অধিক জিঘাংসু হয়ে উঠেছে জায়নবাদীরা। তাদের একপেশে নির্বিচার হামলা, সর্বাত্মক অবরোধ–আগ্রাসনে অকাল আর অপঘাত মৃত্যু যেন ফিলিস্তিনিদের নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ১৯৪৮ সালের ১৪ মে যে ‘নাকবা’ নেমে এসেছে ফিলিস্তিনি ভূমিতে, তার তাণ্ডবশক্তির নিচে মানবিকতার পদদলন আর কত দিন? আর কত দিনই বা তা ‘চুপচাপ’ চেয়ে চেয়ে দেখবে বাকি বিশ্ব? আর কত রক্তমূল্য পরিশোধে মানবমুক্তির পয়গাম পৌঁছাবে ফিলিস্তিনি ভূমিতে?
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৩৫
আপনার মতামত জানানঃ