ঋণের নামে জালিয়াতি করে পদ্মা ব্যাংকের (সাবেক ফারমার্স ব্যাংক) পৌনে ৩ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগের মামলায় রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান মো. সাহেদকে জামিন দিয়েছেন হাইকোর্ট।
আজ বৃহস্পতিবার বিচারপতি এস এম কুদ্দুস জামান ও বিচারপতি কে এম জাহিদ সারওয়ার কাজলের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন। দুদকের আইনজীবী খুরশিদ আলম খান বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
২০২০ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর ঋণের নামে জালিয়াতি করে পদ্মা ব্যাংকের (সাবেক ফারমার্স ব্যাংক) পৌনে তিন কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান মো. সাহেদ করিম, বাবুল চিশতীসহ চারজনের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক (দুর্নীতি দমন কমিশন)।
দুদকের প্রধান কার্যালয়ের উপসহকারী পরিচালক মোহাম্মদ শাহাজাহান মিরাজ বাদী হয়ে কমিশনের সমন্বিত জেলা কার্যালয় ঢাকা-১-এ মামলা করে দুদক। দুদক জানায়, পরস্পর যোগসাজশে অসৎ উদ্দেশ্যে ক্ষমতার অপব্যবহার, বিশ্বাস ভঙ্গ করে অর্থ স্থানান্তর ও রূপান্তরের মাধ্যমে ঋণের নামে পদ্মা ব্যাংকের এক কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন, যা চলতি বছরের ১৫ জুলাই পর্যন্ত সুদ-আসলে দাঁড়ায় দুই কোটি ৭১ লাখ টাকা। দুদক আসামিদের বিরুদ্ধে পৌনে তিন কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ এনেছে।
মামলায় অন্যতম আসামি হলেন- সাবেক ফারমার্স ব্যাংকের (বর্তমানে পদ্মা ব্যাংক) উদ্যোক্তা পরিচালক ও ক্রেডিট কমিটির সাবেক চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক চিশতী ওরফে বাবুল চিশতী।
অন্য দুই আসামি হলেন- বাবুল চিশতীর ছেলে রাশেদুল হক চিশতী ও রিজেন্ট হাসপাতালের এমডি মো. ইব্রাহিম খলিল। তাদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৪০৯/১০৯ ধারা, ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারা এবং মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন-২০১২-এর ৪ ধারায় মামলাটি দায়ের করা হয়।
সূত্র জানায়, সাহেদ রিজেন্ট হাসপাতালের এমআরআই মেশিন কেনার জন্য দুই কোটি টাকার ঋণের জন্য পদ্মা ব্যাংকের গুলশান করপোরেট শাখায় আবেদন করেন ২০১৫ সালের ১১ জানুয়ারি। ২০১৫ সালের ১৯ জানুয়ারি পদ্মা ব্যাংকের গুলশান শাখা থেকে ওই মেশিন কেনার জন্য সরবরাহকারী হিসেবে ‘আর্বটস মেডিকেল ইকুইপমেন্টের’নামে দুই কোটি টাকার পে-অর্ডার ইস্যু করা হয়। পে-অর্ডারটি একটি বাণিজ্যিক ব্যাংকের হিসাবে স্থানান্তর করা হয়। পরে সেই হিসাব থেকেই দুই কোটি টাকা উত্তোলন করা হয় ২০১৫ সালের ২১ জানুয়ারি।
এদিকে ওই দুই কোটি টাকার ঋণ মঞ্জুর করার আগেই সাহেদ ঘুষ হিসেবে পদ্মা ব্যাংকের বকশীগঞ্জ শাখায় বাবুল চিশতীর মালিকানাধীন বকশীগঞ্জ জুট স্পিনার্স লিমিটেডের নামে ০১১১১০০০০২৩৬৩ নং হিসাবে ৩৫ লাখ টাকা জমা করেন। জমা রশিদ নং-৩০। পরে জমা করা ওই টাকা ২০১৫ সালের ১৮ ও ২০ জানুয়ারি উত্তোলন করেন বকশীগঞ্জ জুট স্পিনার্স লিমিটেডের এমডি ও বাবুল চিশতীর ছেলে রাশেদুল হক চিশতী।
দুদক জানায়, ঘুষের ৩৫ লাখ টাকা বাবুল চিশতীর ছেলে রাশেদুল চিশতী বকশীগঞ্জ জুট স্পিনার্স লিমিটেডের হিসাব থেকে উত্তোলন করলেও ঘুষ গ্রহণের পেছনে সব কলকাঠি নেড়েছেন বাবুল চিশতী। তিনি বকশীগঞ্জ জুট স্পিনার্সের চেয়ারম্যান।
রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান সাহেদের বিরুদ্ধে করোনাভাইরাসের টেস্ট নিয়ে জালিয়াতির বিস্তর অভিযোগ ওঠার পর ২০২০ সালের ৬ জুলাই রিজেন্ট হাসপাতালের উত্তরা ও মিরপুর শাখায় অভিযান চালায় র্যাব। অভিযানে ভুয়া করোনা পরীক্ষার রিপোর্ট, করোনা চিকিৎসার নামে রোগীদের কাছ থেকে অর্থ আদায়সহ বিভিন্ন অনিয়ম উঠে আসে। ওই বছরের ৭ জুলাই রাতে উত্তরা পশ্চিম থানায় সাহেদসহ ১৭ জনকে আসামি করে মামলা করা হয়। এ ঘটনার পর পালিয়ে যান সাহেদ। ২০২০ সালের ১৫ জুলাই সাহেদকে সাতক্ষীরার সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। পরে তাকে হেলিকপ্টারে করে সাতক্ষীরা থেকে ঢাকায় আনা হয়।
প্রতারণার শুরু
দু’হাজার নয় সালের দিকে মোঃ সাহেদ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে মালামাল সরবরাহের ঠিকাদারি করতেও শুরু করেন। রাইজিং শিপিং এন্ড ট্রেডিং কোম্পানি ও রাইজিং রিয়েল এস্টেট নামে সেই সময় তিনি দুইটা প্রতিষ্ঠান চালাতেন। এসি সরবরাহে প্রতারণার মামলায় ২০০৯ সালে প্রথম গ্রেপ্তার হয়েছিলেন মোঃ সাহেদ।
খুলনার একটি টেক্সটাইল মিলে এসি সরবরাহের করে বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানকে তিনি চেক দিলেও তা প্রত্যাখ্যাত হয়। সেই মামলায় তাকে কয়েকমাস কারাগারে থাকতে হয়।
মোঃ সাহেদ ২০০৯ সালে তিনি ডিবিএস নামের একটি কুরিয়ার সার্ভিস চালু করেন। সেখানে চাকরি করা সাতক্ষীরার কাজী সালাহউদ্দিন বাংলাদেশের দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকাকে বলেছেন, তাকে ওই প্রতিষ্ঠানে ৫০ হাজার টাকা বেতনে চাকরি দেয়া হয়েছিল। কিন্তু এক টাকাও বেতন না দেয়ায় দুই বছর পরে তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। তার কাছ থেকে ২৯ লাখ টাকার আসবাবপত্র নিয়ে এক টাকাও পরিশোধ করেননি।
এই কুরিয়ার সার্ভিসে চাকরি দেয়ার নাম করে অনেকের কাছ থেকে তিনি অর্থ আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
দু’হাজার দশ সালে সাহেদ ধানমণ্ডি এলাকায় বিডিএস কিক ওয়ান ও কর্মমুখী কর্মসংস্থান সোসাইটি (কেকেএস) নামে দুটি বহু ধাপের বিপণন কোম্পানি শুরু করেন। গ্রাহকদের কাছ থেকে টাকাপয়সা আত্মসাৎ করে তিনি ভারতে পালিয়ে যান বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। সেই সময় তিনি নিজেকে পরিচয় দিতে সামরিক বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বলে পরিচয় দিতেন। সেই সময় তারা সপরিবারে ভারতের বারাসাতে কিছুদিন ছিলেন।
র্যাবের কর্মকর্তাদের মতে, এই ব্যবসা থেকে আত্মসাৎ করা অর্থ দিয়েই তিনি রিজেন্ট গ্রুপ চালু করেন। সেসব মামলায় জামিন হওয়ার পর তিনি দেশে এসে আবার ব্যবসা শুরু করেন।
তার আয়ের আরেকটি উৎস ছিল প্রতারণার মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ না করা। মার্কেন্টাইল কো-অপারেটিভ থেকে ছয় কোটি টাকা ঋণ নিয়ে পরিশোধ না করার বিষয়ে দুইটি মামলা আদালতে চলছে। এসব অভিযোগে তার বিরুদ্ধে ধানমণ্ডি, উত্তরাসহ বিভিন্ন থানায় অন্তত ৩২টি মামলা আছে বলে র্যাব জানতে পেরেছে। তিনি মালামাল নিয়ে চেক দিলেও সেসব হিসাবে কোন টাকা থাকতো না।
আ’লীগের সাথে ঘনিষ্ঠতা
রিজেন্ট গ্রুপ চালু করার পর তিনি হাসপাতাল, আবাসন, হোটেল, কলেজসহ একাধিক ব্যবসা চালু করেন। সেই সঙ্গে ঠিকাদারি ব্যবসাও শুরু করেন। কিন্তু ঠিকাদারির জন্য মালামাল নিয়ে টাকা পরিশোধ না করা বা চেক দিলেও প্রত্যাখ্যাত হওয়ার অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। সেসব ঘটনায় ঢাকার অনেকগুলো থানায় মামলা ও জিডির খবর পাওয়ার তথ্য জানিয়েছেন র্যাবের কর্মকর্তারা।
তার ফেসবুক একাউন্টে নিজের পরিচয় দিয়েছেন আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক কমিটির সদস্য, ন্যাশনাল প্যারা অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট, রিজেন্ট ডিজাইন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট,রিজেন্ট কেসিএস লিমিটেড, কর্মমুখী কর্মসংস্থান লিমিটেড, রিজেন্ট হাসপাতাল লিমিটেড ও রিজেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান।
সেন্টার ফর পলিটিকাল রিসার্চ নামের একটি প্রতিষ্ঠানেরও তিনি চেয়ারম্যান। এই পরিচয়ে তিনি একাধিক টেলিভিশন টকশোতে এসেছেন।
সরকারপ্রধান থেকে শুরু করে, ক্ষমতাসীন দলের নেতা, মন্ত্রী, এমপি, সচিব, আমলা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শীর্ষ ব্যক্তিদের সঙ্গে তার ছবি রয়েছে।
র্যাবের পরিচালক সারওয়ার বিন কাশেম বলেছেন, দুষ্ট লোকেরা নিজেদের অপকর্ম আড়াল করতে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সঙ্গে ছবি তোলেন।
তিনি বলেন, “বাংলাদেশের হর্তা-কর্তা ব্যক্তিদের সাথে সে ছবি তুলেছে। এটা আসলে তার একটা মানসিক অসুস্থতা। এই ছবি তোলাকে কেন্দ্র করেই সে প্রতারণা করতো।”
মো: শাহেদের রাজনৈতিক পরিচয় সম্পর্কে সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্ন করা হলে র্যাবের পরিচালক সারওয়ার বিন কাশেম বলেন, “প্রতারকদের কোন রাজনৈতিক পরিচয় নেই। তারা যখন যার নাম পারে তখন সেটা বেচে নিজের জীবনকে অগ্রগামী করার চেষ্টা করে। ”
একটি পত্রিকার ডিক্লারেশনও নিয়েছিলেন তিনি, যার সম্পাদক ও প্রকাশক হিসাবে তার নাম রয়েছে।
রিজেন্ট গ্রুপের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, মোঃ. সাহেদ আত্রাই নদ ড্রেজিং প্রকল্পের কাজ করেছেন। কক্সবাজারের শাহপরীর দ্বীপ ও কক্সবাজারের সাইক্লোন শেল্টার, প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপনেও কাজ করেছেন।
নিজের পরিচিতি বাড়াতে টাকার বিনিময়ে টেলিভিশন চ্যানেলের টকশোতে যেতে শুরু করেন মোঃ সাহেদ। আবার প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সঙ্গে ছবি তুলে সেসব ছবি সামাজিক মাধ্যম, নিজের অফিস ও বাসায় টাঙিয়ে রাখতেন।
একসময় বিএনপির নেতাদের সঙ্গে সাহেদের ছবি দেখা গেলেও, আওয়ামী লীগের একটি উপ-কমিটিরও সদস্য হয়েছিলেন মোঃ সাহেদ।
আওয়ামী লীগের নেতারা জানিয়েছেন, ২০১৫ সালের আগেও আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সাহেদ করিমের কোন সম্পৃক্ততা ছিল না। তবে ২০১৬ সাল থেকে তিনি বিভিন্ন নেতার সঙ্গে যোগাযোগ করতে শুরু করেন। এমনকি ২০১৭ সালে আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপ-কমিটির সদস্য হন।
এসডব্লিউ/এসএস/২১৩৩
আপনার মতামত জানানঃ