মিয়ানমারের বিরুদ্ধে রোহিঙ্গা গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে গাম্বিয়া যে মামলা করেছে, সে বিষয়ে নেপিডোর প্রাথমিক আপত্তি খারিজ করে দিয়েছেন আন্তর্জাতিক আদালত (আইসিজে)। আজ শুক্রবার নেদারল্যান্ডসের দ্য হেগে এই রায় দেওয়া হয়। এর মধ্য দিয়ে গণহত্যার মূল মামলার শুনানির পথ উন্মোচিত হলো।
মিয়ানমারের সামরিক সরকার দেশটিতে ক্ষমতা দখলের পর ওই মামলার শুনানি প্রশ্নে তাদের প্রাথমিক আপত্তি জানায়। গত ২১ ফেব্রুয়ারি মিয়ানমারের প্রাথমিক আপত্তির ওপর শুনানি শুরু হয়। ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মোট ৪ দিন বিষয়টির ওপর আদালত উভয় পক্ষের যুক্তি–পাল্টাযুক্তি শোনেন।
ওই সময় আদালতের শুনানিতে মিয়ানমারের প্রতিনিধিত্ব করেন আন্তর্জাতিক সহযোগিতাবিষয়ক মন্ত্রী কো কো হ্ল্যাং। তিনি দাবি করেন, গণহত্যার অভিযোগ শুনানির এখতিয়ার আদালতের নেই। মিয়ানমার গণহত্যা সনদের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ বলে তার ফৌজদারি আইন সংশোধন করে গণহত্যাকে অপরাধ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছে বলে জানান হ্ল্যাং। তিনি বলেন, গাম্বিয়া আদালতের বাইরে আগেই বিশ্ববাসীকে বিশ্বাস করাতে চায় যে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ গণহত্যাকারী।
মিয়ানমারের উত্থাপন করা আপত্তিগুলোর মধ্যে প্রধানত যে বিষয়গুলোতে জোর দেওয়া হয়, সেগুলো হচ্ছে আদালতের এখতিয়ার; ইসলামি সম্মেলন সংস্থার (ওআইসি) প্রতিভূ হিসেবে গাম্বিয়ার মামলা দায়ের, যার সুযোগ গণহত্যা সনদে নেই; গাম্বিয়ার কোনো নাগরিক সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত না হওয়ায় দেশটির সংক্ষুব্ধ হিসেবে নিজেকে দাবি করতে না পারা এবং দ্বিপক্ষীয় ভিত্তিতে বিরোধ নিষ্পত্তির চেষ্টা না করেই আদালতের শরণাপন্ন হতে না পারা।
গাম্বিয়া মিয়ানমারের আপত্তিগুলোর জবাবে দাবি করে, দুই বছর আগেই আদালত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে সুরক্ষা দেওয়ার অন্তর্বর্তী আদেশ জারির সময় আদালতের এখতিয়ার ও গাম্বিয়ার মামলা করার অধিকারের প্রশ্নগুলো নিষ্পত্তি করেছেন।
মিয়ানমার মূলত সময়ক্ষেপণের চেষ্টা করছে ও সময়ক্ষেপণের কারণে রোহিঙ্গাদের জীবন আরও বিপন্ন হয়ে পড়ছে দাবি করে গাম্বিয়া প্রাথমিক আপত্তির আবেদন নাকচ করে দিয়ে দ্রুত মূল মামলার শুনানি করার আবেদন জানায়।
গাম্বিয়ার প্রতিনিধি দেশটির আইনমন্ত্রী ও অ্যাটর্নি জেনারেল দাওদা জালো গাম্বিয়া ওআইসি বা অন্য কারও প্রতিভূ হিসেবে নয় দাবি করে বলেন, গণহত্যা সনদে স্বাক্ষরকারী হিসেবে নিজের দায়িত্ববোধ থেকেই তার দেশ মামলা করেছে।
এর আগে চলতি বছর মার্চ মাসে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর দেশটির সেনাবাহিনীর চালানো সহিংসতাকে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ বলে স্বীকৃতি দেয় যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন এ ঘোষণা দেন।
অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন বলেন, হলোকাস্ট (দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইহুদিদের ওপর গণহত্যা) ছাড়াও বিশ্বে সাতটি গণহত্যার ঘটনা ঘটেছে। আজ অষ্টম গণহত্যার স্বীকৃতি দেওয়া হলো। কারণ, সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সদস্যরা গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করেছেন বলে আমি সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্লিঙ্কেন গত বছরের ডিসেম্বরে মালয়েশিয়া সফরের সময় বলেছিলেন, রোহিঙ্গাদের প্রতি মিয়ানমারের আচরণ গণহত্যা কি না, তা খুবই সক্রিয়ভাবে খতিয়ে দেখছে যুক্তরাষ্ট্র।
২০১৭ সালে মিয়ানমারের রাখাইনে সেনাবাহিনীর নৃশংস দমন-পীড়ন, জ্বালাও–পোড়াওয়ের মুখে লাখো রোহিঙ্গা মুসলিম প্রাণ বাঁচাতে সেই দেশ থেকে পালিয়ে প্রতিবেশী বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়।
রোহিঙ্গা গণহত্যার অভিযোগে নেদারল্যান্ডসের দ্য হেগে অবস্থিত জাতিসংঘের সর্বোচ্চ আদালতে মামলা চলছে। দ্য হেগের আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) ২০১৯ সালে মামলাটির প্রাথমিক শুনানি শুরু হয়েছে। মিয়ানমারের বিরুদ্ধে ২০১৯ সালের নভেম্বরে আইসিজেতে মামলাটি করে আফ্রিকার দেশ গাম্বিয়া।
জাতিসংঘের একটি ‘ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং মিশন’ ২০১৮ সালে এই উপসংহারে পৌঁছায় যে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সামরিক অভিযানে ‘গণহত্যামূলক কাজ’ অন্তর্ভুক্ত ছিল। তবে তখন ওয়াশিংটন এই নৃশংসতাকে ‘জাতিগত নির্মূল’ হিসেবে অভিহিত করেছিল। আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনে এই শব্দবন্ধের কোনো সংজ্ঞা নেই।
এসডব্লিউ/এসএস/০৮১০
আপনার মতামত জানানঃ