টানা ১৫ বছর ক্ষমতার বাইরে দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি। দীর্ঘ সময় ক্ষমতার বাইরে থাকায় আর্থিক সংকটে পড়েছে তারা। ফলে মাঠের রাজনীতিতে দলীয় বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়নসহ ক্ষতিগ্রস্ত নেতাকর্মীদের আর্থিক সহায়তা দিতেও বেগ পেতে হচ্ছে তাদের
আর্থিক সংকটে পড়ার কারণ হিসেবে বিএনপির নেতৃবৃন্দ বিএনপিপন্থী ব্যবসায়ীদের দলত্যাগ, নির্বাচন বর্জনের কারণে মনোনয়ন বাণিজ্য বন্ধ হওয়া, করোনাসহ সরকারের দমন-পীড়নের কারণে দলীয় নেতাকর্মীদের ব্যবসায় মন্দাভাব এবং নিয়মিত চাঁদা আদায় না হওয়ার বিষয়টি আলোচিত।
আর্থিক সংকট পিছু ছাড়ছে না ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপির। ২০১৯, ২০ সালের মতো ২০২১ সালেও তহবিল ঘাটতিতে দলটি। গত বছরে দলটির আয়ের চেয়ে সোয়া কোটি টাকা ব্যয় বেশি হয়েছে। ২০২১ সালে আগের বছরের তুলনায় বিএনপির আয় কমেছে ৩৮ লাখ ৪১ হাজার ৮১৯ টাকা। অন্যদিকে ব্যয় বেড়েছে ২৩ লাখ ৯৪ হাজার ৬৭১ টাকা। এই ঘাটতি মেটানো হয়েছে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় মনোনয়ন ফরম বিক্রির সঞ্চিত অর্থ থেকে।
বৃহস্পতিবার(২৮ জুলাই) নির্বাচন ভবনে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী আহমেদ ২০২১ পঞ্জিকা বছরের আয়-ব্যয়ের অডিট রিপোর্ট জমা দিয়েছেন।
গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ অনুযায়ী প্রতি বছর ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে দলগুলোকে আয়-ব্যয়ের হিসাব নির্বাচন কমিশনে দাখিল করতে হয়।
বিএনপির অডিট রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০২১ সালে দলটির আয় ৮৪ লাখ ১২ হাজার ৪৪৪ টাকা। আর ব্যয় হয়েছে ১ কোটি ৯৮ লাখ ৪৭ হাজার ১৭১ টাকা। মোট ঘাটতি রয়েছে ১ কোটি ১৪ লাখ ৩৪ হাজার ৭২৭ টাকা। রিজভী বলেন, ঘাটতি মেটানো হয়েছে ব্যাংক রিজার্ভ থেকে।
২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনের পর বিএনপির আর সঞ্চয় হয়নি। ঐ বছরে বিএনপি আয় দেখিয়েছিল ৯ কোটি ৮৬ লাখ ৫৬ হাজার ৩৮০ টাকা। আর ব্যয় হয়েছিল ৩ কোটি ৭৩ লাখ ২৯ হাজার ১৪৩ টাকা। সে সময় দলটির তহবিল দাঁড়িয়েছিল ৬ কোটি ১৩ লাখ ২৭ হাজার ২৩৭ টাকা। এরপর থেকে টানা তিন বছর কেবল ব্যয় বেড়েছে।
২০২০ সালে বিএনপির আয় হয়েছিল ১ কোটি ২২ লাখ ৫৩ হাজার ১৪৯ টাকা। আর ব্যয় হয়েছিল ১ কোটি ৭৪ লাখ ৫২ হাজার ৫১৩। ব্যয় বেশি হয়েছে ৫১ লাখ ৯৯ লাখ ৩৬৪ টাকা, যা বিএনপির তহবিল থেকে খরচ করা হয়েছে। ২০১৯ পঞ্জিকা বছরের যে হিসাব দিয়েছিল দলটি, তাতে সে বছর আয়ের চেয়ে তিন গুণের বেশি ব্যয় হয়েছিল। সে সময় বিএনপির আয় করেছে ৮৭ লাখ ৫২ হাজার ৭১০ টাকা। আর ব্যয় হয়েছে ২ কোটি ৬৬ লাখ ৮৬ হাজার ১৩৭ টাকা। আয়-ব্যয়ের পার্থক্য হচ্ছে ১ কোটি ৭৯ লাখ ৩৩ হাজার ৪২৭ টাকা। অর্থাৎ আয়ের তিন গুণেরও বেশি ব্যয় হয়েছে।
এর আগে টানা তিন বার ব্যয়ের চেয়ে আয় বেশি ছিল দলটির। বিএনপি মনোনয়ন ফরম বিক্রি, দলীয় সদস্যদের মাসিক চাঁদা, এককালীন অনুদান হতে আয় করে থাকে। আর অফিসের বিভিন্ন খরচ, নির্বাচনি ব্যয়, ত্রাণ কার্যক্রম, কর্মচারীর বেতন-ভাতা, বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজন প্রভৃতি খাতে ব্যয় করে থাকে। বিএনপি কর্মচারীদের বেতন-বোনাস প্রদানে সবচেয়ে বেশি ব্যয় করেছে। ৭৫ লাখ টাকার বেশি ব্যয় হয়েছে এ খাতে।
ইসির সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, দলগুলোর সবচেয়ে বড় আয়ের খাত হলো নির্বাচনে মনোনয়ন ফরম বিক্রি। বিএনপি নির্বাচন বর্জন করায় সেই অর্থ সংগ্রহ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তাই তহবিল বড় না হয়ে কেবল দিন দিন ছোট হচ্ছে।
২০১৭ সালে দলটি মোট আয় দেখিয়েছিল ৯ কোটি ৪৬ লাখ ২৪ হাজার ৯০২ টাকা। আর মোট ব্যয় দেখিয়েছে ৪ কোটি ১৯ লাখ ৪১ হাজার ৯৫৪ টাকা। ৫ কোটি ২৬ লাখ ৫২ হাজার ৯৪৮ টাকা হাতে বা ব্যাংকে রয়েছে। ২০১৬ সালে বিএনপির আয় হয়েছিল ৪ কোটি ১৩ লাখ ৬৮ হাজার ৭৩০ টাকা। আর ব্যয় হয়েছিল ৩ কোটি ৯৯ লাখ ৬৩ হাজার ৭৫২ টাকা। আয় বেশি হয়েছে ১৪ লাখ ৪ হাজার ৭৭৮ টাকা।
দলগুলোর সবচেয়ে বড় আয়ের খাত হলো নির্বাচনে মনোনয়ন ফরম বিক্রি। বিএনপি নির্বাচন বর্জন করায় সেই অর্থ সংগ্রহ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তাই তহবিল বড় না হয়ে কেবল দিন দিন ছোট হচ্ছে।
এর আগের তিন বছর দলটি ঘাটতিতে ছিল। ২০১৫ পঞ্জিকা বছরে বিএনপি ১৪ লাখ ২৬ হাজার ২৮৪ টাকা ঘাটতি দেখিয়েছিল। ঐ সময় দলটি আয় দেখিয়েছিল ১ কোটি ৭৩ লাখ ৩ হাজার ৩৬৫ টাকা। আর ব্যয় দেখিয়েছে ১ কোটি ৮৭ লাখ ২৯ হাজার ৬৪৯ টাকা। ২০১৪ পঞ্জিকা বছরে দলটি বিভিন্ন খাতে ২ কোটি ৮৭ লাখ ৪৮ হাজার ৫৭৪ টাকা আয় দেখিয়েছে। আর ব্যয় দেখিয়েছে ৩ কোটি ৫৩ লাখ ৩ হাজার টাকা। এতে আয়ের চেয়ে ৬৫ লাখ ৫৪ হাজার ৪২৬ টাকা বেশি ব্যয় হয়েছে দলটির। ২০১৩ পঞ্জিকা বছরে দলটি ৭৬ লাখ ৫ হাজার ৭৬২ টাকা আয়ের বিপরীতে ২ কোটি ২৭ লাখ ২৫ হাজার ৩২৬ টাকা ব্যয় দেখিয়েছিল। সে সময় ঘাটতি ছিল প্রায় দেড় কোটি টাকা।
বিএনপির স্থায়ী কমিটিসহ বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা সংবাদমাধ্যমকে বলছেন, রাজনৈতিক দলগুলোর দৃশ্যমান আয়ের অর্থ আসে মনোনয়ন ফরম বিক্রি থেকে। এছাড়া এককালীন অনুদান এবং দলীয় সদস্যদের মাসিক চাঁদা থেকেও মোটা অঙ্কের অর্থ আসে; বিএনপির ক্ষেত্রেও আয়ের উৎস একই।
ওই তিন খাতে বিএনপির আয় কমেছে— উল্লেখ করে তারা বলেন, বর্তমান সরকারের আমলে নির্বাচনে কারচুপি এবং হামলা-মামলার কারণে বিভিন্ন সময় বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে বিরত ছিল। সর্বশেষ গত বছর থেকে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়ে সব ধরনের নির্বাচন থেকে নিজেদের দূরে রেখেছে তারা। ফলে মনোনয়নপত্র বিক্রি থেকে যে অর্থ আসত, সেটাও বন্ধ হয়ে গেছে।
দ্বিতীয় কারণ হিসেবে তারা বলছেন, দলের ব্যবসায়ী নেতারা সাধারণত এককালীন মোটা অঙ্কের অনুদান দিয়ে থাকেন। কিন্তু বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিএনপির ব্যবসায়ী নেতাদের ব্যাংক থেকে ঋণ পাওয়াসহ ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে নানা প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হয়েছে। ফলে তারা আগের মতো অর্থ দিয়ে দলকে সহায়তা করতে পারছেন না।
তৃতীয় কারণ হিসেবে বিএনপি নেতারা বলছেন দলীয় সদস্যদের মাসিক চাঁদা আগের মতো জমা পড়ছে না। ফলে দিন দিন দলটির আর্থিক সংকট বাড়ছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য সংবাদমাধ্যমকে বলেন, দল ক্ষমতায় থাকলে বিভিন্ন উপলক্ষে প্রকাশ্যে কিংবা অপ্রকাশ্যে দলীয় তহবিলে টাকা দেওয়ার লোকের অভাব হয় না। শুধু দলীয় তহবিলে নয়, অনেকে তখন ব্যক্তিগত উপহারও দেন। কারণ, তারা দলীয় সুযোগ-সুবিধা নিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটান। কেউ তদবিরও করেন। কেউ কেউ আবার দলীয় ক্ষমতা ব্যবহার করে নানা সুবিধা আদায় করে নেন। কিন্তু দল ক্ষমতায় না থাকায় এসব সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন সবাই। টান পড়ছে দলীয় তহবিলেও।
রাজনৈতিক দলগুলোর বৈধ আয়ের বড় উৎস হচ্ছে মনোনয়নপত্র বিক্রি— উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, এ সুবিধা আদায় থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে বিএনপি। কারণ ব্যাখ্যা করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির ওই সদস্য বলেন, ‘দল ক্ষমতায় থাকলে যেকোনো নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী প্রার্থীর অভাব হয় না। তখন একটি পদের বিপরীতে অনেক প্রার্থী মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেন। অন্যদিকে, দল ক্ষমতায় না থাকলে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী প্রার্থীর সংখ্যাও কমে যায়। মনোনয়ন বাণিজ্যও হ্রাস পায়।’
‘এছাড়া বর্তমান সরকারের আমলে বিভিন্ন সময় বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে বিরত রয়েছে। ফলে মনোনয়নপত্র বিক্রি থেকে যে অর্থ আয় হতো সেটিও বন্ধ আছে। দলটির আর্থিক সংকটে পড়ার অন্যতম কারণও এটি।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির সম্পাদকমণ্ডলীর এক নেতা বলেন, মাঠপর্যায়ের কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে অনেক নেতাকর্মী প্রতিপক্ষের হামলায় আহত বা ক্ষতিগ্রস্ত হন। কেউ কেউ অসুস্থ হয়ে পড়েন। তখন দলীয় তহবিল থেকে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়। সেই অর্থের পরিমাণ এক থেকে দুই লাখ টাকা বা তারও অধিক হতো। কিন্তু এখন দল আর্থিক সংকটে পড়ায় সহায়তার পরিমাণ অনেক কমেছে।
‘আর্থিকভাবে সচ্ছল অনেক নেতা এখন দলীয় তহবিলে আগের মতো অনুদান দিতে পারেন না। ক্ষমতার বাইরে থাকায় নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে হাজারো মামলা দায়ের হয়েছে। ভুক্তভোগী এসব নেতাকর্মীর জামিন এবং আদালতে নিয়মিত হাজিরা দিতে অনেক অর্থ ব্যয় হয়। আগে দলীয় তহবিল থেকে এক্ষেত্রে সহায়তা দেওয়া হলেও এখন ব্যক্তিগতভাবে খরচ করতে হচ্ছে। অনেকে নিজেদের সম্পদ বিক্রি করে এ ব্যয় বহন করছেন।’
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪২৪
আপনার মতামত জানানঃ