সৌরজগতের একমাত্র সদস্য হিসাবে শুধু পৃথিবীতেই রয়েছে প্রাণের অস্তিত্ব। প্রযুক্তির দৌলতে আজ মহাবিশ্বের বিভিন্ন অংশে বসবাসযোগ্য গ্রহের সন্ধান পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। অবশ্য সেখানে আদৌ প্রাণের অস্তিত্ব রয়েছে কিনা তা জানা যায়নি আজও। তবে এখানেই কি পৃথিবীর অভিনবত্ব?
আজ থেকে ৫০ বছর আগে, এর থেকেও এক ধাপ এগিয়ে সম্পূর্ণ নতুন কথা শুনিয়েছিলেন এক ব্রিটিশ পরিবেশবিদ। দাবি করেছিলেন, শুধু প্রাণী বা উদ্ভিদ নয়, প্রাণ রয়েছে পৃথিবীরও। আমাদের নীলগ্রহ নিজেই একটি আস্ত জীবের মতো আচরণ করে।
হ্যাঁ, কথা হচ্ছে গায়া তত্ত্ব (Gaia Theory) নিয়েই। ১৯৬৫ সালে প্যাসেডিনায় নাসার জেট প্রোপালশন ল্যাবে দাঁড়িয়ে এমনই এক তত্ত্বের বীজ রোপণ করেছিলেন ব্রিটিশ পরিবেশবিদ ও গবেষক জেমস লাভলক (James Lovelock)।
জানিয়েছিলেন, পৃথিবীর বুকে থাকা অরণ্যকূল আসলে নীল গ্রহের ফুসফুস। আর তীরতীরে বয়ে চলা নদীগুলি তার শিরা-উপশিরা। পৃথিবী জীবন্ত বলেই, তার বায়ুমণ্ডলে নিয়ন্ত্রিত হয় অক্সিজেন, নাইট্রোজেন, তাপমাত্রার অনুপাত। বলাই বাহুল্য, সে-সময় তাঁর এই তত্ত্ব সাড়া ফেলে দিয়েছিল গোটা বিশ্বে। শুনতে অদ্ভুত লাগলেও, গায়া তত্ত্বের সাহায্যেই পরবর্তীতে বিশ্ব উষ্ণায়নের সহজ ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন অন্যান্য বিজ্ঞানীরা।
গত মঙ্গলবার ১০৩ বছরে পা দিয়েছিলেন কিংবদন্তি ব্রিটিশ গবেষক। কিন্তু কে-ই বা জানত, জন্মদিনের দিনেই বিদায় নেবেন তিনি? বিগত মাস দুয়েক ধরেই বার্ধজ্যজনিত সমস্যায় ভুগছিলেন শতায়ু গবেষক। তবে হাসপাতালে ভর্তি করার প্রয়োজন পড়েনি। বাড়ি থেকেই চলছিল চিকিৎসা। মঙ্গলবার সেখানেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন কিংবদন্তি গায়া তত্ত্বের জনক।
লন্ডনের নিকটবর্তী লিচওয়ার্থ গার্ডেন সিটিতে জেমসের জন্ম ১৯১৯ সালে। সামান্য মুদির দোকান চালাতেন বাবা। মা ছিলেন অপেশাদার থিয়েটার অভিনেত্রী। বাবা-মায়ের ব্যস্ততার জন্য ছোটোবেলাটা নানা-নানিরর সঙ্গেই কেটেছিল লাভলকের। পরিবেশের প্রতি তার ভালোবাসার নেপথ্যেও রয়েছেন এই দুটি মানুষ।
বিকেল গড়ালেই নানার হাত ধরে বেরিয়ে পড়তেন কিশোর লাভলক। নানার কথা শুনে শুনেই চিনতে শিখেছিলেন বিভিন্ন গাছ, প্রাণী, পতঙ্গের নাম, তাদের চরিত্রও। নানার মৃত্যুর পর বাবা-মায়ের সঙ্গে লন্ডনে চলে আসেন লাভলক।
ততদিনে প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের। তলব পড়েছে দেশের সমস্ত তরুণদের। তাদেরও হাতে বন্দুক নিয়ে নামতে হবে যুদ্ধের ময়দানে। ১৯৩৯ সাল। তখন তিনি ম্যাঞ্চেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। ভাগ্যের জোরেই এই ‘অমানবিক’ কাজ থেকে নিস্তার পেয়েছিলেন তিনি। ম্যাঞ্চেস্টার বিশ্ববিদ্যালয় ‘কনসায়েন্সিয়াস অবজেক্টর’ স্ট্যাটাস পাওয়ার দৌলতে তাকে আর যেতে হয়নি যুদ্ধক্ষেত্রে।
তবে যুদ্ধ পিছু ছাড়ল না তার। স্নাতকতার পর, এই বিশ্ববিদ্যালয়েই শুরু হয় তার গবেষণা। হানাহানির বাইরেও, যুদ্ধক্ষেত্রে তখন কাতারে কাতারে মানুষ মরছে নানান রোগে। সেইসব প্যাথোজেন চিহ্নিত করাই ছিল লাভলকের কাজ। সেই কাজের ফাঁকেই চলত গবেষণা।
প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনীর জগতে লাভলকের প্রথম বড়ো সাফল্য আসে ১৯৫০-এর দশকে। তার হাত ধরেই প্রকাশ্যে আসে ইলেকট্রন ক্যাপচার ডিটেক্টর। মনুষ্যসৃষ্ট দূষক পদার্থ কোনো পরিবেশে কতটা মিশছে, তা চিহ্নিত করতেই ব্যবহৃত হয় এই যন্ত্র। এই যন্ত্রের সাহায্যেই ডিডিটির ক্ষতিকর প্রভাব কিংবা ধোঁয়াশার রহস্যকেও সামনে আনেন লাভলক।
তবে তার চেয়েও বড়ো আবিষ্কার ছিল ক্লোরো-ফ্লুরো-কার্বন। রেফ্রিজারেটর, শীততাপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রে, সিএফসি-খ্যাত এই উপাদানের ব্যবহার শুরু হয়ে গেছে ততদিনে। লাভলক দেখালেন, পৃথিবীতে আসা সূর্যের আলোকে অনায়াসেই তাপ তরঙ্গে রূপান্তরিত করে ফেলে এই যৌগ। ভেঙে ফেলে ওজন স্তরকেও। এই আবিষ্কারের পরেই ধীরে ধীরে তৈরি হয় গ্লোবাল ওয়ার্মিং বা বিশ্ব উষ্ণায়নের ধারণা।
কাজেই তাকে ছাড়া অসম্পূর্ণই থেকে যায় পরিবেশ আন্দোলনের ইতিহাস। যদিও বিতর্কও কম হয়নি লাভলককে নিয়ে। প্রাথমিকভাবে তার গায়া তত্ত্বকে যেমন প্রত্যাখ্যান করেছিলেন বহু গবেষক, তেমনই চলতি শতকের শুরুতেই ঝড় তুলেছিল তার আরও এক মন্তব্য।
২০০৪ সালে এক বিজ্ঞান সম্মেলনে লাভলক জানিয়েছিলেন, দূষণমুক্ত ভবিষ্যতের জন্য তাপশক্তিতে বর্জন করে নিউক্লিয়ার শক্তির দিকেই ঝুঁকতে হবে মানব সভ্যতাকে। এই বক্তব্যের জেরে তীব্র সমালোচনার শিকার হন শতায়ু পরিবেশবিদ। অবশ্য, দেড় দশক পেরিয়ে আসার পর আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে একাধিক গবেষণা এবং নথিই সমর্থন করছে তার কথা।
আমস্টারডাম পুরস্কার, রয়্যাল অ্যাকাডেমি পুরস্কারের মতো অসংখ্য সম্মান পেয়েছেন লাভলক। পেয়েছেন পরিবেশবিদ্যার নোবেল ‘ব্লু প্ল্যানেট’ মেডেলও। আশ্চর্যের বিষয় হল, একশো পেরিয়ে যাওয়ার পরেও গবেষণা ছাড়েননি শতায়ু গবেষক। সাম্প্রতিক সমস্ত গবেষণা পত্র পাঠ করতেন নিয়মিত। খোঁজ খবর রাখতেন বিজ্ঞান দুনিয়ার।
এমনকি মৃত্যুর মাস ছয়েক আগে পর্যন্তও প্রতিদিন বিকেলে হাঁটতে বের হতেন তিনি। কপ-২৬ সম্মেলনের পর, নিজের বাড়ি থেকেই বার্তা দিয়েছিলেন জলবায়ু পরিবর্তন বন্ধ করা না গেলে প্রাণ হারাবে ১০০ কোটিরও বেশি মানুষ। সতর্ক করেছিলেন আন্তর্জাতিক সংস্থাদের।
এসডব্লিউ/এসএস/২০২৫
আপনার মতামত জানানঃ