চীন ও তাইওয়ানের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে চলা উত্তেজনা বর্তমানে এক নতুন মাত্রায় পৌঁছেছে। চীন গণতান্ত্রিক এই ভূখণ্ডকে নিজেদের অংশ বলে দাবি করে থাকে। সম্প্রতি তাইওয়ানের আকাশ প্রতিরক্ষা অঞ্চলে চীনের সামরিক বিমানের আনাগোনা বেড়ে যাওয়ায় উত্তেজনার পারদ এখন চরমে।
যুক্তরাষ্ট্রের হাউস স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি স্বশাসিত দ্বীপ তাইওয়ান সফর করতে পারেন। এমন সফর সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকি ও এক চীন নীতি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সরে যাওয়া হিসেবে দেখছে বেইজিং।
এমন পদক্ষেপের পরিণতি হবে মারাত্মক বলে হুঁশিয়ারি দেয়া হয়েছে চীনের পক্ষ থেকে।
বিবিসির প্রতিবেদনে জানানো হয়, গুঞ্জন সত্যি হলে ন্যান্সি পেলোসিই হবেন ১৯৯৭ সালের পর তাইওয়ানে যাওয়া যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ কর্মকর্তা।
চীনের হুমকির মুখে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক যুক্তরাষ্ট্রের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, যদি ন্যান্সি পেলোসি তাইওয়ান সফরের পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যান, তাহলে পেন্টাগন সেখানে অতিরিক্ত যুদ্ধজাহাজ, বিমান ও নজরদারি ব্যবস্থা পাঠাতে পারে।
পেলোসির বিমানকে ঘিরে বাফার জোন স্থাপনের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের মধ্যে। কর্মকর্তারা বলছেন, চীনসংক্রান্ত যেকোনো সম্ভাব্য ঘটনার জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে প্রস্তুত থাকতে হবে।
চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ঝাও লিজিয়ান বুধবার সাংবাদিকদের বলেন, ‘যদি যুক্তরাষ্ট্র তার নিজস্ব পথে চলে এবং চীনের সীমারেখাকে চ্যালেঞ্জ করে, তাহলে অবশ্যই এর কঠোর জবাব দেয়া হবে।’
সম্প্রতি তাইওয়ান নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বিরোধ দেখা দিয়েছে চীনের। বেশ কয়েকবারই চীনের বিমান তাইওয়ানের আকাশসীমা লঙ্ঘন করেছে। চীন দাবি করে থাকে, তাইওয়ান দেশটির অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাইওয়ানের স্বাধীনতা ঘোষণার পরিণতির বিষয়ে বরাবরই সতর্ক করে দিয়ে আসছে চীন। তবে যুক্তরাষ্ট্র সাফ জানিয়ে দিয়েছে, তাইওয়ানে যেকোনো চীনা আগ্রাসনের সামরিক জবাব দেবে ওয়াশিংটন।
যদি ন্যান্সি পেলোসি তাইওয়ান সফরের পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যান, তাহলে পেন্টাগন সেখানে অতিরিক্ত যুদ্ধজাহাজ, বিমান ও নজরদারি ব্যবস্থা পাঠাতে পারে।
স্বায়ত্তশাসিত তাইওয়ানকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া প্রদেশ মনে করে চীন। দেশটির ইচ্ছা তাইওয়ানকে আবার মূল ভূখণ্ডের অন্তর্ভুক্ত করা। সে লক্ষ্যে প্রয়োজনে বল প্রয়োগ করতে চায় বেইজিং।
তাইওয়ানে পেলোসির সম্ভাব্য সফর শুধু চীনের মাথাব্যথার কারণই হয়নি, এটি একই সঙ্গে ভাবিয়েছে বাইডেন প্রশাসনকেও। স্পিকারকে পূর্ব এশিয়ার দেশটিতে যেতে নিরুৎসাহ করার খবর পাওয়া গেছে।
গত মার্চে যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের নৌবাহিনীর প্রধান অ্যাডমিরাল জন সি অ্যাকুইলিনো বলেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর গত দুই দশক ধরে চীন এ অঞ্চলে সবচেয়ে বড় সামরিক বাহিনী গঠন ও অস্ত্রে সজ্জিত হচ্ছে, যা এ অঞ্চলের সামরিক ভারসাম্য নষ্ট করছে।
অ্যাকুইলিনো দাবি করেন, এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর উদ্দেশ্য ‘যুদ্ধ এড়ানো’, তবে পেন্টাগন চীনের বিরুদ্ধে লড়াই ও জেতার জন্য প্রস্তুত।
ন্যান্সি পেলোসি যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে ক্ষমতাধর রাজনীতিকদের একজন। প্রেসিডেন্ট এবং ভাইস প্রেসিডেন্টের পরেই তার অবস্থান। ক্ষমতাসীন ডেমোক্র্যাট দলের অত্যন্ত প্রভাবশালী একজন নেতা তিনি।
মার্কিন রাজনৈতিক মহলে সবসময়ই তাকে কট্টর চীন-বিরোধী হিসেবে দেখা হয়। চীনের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে তিনি সব সময়ই সোচ্চার। চীন সফরে গিয়ে তিয়েনানমেন স্কয়ারে গিয়েছিলেন তিনি। নির্বাসিত চীনা ভিন্নমতালম্বীদের সঙ্গে তার যোগাযোগের কথা সবাই জানে।
ফলে এমন একজন ব্যক্তির তাইওয়ানে যাওয়ার এই পরিকল্পনাকে যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের পক্ষ থেকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত একটি উসকানি হিসেবে দেখছে চীন।
বিশেষ করে অনেক পর্যবেক্ষক মনে করছেন, চীনের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির বর্তমান যে প্রেক্ষাপট তাতে এই সময়ে ন্যান্সি পেলোসির এই সফর চীনের ক্ষমতার শীর্ষ পর্যায়ে অস্বস্তি তৈরি করেছে।
আর কয় সপ্তাহ পরেই চীনা কম্যুনিস্ট পার্টির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় কংগ্রেসে প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং তৃতীয় মেয়াদের ক্ষমতার জন্য অনুমোদন চাইবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের সাবেক শীর্ষ কর্মকর্তা সুজান এল শার্ক নিউ ইয়র্ক টাইমসকে বলেন, ঠিক এই সময়ে স্পিকার পেলোসির এই সফরকে শি জিনপিং এবং তার পার্টি তাদের জন্য অপমানজনক বলে বিবেচনা করতে পারে। এই কর্মকর্তা চীনা রাজনীতি নিয়ে একটি বইও লিখেছেন।
তিনি বলেন, এই অপমান বোধ থেকে চিন্তা-ভাবনা না করে শক্তি প্রদর্শনের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলতে পারেন প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। এই বিশ্লেষক মনে করেন সংঘাতের ঝুঁকি না নিয়ে এখন এই সফর স্থগিত করাই সঠিক হবে।
আগেও তাইওয়ানের বিষয়ে চীনকে সতর্ক করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। এরপর বেইজিং এ যাবৎকালের সবচেয়ে কড়া ভাষায় তার প্রতিবাদ করে। চীন বলছে, তাইওয়ানের স্বাধীনতার ‘যেকোনো প্রচেষ্টা দৃঢ়তার সঙ্গে চুরমার করে দেবে’ দেশটি।
চীনকে উদ্দেশ্য করে সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেন, তাইওয়ানের কাছে যুদ্ধবিমান উড়িয়ে ‘বিপদ নিয়ে খেলছে’ চীন। আক্রান্ত হলে সামরিকভাবে দ্বীপটিকে রক্ষা করারও অঙ্গীকার করেন তিনি।
তাইওয়ান নিজেদের সার্বভৌম জাতি হিসেবে মনে করে। তবে দ্বীপটিকে নিজের অংশ বলেই দাবি করে আসছে চীন। যুক্তরাষ্ট্রকে নিজেদের সবচেয়ে বড় মিত্র মনে করে তাইওয়ান। দ্বীপটির আত্মরক্ষায় সহযোগিতা প্রদান নিয়ে ওয়াশিংটনের একটি আইনও রয়েছে।
সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনায় এই কথার লড়াই শুরু হয়েছে। তাইওয়ানের আকাশ প্রতিরক্ষা অঞ্চলে যুদ্ধবিমান পাঠানো বাড়িয়েছে চীন। গত মে মাসে চলতি বছরের সবচেয়ে বড় যুদ্ধবিমান বহরটি পাঠিয়েছিল দেশটি। এদিকে তাইওয়ানের জলসীমায় নৌবাহিনীর জাহাজ পাঠিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
তাহলে কি সামরিক সংঘাতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন?
চীন তাইওয়ানে আগ্রাসন চালালে যুদ্ধ শুরু হবে এটাই বড় দুশ্চিন্তা। অতীতে বেইজিং বলেছে, প্রয়োজনে দেশটি শক্তি প্রয়োগ করে দ্বীপটি দখলে নেবে। তবে বিশ্লেষকেরা বলছেন, এখনই তেমন কিছু হচ্ছে না।
তাইওয়ানে আগ্রাসন চালিয়ে সফল হওয়ার মতো সামরিক সামর্থ্য চীনের আছে কি না, এ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। নিজেদের আকাশ ও সমুদ্র প্রতিরক্ষা তাইওয়ান লক্ষণীয়ভাবে বাড়িয়ে চলেছে।
অবশ্য অনেকেই এ বিষয়ে একমত, তাইওয়ানে আগ্রাসন চালানোর মতো পদক্ষেপের মূল্য যে অনেক চড়া এবং ধ্বংসাত্মক হবে, বেইজিং তা স্বীকার করে নিয়েছে। আর তা কেবল চীনের জন্যই নয়, বরং গোটা বিশ্বের জন্যও।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১২৪০
আপনার মতামত জানানঃ