প্রায় ৬ মাস হতে চলেছে রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ। হতে পারো আরো দীর্ঘস্থায়ী। এই অবস্থায় বাইডেনের ঘনিষ্ঠ মিত্ররাও প্রশ্ন তুলেছেন যে, আমেরিকা কি অচিরেই যুদ্ধের খরচ বহনের চাপে ক্লান্ত হয়ে উঠবে? এই ভারে পরিশ্রান্ত হয়ে ওয়াশিংটন কি ইউক্রেনকে পরিত্যাগই করবে?
প্রসঙ্গত, রাশিয়াকে ঠেকাতে ‘যতদিনই লাগুক’ ইউক্রেনকে সাহায্য দান চালিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। এরমধ্যেই তার প্রশাসন শুধু সামরিক সহায়তা বাবদ ৮০০ কোটি ডলারের বেশি খরচ করেছে। গত মে মাসে আরো ৪ হাজার কোটি ডলারের অতিরিক্ত বরাদ্দ দেয় মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদ (কংগ্রেস)। বাইডেনের চাওয়ার চেয়েও বেশি এ বরাদ্দ কংগ্রেস দেয়, রুশ-বিরোধী লড়াইয়ে ইউক্রেনকে সহায়তার পাশাপাশি যুদ্ধের বৈশ্বিক পরিণতিগুলি মোকাবিলায়।
তবে মিত্রদের তরফ থেকে এমন প্রশ্ন ওঠার যথেষ্ট ন্যায্যতা আছে। আমেরিকায় (যুক্তরাষ্ট্রে) মূল্যস্ফীতি এখন চার দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ। সামনেই নভেম্বরে মধ্য-মেয়াদি নির্বাচন। এতে বিরোধী রিপাবলিকানরা কংগ্রেসে সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে উঠতে পারে; হয়তোবা সিনেটেরও দখল যাবে তাদেরই কাছে। কারণ, এই মুহূর্তে মার্কিন জনতার কাছে বাইডেন যতটা অজনপ্রিয়, সাবেক রাষ্ট্রপতি ট্রাম্পও ততোটা ছিলেন না মধ্যমেয়াদি নির্বাচনের আগের এ সময়ে।
ডেলাওয়ার অনলাইন নামক গণমাধ্যমে ডেমোক্রেট দলের সিনেটর এবং বাইডেনের ঘনিষ্ঠ মিত্র বলে পরিচিত ক্রিস কুনস এক নিবন্ধ লিখেছেন। এতে তিনি গত মাসে স্পেনের মাদ্রিদে অনুষ্ঠিত ন্যাটো সম্মেলনে সামরিক জোটটির সদস্যদের রুশ-বিরোধী ঐক্যের প্রশংসা করেছেন। একইসাথে ধ্বংসাত্বক রূপ নেওয়া দীর্ঘ এ লড়াইয়ে মার্কিন জনতা ও তাদের নির্বাচিত নেতৃত্ব- ইউক্রেনকে দেওয়া সমর্থনের প্রতিশ্রুতি অক্ষুণ্ণ রাখতে পারবে কিনা- তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন কুনস।
এবিষয়ে তিনি দ্য ইকোনমিস্টকে বলেছেন, ‘পশ্চিমারা (যুদ্ধ থেকে) আগ্রহ হারাক, তাই চাইছেন’ রুশ নেতা ভ্লাদিমির পুতিন। ইউক্রেনের জন্য এপর্যন্ত ওয়াশিংটন যে সহায়তা ঘোষণা করেছে, আগামী সেপ্টেম্বরের শেষ নাগাদ সে তহবিল ফুরাবে। মধ্য-মেয়াদি নির্বাচনের আগে সহায়তার আরেকটি বড় প্যাকেজ পাস করা সম্ভব হবে না, এমনটাই মনে করেন অধিকাংশ কংগ্রেস সদস্য। নির্বাচনের পর এ বরাদ্দ দিতে আইনপ্রণেতাদের রাজি করানো আরও কঠিন হতে পারে। রিপাবলিকান দলের একজন সিনেট সদস্য বলেছেন, ‘এ চেষ্টা হবে চড়াই উৎরানোর মতোই কঠিন’।
ইউক্রেনকে সহায়তা দানে কংগ্রেসকে রাজি করাতে বাইডেন যে উদার আহ্বান জানিয়েছিলেন, গেল ফেব্রুয়ারির আগ্রাসন পরবর্তী সময়ে তাতে ব্যাপক সাড়াও দেয় কংগ্রেস। এইবার রাশিয়াকে একহাত শায়েস্তা করা যাবে ভেবে উচ্ছ্বসিত হয়েছিলেন আইনপ্রণেতারা। তবে ওই আবেদন এখন আর কোনো কাজের নয়।
রিপাবলিকান ওই সিনেটর ইকোনমিস্টকে এমনটাই বলেন, ‘যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি আমূল বদলে যাওয়ায় এবং দেশের পরিস্থিতিতেও তার কালো ছায়া পড়ায় (প্রেসিডেন্টের) গত বারের ভাষণ এখন আবেদন হারিয়েছে’।
তবে মার্কিন নাগরিকরা সার্বিকভাবে এখনও চান, তাদের যতই অর্থনৈতিক মূল্য চুকাতে হোক—সরকার যেন ইউক্রেনকে দেওয়া সহায়তা অব্যাহত রাখে। চলতি মাসে দ্য ইকোনমিস্টের জন্য পরিচালিত জরিপ সংস্থা- ইউগভের সমীক্ষায় অংশ নেওয়া ৩৯ শতাংশ নাগরিক বাইডেন প্রশাসনকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে আরো কঠোর অবস্থান নেওয়ার পক্ষে মত দেন। একইসঙ্গে, অর্ধেকের বেশি মার্কিনী ইউক্রেনকে দেওয়া নানান রকম সহায়তাকে সমর্থন দিয়েছেন।
তবে রাজনৈতিকভাবে আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি বিভাজিতও তারা। ইউক্রেনকে সহায়তা দানের ক্ষেত্রেও ডেমোক্রেটদের চেয়ে বেশি উৎকণ্ঠা দেখা গেছে রিপাবলিকানদের মধ্যে। প্রতি পাঁচ জনের একজন রিপাবলিকান সমর্থক মনে করেন, বাইডেনের রাশিয়া-নীতি এতোটা কঠোর হওয়া উচিত নয়। তাদের ৪৩ শতাংশ ইউক্রেনকে আরো অর্থ বরাদ্দ দেওয়া সমর্থন করেন না। কিয়েভকে অত্যাধুনিক অস্ত্র দেওয়ার বিষয়েও তারা ডেমোক্রেটদের চেয়ে কম উৎসাহী।
এ বাস্তবতায় কংগ্রেসের কর্মকর্তারা তিনটি বিষয়ের ওপর ইউক্রেনকে সহায়তা দেওয়া নির্ভর করবে বলে উল্লেখ করেছেন। প্রথমত; মধ্য-মেয়াদি নির্বাচনের পর কংগ্রেসের গঠন। রিপাবলিকানরা যদি পার্লামেন্টের দুই কক্ষেই (সিনেট ও কংগ্রেস) সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে—তখন বিষয়টি নির্ভর করবে তাদের কোন গোষ্ঠী দলের নেতৃত্ব দিচ্ছে। বর্তমানে সিনেটে সংখ্যালঘু আইনপ্রণেতাদের নেতা মিচ ম্যাককনেল-ই যদি রিপাবলিকানদের নেতৃত্বে থাকেন—তাহলে কিয়েভের ভাগ্য ভালো।
কারণ, গত মে মাসেই সহকর্মীদের নিয়ে ইউক্রেন সফরে যান মিচ, সাক্ষাৎ করেন প্রেসিডেন্ট ভলোদমির জেলেনস্কির সাথে। কিন্তু, যদি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও তার ‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন’ (মাগা) বিশ্বাসের দৃঢ় সমর্থকরা যদি পার্লামেন্টে দলের নেতৃত্ব দেয়—তাহলে কী হবে? শেষোক্ত গোষ্ঠীটি কিন্ত আমেরিকার একান্ত ঘরের স্বার্থ নিয়েই বেশি উৎসাহী, বৈদেশিক সহায়তা দানকে তারা অর্থনীতির ওপর অনর্থক বোঝা বলেই মনে করে।
রিপাবলিকান দলের ওপর ডোনাল্ড ট্রাম্পের নিয়ন্ত্রণ এখনও বলিষ্ঠ। ইউক্রেনকে দেওয়া সাম্প্রতিক সহায়তার সমালোচনা করে ট্রাম্প বলেছেন, ‘ইউক্রেনকে আরো ৪০ বিলিয়ন ডলার দিচ্ছে ডেমোক্রেটরা, অথচ আমেরিকার অভিভাবকরা তাদের সন্তানের মুখে খাবার তুলে দিতে হিমশিম খাচ্ছে’।
২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেও প্রার্থী হতে চান সাবেক এ রাষ্ট্রপতি। আগামী সপ্তাহগুলোয় তার পেছনে জনসমর্থন আরো জোরালো হতে পারে। প্রতিনিধি পরিষদের ডেমোক্রেট আইনপ্রণেতা রুবেন গ্যালেগো এক টুইটে লিখেছেন, ‘২০২২ সালে রিপাবলিকানরা কংগ্রেসের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিলে ইউক্রেনকে দেওয়া মার্কিন সহায়তা বন্ধ হয়ে যাবে’। এতে করে, মার্জারি টেইলর গ্রিন ও ম্যাট গ্যায়েৎজ এর মতো ট্রাম্পবাদী রিপাবলিকান নেতারা ‘আমেরিকার ইউক্রেন নীতি নির্ধারণে প্রধান ভূমিকা’ রাখবে বলেও ভবিষ্যদ্বাণী দেন তিনি। পাল্টা টুইটে গ্যায়েৎজ লেখেন, ‘রুবেন ঠিকই বলেছেন’।
জর্জ ডব্লিউ বুশ প্রশাসনের সাবেক পেন্টাগন কর্মকর্তা ছিলেন এরিক এডেলম্যান। তার মতে, ‘এরকম সদম্ভ ঘোষণা নির্জলা স্বীকারোক্তিরই নামান্তর। তিনি বলেছেন, কংগ্রেসের রিপাবলিকান সদস্যদের মধ্যে ট্রাম্পের ‘মাগা নীতি’র সমর্থকরা এখনও সংখ্যালঘু। তবে নির্বাচনের পর তাদের সংখ্যা অনেকটা বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। হাউজে (কংগ্রেসে) তারাই যদি সংখ্যাগরিষ্ঠ রিপাবলিকান হয়ে ওঠে—তাহলে তারা যেখানে সরকারি খরচের বিল পাস হয়—সেই প্রাণকেন্দ্র নিয়ন্ত্রণ করবে। বিশেষত যদি ক্ষমতার ভারসাম্য তাদের পক্ষে ভারি হয়—তখন ইউক্রনকে আরো সহায়তা দেওয়াই কঠিন হয়ে উঠবে।
জেলেনস্কিকে ‘বর্তমান বিশ্বের চার্চিল’ বলে ভূয়সী প্রশংসা করেছেন কংগ্রেসে রিপাবলিকান দলের বর্তমান নেতা কেভিন ম্যাককার্থি। কিন্তু, ট্রাম্পের কট্টর ডানপন্থীদের সামনে তিনি স্রোতের মুখে খরকুটোর মতো ভেসে যাবেন বলেই ধারণা করছেন অধিকাংশ পর্যবেক্ষক। এক কথায়, ট্রাম্পবাদীদের উত্থান ঠেকাতে কার্যত তিনি অসহায়। দিনকে দিন বাড়তে থাকা মাগাবাদীদের তুষ্ট করার চাপ বাড়বে উচ্চকক্ষ সিনেটের ওপর (তা সে—ডেমোক্রেট বা মিচ ম্যাককনলের অনুগত রিপাবলিকানরা, যার হাতেই থাকুক সিনেটের নিয়ন্ত্রণ)।
এডেলম্যান মনে করেন, ইউক্রেন ইস্যু ‘রিপাবলিকান দলের প্রাণশক্তি কোন শিবিরের হাতে থাকবে- তা নির্ধারণের লড়াইয়ে রূপ নিবে’।
দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, রাশিয়াকে ঠেকাতে আমেরিকার মিত্ররা ইউক্রেনকে কতদূর পর্যন্ত সহায়তা দেবে—তা নিয়েও রয়েছে সন্দেহ। ক্রিস কুনস বলেন, ‘আমেরিকার ইউরোপীয় সহযোগীরা কতখানি করছে’—ইদানীং প্রথমেই আমাকে এ প্রশ্নের মুখে পড়তে হচ্ছে। তিনি উল্লেখ করেন যে, অধিকাংশ মার্কিনীর কাছে ইউক্রেন ‘অর্ধেক পৃথিবী দূরের’ এক বিষয়। তাদের দৃষ্টিতে, আমেরিকার চেয়ে মাথাব্যথা ইউরোপের বেশি হওয়া উচিত। কারণ রাশিয়া তাদের নিকটতম সামরিক হুমকি। যুদ্ধ বাঁধলে বিপদটাও তাদেরই বেশি। শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়াসহ, রাশিয়ান গ্যাস থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হওয়ার মতো হুমকি তাদের মোকাবিলা করতে হয়। ইউরোপের তাই আমেরিকার চেয়ে কম সহায়তা দেওয়াও সাজে না।
আমেরিকান আইনপ্রণেতাদের সিদ্ধান্তকে তৃতীয় যে বিষয়টি প্রভাবিত করবে তা হলো—রণাঙ্গনে ইউক্রেনের অগ্রগতি। বাইডেন প্রশাসন যদি দেখাতে পারে, সাহায্য নিয়ে ইউক্রেন নিজ ভূমি উদ্ধার করতে পারছে এবং আফগানিস্তানের পর আমেরিকা আরেকটি ‘অনন্ত’ ও ‘নিষ্ফল’ যুদ্ধে জড়াচ্ছে না—তাহলে সহায়তা পাসের জন্য দরকারি আইনি সমর্থন পাওয়া সহজ হবে। যদিও বাস্তবতা দেখাচ্ছে, যুদ্ধ আসলে দীর্ঘমেয়াদি রূপই নিয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে আমেরিকার সরবরাহ করা হিমার্স গাইডেড মিসাইল লঞ্চার দিয়ে রাশিয়ার বেশকিছু কম্যান্ড পোস্ট ও গোলাবারুদের ভাণ্ডার ধ্বংসে সফলতা পেয়েছে ইউক্রেন, তবে সার্বিকভাবে ইউক্রেনীয় সেনাদের কাছে রাশিয়ার মতো বিপুল অস্ত্র নেই, তাদেরকে আত্মরক্ষামূলক লড়াই-ই করতে হচ্ছে।
এদিকে, যুদ্ধে আমেরিকার লক্ষ্য কি কি—তাও কিন্তু বাইডেন স্পষ্ট করে বলেননি। তার প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা ইউক্রেনকে ‘জয়ের’ জন্য সাহায্য করা দরকার- এমন মন্তব্য বন্ধ করেছেন। এখন বলছেন দেশটির পরাজয় ঠেকাতে সাহায্য চালিয়ে যাওয়ার কথা। হিমার্সের মতো অত্যাধুনিক অস্ত্রও ছোট ছোট চালানে (প্রতি চালানে চারটি লঞ্চার সিস্টেম) পাঠাচ্ছে আমেরিকা। ইউক্রেনীয় সেনাদের অস্ত্রটি চালনায় প্রশিক্ষণ দিতে সময় লাগছে বলে যুক্তি দিচ্ছে বাইডেন প্রশাসন। একইসঙ্গে, রাশিয়ার সাথে সরাসরি সামরিক সংঘাত এবং তার পরিণতিতে পরমাণু যুদ্ধের যেন সূচনা না হয়- বাইডেনের জন্য সেটাও বড় মাথাব্যথার বিষয়। এজন্য তাকে আরো সতর্কভাবে সামরিক সহায়তা দিতে হচ্ছে। হিমার্স দিয়ে নানান পাল্লার (রেঞ্জ) রকেট নিক্ষেপ করা যায়, সর্বোচ্চ পাল্লা ৩০০ কিলোমিটার। অবশ্য, রুশ ভূখণ্ডে ইউক্রেনীয়রা আমেরিকান অস্ত্র দিয়ে হামলা চালাতে পারে এই শঙ্কা থেকে কেবল ৮৪ কিলোমিটার পাল্লার রকেট সরবরাহের কথা জানিয়েছে ওয়াশিংটন।
কিন্তু, অনেক মার্কিনীর মনে করেন যে, এ যুদ্ধে জয় অসম্ভব। তারা বলছেন, একটি কূটনৈতিক সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া উচিত বাইডেনের। অন্যদিকে, ইউক্রেনের সমর্থক মার্কিনীরা প্রেসিডেন্টের প্রতি আরো দ্রুত অস্ত্র সহায়তা দিয়ে, কিয়েভের জয় সুনিশ্চিত করার আহ্বান জানাচ্ছেন। তারা আরো ঝুঁকি নিতেও বলছেন।
এডেলম্যান বলেন, ‘বাইডেন প্রশাসন হয়তো যুদ্ধে একটি স্থিতবস্থা চাইছে। কিন্তু, এতে করে তারা যুদ্ধের ময়দানে তো হারবেই, একইসঙ্গে আমেরিকায় জনমত বিজয়ের যুদ্ধেও হারতে চলেছে।’
এসডব্লিউ/এসএস/১৫০০
আপনার মতামত জানানঃ