“সরাফত খুবই ক্ষমতাশালী। তিনি নাম্বার ওয়ান, অর্থ্যাৎ প্রধানমন্ত্রীর খুবই ঘনিষ্ঠ। তার সাথে সরাসরি যোগাযোগ আছে।”- চৌধুরী নাফিজ সরাফাতের ক্ষমতা বুঝতে তার ঘনিষ্ঠ একজন পর্যবেক্ষকের এই কথাটাই যথেষ্ট।
২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের প্রাক্বালে অর্থমন্ত্রীর ওপর প্রভাব খাটিয়ে তার কাছ থেকে রেইস অ্যাসেট ম্যনেজমেন্ট মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও “ক্লোজড এন্ড মিউচুয়াল ফান্ড” পরিচালনা অব্যাহত রাখার অনুমতি আদায় করে নেয়। এই সিদ্ধান্তের কারণে সরাফতের কোম্পানির বিশাল লাভ হয়েছে।
কেননা, তহবিলের মেয়াদ শেষ হয়ে এলে ক্লোজড এন্ড মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগকারীদের অর্থ ফেরত দেবার ক্ষেত্রে কোম্পানিটির সমস্যায় পড়ার শঙ্কা ছিল। কিন্তু এখন সেই ঝুঁকি থেকে রক্ষা পাওয়া ছাড়াও, উল্টো অব্যাহত কমিশন প্রাপ্তি নিশ্চিত হয়েছে। এই বিষয়ে একটি মামলা এখন হাইকোর্টে চলমান রয়েছে। রেইস ও বিএসইসি উভয়েই সেই মামলার বিবাদী।
দুর্নীতি আর রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় ক্ষমতার এমন এক চূড়ায় পৌঁছেছেন নাফিজ সরাফাত, যে তাকে স্পর্শ করা অসম্ভবের কাতারে পড়ছে। সবাই জানে তিনি দুর্নীতিবাজ, কিন্তু কেউ মুখ খুলছে না। তাকে নিয়ে আঁকা কার্টুনের জন্যই কার্টুনিস্ট কিশোর ও লেখক মুশতাক আহমেদকে, জেলে যেতে হয়েছিল। সেই চৌধুরী নাফিজ সরাফাতই আছেন দেশের ব্যাংক ব্যবস্থা ধ্বংসের মূলে। চলুন সাম্প্রতিক কিছু অপকর্মের বিস্তারিত জানা যাক।
নর্থ-সাউথ দখলের ষড়যন্ত্র
সাউথইস্ট ব্যাংক জবর দখলকারী আলমগীর কবির, ব্যাংক এবং শেয়ার মার্কেট খেকো চৌধুরী নাফিজ সরাফতের হিংসা-প্রতিহিংসার শিকার হয়েছেন বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বিপুল অবদান রাখা নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫ জন ট্রাস্টি বোর্ড সদস্য। প্রবীণ এবং সমাজে বহুল সম্মানিত এই মানুষগুলোর জামিন হওয়া তো দূরে থাক জেলহাজতে ডিভিশন পর্যন্ত হয়নি। উনারা যেন জামিন বা ডিভিশন কোন কিছুই না পান তার জন্য পদে পদে বাধা সৃষ্টি করা হয়েছে এবং হচ্ছে।
এই ষড়যন্ত্রের শিকড় খুঁড়ে দেখা যায় ২০২১ সালের ২৬ জুলাই বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের কাছে পাঠানো এক চিঠিতে বেসরকারি খাতের সাউথইস্ট ব্যাংক লিমিটেডের চেয়ারম্যান আলমগীর কবিরের বিরুদ্ধে অসংখ্য অভিযোগ তুলে ধরেছিলেন ব্যাংকটিরই পাঁচজন পরিচালক। তারা হলেন ব্যাংকটির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ও পরিচালক এম এ কাশেম, প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক আজিম উদ্দীন আহমেদ, দুলুমা আহমেদ, রেহানা রহমান এবং জ্যোৎস্না আরা কাশেম।
এদের মধ্যে এম এ কাশেম, আজিম উদ্দিন ও রেহানা রহমান তিনজনই নর্থ সাউথ বিশ্ব বিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। ব্যাংকের পরিচালকদের কাছ থেকে নজিরবিহীন এ ধরনের চিঠি পাবার পর বাংলাদেশ ব্যাংক এ বিষয়ে কিছুটা তদন্তও করে এবং এই তদন্ত সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়, ৯ নভেম্বরের দৈনিক বনিক বার্তায়, যেখানে উল্লেখ করা হয় “সাউথইস্ট ব্যাংকে অনিয়মের কারনে ১০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে।”
এবার আরও একটু পেছনে যাওয়া যাক, টানা ১৭ বছর সাউথইস্ট ব্যাংকের চেয়ারম্যানপদে দায়িত্ব পালন করছেন আলমগীর কবির। তার স্বেচ্ছাচারিতা, হরিলুট, জালিয়াতি, ব্যাপক দুর্নীতি এবং বিপুল পরিমাণ অর্থপাচার এই ব্যাংকটিকে ঝুকিঁর দিকে নিয়ে যায়। যে কারনে ৩০শে জুন ২০২১ প্রতিবাদ স্বরুপ ব্যাংকটির বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম) বয়কট করেন পাঁচ শেয়ারহোল্ডার ও প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক এমএ কাশেম, আজিম উদ্দিন আহমেদ, জুসনা আরা কাশেম, দুলুমা আহমেদ ও রেহানা রহমান।
আর এখান থেকেই সুত্রপাত হয় নর্থ সাউথের ট্রাস্ট বোর্ডের প্রভাবশালী এই তিন সদস্যেকে যে কোন মূল্যে অপরাধী প্রমান করে তাদের ব্যাংক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালক পদ শূন্য করে দেয়ার চক্রান্তের।
৩০শে জুন ২০২১ এমএ কাশেম, আজিম উদ্দিন আহমেদ, জুসনা আরা কাশেম, দুলুমা আহমেদ ও রেহানা রহমান সভা বর্জন করার কারনেই তারা বুঝতে পারে এই সকল ব্যক্তিরা বিপদের কারন হতে পারেন। সেই বিপদ আঁচ করেই তাদের ব্যবসায়ীক ক্যারিয়ার সম্পূর্ণ রুপে ধ্বংস করতে দুর্নীতিবাজ আলমগীর কবিরের সহায়তায় এগিয়ে আসে তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী নাফিজ সরাফত, যিনি আমাদের কাছে তার ব্যাংক খেয়ে ফেলা এ জাতীয় কার্যকলাপের জন্যে বেশ সুপরিচিত।
নাফিজ সরাফতের পরামর্শেই আলমগীর কবীর ব্যাংকের বোর্ডে মেজরিটি পাওয়ার জন্যে তিনজন নিজ ব্যক্তিকে ঢোকানোর পরিকল্পনা করেছিলেন। যার একজন আবার নাফিজের ছেলে চৌধুরী রাহিব সাফওয়ান সরাফত। কিন্তু বয়স কম ও অনভিজ্ঞ হওয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংক তার নিয়োগ নাকচ করে দেয়। আলমগীর কবীর বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালার কোন পরোয়া না করেই তার ছেলে রাইয়ান কবীর কে সাউথ ইস্ট ব্যাংকের পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেন (তিনি এই ব্যাংকের একজন কর্মী হিসেবে চাকুরী করেছিলেন)।
এই অপরাধী চক্র যেন অত্যন্ত সুকৌশলে সাউথ ইস্ট ব্যাংক ও নর্থ সাউথের পরিচালনা পর্ষদে স্থান করে নিতে পারে তারজন্যেই তাদের এত আয়োজন। ইতোমধ্যেই নাফিজের স্ত্রীকে সাউথ ইস্ট ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে অন্তরভুক্ত করা হয়েছে।
এত এত অভিযোগ থাকার পরেও আলমগীর কবীরের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থাই নেয়নি দুদক, বরং নাম সর্বস্ব এক প্রতিষ্ঠানের অপরিচিত ব্যক্তির বিভিন্ন প্রেস কনফারেন্স ও সাজানো মানব বন্ধন আমলে নিয়ে দেশের স্বনামধন্য কিছু ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে তারা ষড়যন্ত্র করেছে ও পরিকল্পনা মাফিক তাদের জেল হাজতে প্রেরন করেছে।
সুনির্দিষ্ট গোয়েন্দা সুত্রের ভিত্তিতে জানা গেছে চৌধুরী নাফিজ সরাফত ও আলমগীর কবিরের যোগসাজশেই নর্থ সাউথ বিশ্ব বিদ্যলয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের এই সদস্যদের হয়রানী ও গ্রেফতার করা হয়েছে, নাফিজ স্বয়ং বা তার মনোনীত প্রতিনিধিরাই যেন সাউথ ইস্ট ব্যাংক ও নর্থ সাউথের পরিচালনা পর্ষদে স্থান করে নিতে পারেন তার জন্যেই এত আয়োজন।
এদিকে, বারবার জামিন নাকচ হয়েছে নর্থ সাউথ বিশ্ব বিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও সাউথ ইস্ট ব্যাংক সহ দেশের বিভিন্ন স্বনামধন্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের পরিচালক এম এ কাশেম, বেনাজির আহমেদ, রেহানা রহমান ও মোহাম্মদ শাজাহানের।
উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে মানি লন্ডারিং মামলায় গত প্রায় ৩ মাস ধরে জেলে পুরে রাখা হয়েছে দেশের বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের পথিকৃত এই চার বয়স্ক স্বনামধন্য ব্যবসায়ীকে।
মানি লন্ডারিং এর অভিযোগ আনা হলেও এখনো পর্যন্ত তারা কোথায় টাকা পাচার করেছেন সে বিষয়ে কোন সুনির্দিষ্ট তথ্যই কোথাও প্রকাশ করেনি দুদক। এদিকে যে ব্যক্তির সংশ্লিষ্টতায় এতসব আয়োজন সাউথ ইস্ট ব্যাংকের চেয়ারম্যান আলমগীর কবিরের নিজ ও তার পুত্র রাইয়ান কবীরের সিংগাপুরে প্রায় ৪০ কোটি টাকা সমমূল্যের ফ্ল্যাট ও সেদেশে ব্যাবসায়ে ১৪ কোটি টাকার বিনিয়োগের তথ্য পাবার পরেও তাদের বিষয়ে দুদুক মুখ খুলতে নারাজ।
চৌধুরী নাফিজ সরাফতের পুত্রকাণ্ড
মাত্র ১৮ বছর ৭ মাস বয়সে বহুমুখী বিভিন্ন সেক্টরে ৫ বছরের অভিজ্ঞতা সমপন্ন এক বিস্ময় বালকের নাম রাহিব সাফওয়ান সারাফাত চৌধুরী। ইউনিক মেঘনাঘাট পাওয়ার লিমিটেডের” ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, রাহিবের জন্ম ১৭ই অক্টোবর ২০০৩। আর সে হিসেবে মাত্র ১৩ বছর বয়স থেকেই এই কিশোর সিংগেল ক্লিক আইটি সলিউশন লিঃ, এস ৪ নেস ডেভেলপমেন্টস লিঃ, কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, স্ট্র্যাটেজিক ইক্যুইটি ম্যানেজম্যান্ট লিঃ ও ইউনিক মেঘনাঘাট পাওয়ার লিমিটেড-এর মত প্রতিষ্ঠানের পরিচালক, এক্সিকিউটিভ কমিটি মেম্বার, অডিট কমিটির চেয়ারম্যান এসব পদে দায়িত্ব পালন করছেন।
এছাড়াও সম্প্রতি প্রতিষ্ঠিত সিডিনেট কমিউনিকেশনস এর ব্যবস্থাপনা পরিচালকও হয়েছেন তিনি! ৪ এপ্রিল ২০২২ এ নিবন্ধন করা সিডিনেট কমিউনিকেশন সাবমেরিন ক্যাবল অপারেটর হিসেবে অনুমোদন প্রাপ্ত প্রথম বেসরকারী প্রতিষ্ঠান।
রাহিবের অত্যন্ত প্রভাবশালী পিতা চৌধুরী নাফিস সরাফত, গতবছরের ২৩ ডিসেম্বর রাহিব’কে সাউথ ইস্ট ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য করতে বহু তৎপরতা চালান, কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের আপত্তির কারনে সফল হতে পারেননি।
দুর্নীতি-জালিয়াতিতে ডুবছে সাউথইস্ট ব্যাংক
২০০৪ সালে সাউথইস্ট ব্যাংকের দায়িত্ব নেন চৌধুরী নাফিজ সরাফতের সহযোগী আলমগীর কবীর। সাউথইস্ট ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, ১৯৯৫ সালে দেশের দ্বিতীয় প্রজন্মের বেসরকারি ব্যাংক হিসেবে সাউথইস্ট ব্যাংকের যাত্রা শুরু হয়। কোনও উদ্যোক্তা না হয়েও ২০০২ সালে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে যুক্ত হন পেশাদার হিসাববিদ আলমগীর কবির। ২০০৪ সালে তিনি চেয়ারম্যান পদে দায়িত্ব নিয়ে ১৭ বছর ধরে বিরতিহীন পদে আসীন তিনি। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ অনেক।
যাকে-তাকে ঋণ প্রদান, মেশিন কেনায় নয়-ছয়, টাকা পাচার, এমনকি ঋণ মওকুফ করেও পারসেন্টেজ নিয়েছেন চেয়ারম্যান আলমগীর কবির। শুধু তাই নয়, নিয়ম-বহির্ভূত নিজের ছেলেকে পর্ষদের পরিচালক নিয়োগ দিয়েছেন তিনি।
ছেলে রাইয়ান কবির ২০০৩ সালে সাউথইস্ট ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগে চাকরিতে নিযুক্ত হন। সেই ছেলেকেও বিভিন্ন অনিয়মের মাধ্যমে পরিচালক বানিয়েছেন আলমগীর কবির।
অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে ব্যাংকটি চললেও সাম্প্রতিক বছরে নানা অনিয়মে সংবাদের শিরোনাম হয়েছে ব্যাংকটি। স্বেচ্ছাচারিতা, হরিলুট, জালিয়াতি, দুর্নীতি এবং অর্থপাচারের মতো অভিযোগ চরম শঙ্কায় ফেলেছে হাজার হাজার গ্রাহকের আমানতকে।
বাংলাদেশ ব্যাংকে করা পরিচালনা পর্ষদের লিখিত অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, ব্যাংকটির চেয়ারম্যান আলমগীর কবিরের পরিবার নিয়ন্ত্রিত বে-লিজিং অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড (BLI) থেকে ২০২০ সালে ১৫ অক্টোবরে মুনিরুজ্জামান সাউথইস্ট ব্যাংকের পরিচালক হন। তার আগে সাউথইস্ট ব্যাংক বিএলআই’এর কোন ঋণ ছিল না। ওই বছরের ২৪ অক্টোবর বাংলাদেশ ব্যাংক এনওসি দেয়। কিন্তু সে সময় সাউথইস্ট ব্যাংক থেকে ২১০ কোটি টাকা ঋণ ছিল বিএলআই ক্যাপিটাল লি. এর, যা গুরুতর অপরাধ।
বর্তমানে বিএলআই এর ঋণ হিসেবে কর্পোরেট শাখায় ওডি হিসেবে ২০০ কোটি টাকা, যা দেড় থেকে পৌনে ২ শতাংশ হারে ৭৫ কোটি টাকা কলমানি হয়। সেখান থেকে প্লেসমেন্ট ও টার্ম ডিপোজিট হিসেবে সাড়ে ৪ শতাংশ হারে ১০০ কোটি টাকা রয়েছে। এই টার্ম ডিপোজিট প্রথমে ১ মাস ছিল, পরে তা ৩ মাস এবং আরও পরে ৬ মাসে রুপান্তর করা হয়। বিএলআই মূলত শুধু সুদই শোধ করছে এবং এই কোম্পানি মূল ঋণ শোধ করতে পারছে না। কিন্তু বিএলআই প্রতিষ্ঠানটি আলমগীর কবিরের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণে থাকায় ব্যাংক বিএলআই এর নিকট থেকে মূল ঋণ ফেরতের আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ না করে বেআইনিভাবে ক্রমাগত ঋণের মেয়াদ বৃদ্ধি করে আসছে।
আরও জানা যায়, সাউথইস্ট ব্যাংকের কল মানি’র ১৩০০ কোটি টাকা হতে শুধু বে-লিজিং এন্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড(বিএলআই) ঋণ পায়। অথচ বিএলআই-এর বর্তমানে মোট প্রায় ৪০০ কোটি টাকার ঋণ সাউথইস্ট ব্যাংকের ব্যালেন্স শিটে দেখানো হয় না বলেও অভিযোগ পর্ষদের। যা ব্যাংকিং খাতে এটি খুবই গুরুতর অপরাধ।
গত বছর ৮ জুলাই বিএলআই-কে আরও ১২ কোটি টাকা ঋণ দেয়া হয়। সাউথইস্ট ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধন ১ হাজার ১৮৮ কোটি টাকা, পরিচালক হিসেবে বিএলআই-এর অংশ ২.৩৫ শতাংশ। অর্থাৎ প্রায় ২৭ কোটি টাকা। আইন অনুযায়ী পরিচালক বিএলআই শুধুমাত্র ১৩.৫ কোটি টাকা ঋণ পাওয়ার যোগ্য। অথচ বিএলআই প্রায় ৪০০ কোটি টাকার ঋণ সুবিধা ভোগ করেছে।
জানা যায়, পাঁচ বছরে ঋণের বিপরীতে সুদ দিতে হবে না গ্রাহককে, এই বলে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করেন সাউথইস্ট ব্যাংকের চেয়ারম্যান আলমগীর কবির। তারপর ক্লায়েন্ট এর ঋণ এর “সুদ মুক্ত ব্লকড একাউন্ট” এ দিয়ে দেয়া হয়। এভাবে তিনি জাজ ভুঁইয়াকে ৩০০ কোটি টাকা, সুয়াদ গার্মেন্টকে ১৫ কোটি, ফাহমী নিটকে ৩০০ কোটি টাকা, কেয়া গ্রুপকে ৯০০ কোটি টাকা, মাহাবুব স্পিনিং কে ১৫০ কোটি টাকার ঋণ দিয়ে Single Borrower Exposer Limit cross করেছেন। তবে এই কারসাজির মাধ্যমে ঋণগ্রহীতাদের কাছ থেকে তিনি শত কোটি টাকা কমিশন নিয়েছেন বলে দাবি পর্ষদ সদস্যদের।
সাউথইস্ট ব্যাংকের বিভিন্ন শাখায় সাম্প্রতিক সময়ে ১৮৫টি ক্যাশ রিসাইক্লিং মেশিন (সিআরএম) স্থাপন করা হয়েছে। আরও ৩০০টি মেশিন আমদানির প্রক্রিয়াধীন। তবে এসব মেশিন কেনার নামে প্রকৃত মূল্যের অতিরিক্ত অর্থ ওভার ইনভয়েসিং এর মাধ্যমে বিদেশে পাচার হয়েছে। অর্থ পাচার দুভাবে হয়েছে। ওভার ইনভয়েসিং এর অতিরিক্ত টাকা আর এন্ড এন ট্রেড হোল্ডিং’কে ট্রান্সফার করা হয়েছে এবং তিন কোম্পানির কাছে এলসি করা হয়েছে, আর এই আর এন্ড এন ট্রেড হোল্ডিং এর মালিক আবার ওই আলমগীর কবিরের পুত্র রাইয়ান কবির এ বিষয়ে গত ২০২১ সালের ৯ই আগস্ট দ্যা বিজনেস পোস্ট Southeast Bank chairmanaccused of moneylaundering, corrupt শিরোনামে একটি প্রতিবেদনও প্রকাশ করে।
সম্প্রতি সিংগাপুরের মাইন্ড চ্যাম্পস স্কুলে রাইয়ান কবিরের ১৪ কোটি টাকা বিনিয়োগের তথ্যও আমাদের হাতে এসেছে।
পদ্মা ব্যাংক বাঁচাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের দুর্নীতি
‘বিদেশি বিনিয়োগ পেতে পদ্মা ব্যাংকের আর্থিক বিবরণী থেকে লোকসানের তথ্য গোপনে বাংলাদেশ ব্যাংকের সম্মতি’- চলতি বছরের জানুয়ারি মাসের এই সংবাদ শিরোনাম চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছিল ব্যাংক পাড়ায়। উদ্বেগ জানায় ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।
এমন সুবিধাকে ‘অনৈতিক ও প্রতারণামূলক’ আখ্যা দিয়ে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে টিআইবি জানায়, “এটি সামনের দিনে আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশ্বাসযোগ্যতার সমস্যাকে প্রকটতর করার পাশাপাশি বিদেশে সুনাম ক্ষুণ্ন করার ঝুঁকি তৈরি করবে।”
প্রসঙ্গত, লোকসানে ডুবে থাকা পদ্মা ব্যাংকের নাম ২০১৯ সালের ৩০ জানুয়ারির আগে ছিল ফারমার্স ব্যাংক। ২০১৩ সালে ব্যাংকটি চালুর পর থেকে চেয়ারম্যান ছিলেন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য, সাবেক আমলা মহীউদ্দীন খান আলমগীর।
তিন বছরের মধ্যে ঋণ কেলেঙ্কারিসহ নানা অনিয়মে ধুঁকতে থাকা ব্যাংকটিতে ২০১৬ সালে পর্যবেক্ষক বসিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। চাপের মুখে পরের বছর ফারমার্স ব্যাংকের চেয়ারম্যানের পদ ছাড়েন মহীউদ্দীন খান আলমগীর।
নতুন চেয়ারম্যান হন রেইস অ্যাসেট ম্যানেজেমেন্ট ও কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান চৌধুরী নাফিজ সরাফাত। এরপর ২০১৯ সালের ৩০ জানুয়ারি ফারমার্স ব্যাংক নাম পাল্টে পদ্মা ব্যাংক হয়।
ওই সময় পদ্মা ব্যাংককে উদ্ধার করতে ৭১৫ কোটি টাকার মূলধন জোগায় রাষ্ট্রায়ত্ত পাঁচটি ব্যাংক, যা ব্যাংকটির মোট মূলধনের ৬৬ শতাংশ।
তাতেও রেহাই হয়নি, টিকে থাকার জন্য ব্যাংকটি সরকারি ব্যাংকের আমানতের বিপরীতে শেয়ার ইস্যু করার অথবা সরকারি কোনো ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হওয়ার প্রস্তাব দেয় পদ্মা ব্যাংক।
টিআইবি সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলেছে, “সমস্যাকবলিত পদ্মা ব্যাংকের জন্য ৭০ কোটি ডলারের বিদেশি বিনিয়োগ আনতে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ডেলমর্গানের শর্তানুযায়ী ব্যাংকটির আর্থিক লোকসানের তথ্য হিসেব বিবরণী থেকে গোপন রেখে পৃথক হিসাব তৈরির ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংক সম্মতি দিয়েছে, পরবর্তী দশ বছরে যা ব্যাংকটির মুনাফা থেকে সমন্বয় করার কথা। দেশের ব্যাংকিং খাতে এমন অনৈতিক উদ্যোগ নজিরবিহীন।”
বিনিয়োগ আনতে ব্যাংকটির বার্ষিক আর্থিক প্রতিবেদন ‘স্বচ্ছ’ দেখাতেই পদ্মা ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংককে তথ্য গোপনের প্রস্তাব দিলে তা অনুমোদন করা হয় বলে একাধিক জাতীয় গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়।
নাফিজ সরাফাতের বিরুদ্ধে অভিযোগ
পদ্মা ব্যাংকের স্পন্সর শেয়ারহোল্ডার সংসদ সদস্য মহীউদ্দীন খান আলমগীর গত বছর ৭ মার্চ বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে চিঠি লিখে চৌধুরী নাফিজ সরাফাতের বিরুদ্ধে তার অভিযোগের কথা তুলে ধরে তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করেন। চিঠির অনুলিপি অর্থমন্ত্রী, অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব এবং বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনেও পাঠানো হয়।
সেখানে বলা হয়, ২০১৫ সালের ১ নভেম্বর, মহীউদ্দীন খান আলমগীর যখন ব্যাংকের চেয়ারম্যান, তখন তার ‘অনুপস্থিতিতে’ ফারমার্স ব্যাংক পর্ষদের এক বৈঠকে একটি অল্টারনেটিভ ইনভেস্টমেন্ট ফান্ডে ১০০ কোটি টাকার বিনিয়োগ অনুমোদন করা হয়। সেই বৈঠকের একটি বোর্ড মোমোর ফটোকপি সম্প্রতি হাতে পাওয়ার পর ওই বিনিয়োগের বিষয়টি জানতে পেরেছেন বলে মহীউদ্দীন খান আলমগীরের ভাষ্য।
তার চিঠিতে বলা হয়েছে, “আমি জানতে পেরেছি, চৌধুরী নাফিজ সরাফাত সে সময় অল্টারনেটিভ ইনভেস্টমেন্ট অব বাংলাদেশের চেয়ারম্যান/এমডি হিসেবে বিনিয়োগের ওই অর্থ নেন। তাতে আইনের ব্যত্যয় ঘটানো হয়, কারণ তিনি তখন ব্যাংকের একজন পরিচালক এবং আইন অনুযায়ী তিনি পরিচালক থাকা অবস্থায় ফারমার্স ব্যাংক থেকে কোনো তহবিল পেতে পারেন না।”
মহীউদ্দীন খান আলমগীরের অভিযোগ, ওই ঋণ অনুমোদন করা হয়েছিল তার অনুপস্থিতিতে, তাকে না জানিয়ে। চিঠিতে তিনি বলেছেন, সেই অল্টারনেটিভ ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড থেকে এ পর্যন্ত কোনো লভ্যাংশ পদ্মা ব্যাংককে ‘দেওয়া হয়নি’, মূল টাকাও তারা ‘ফেরত দেয়নি’।
এ বিষয়ে মহীউদ্দীন খান আলমগীর আরও বলেন, “এ ধরনের কাজের শাস্তি হওয়া উচিত। এখানে জনগণের টাকা লুট করা হয়েছে।”
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) ওয়েবসাইটে দেখা যায়, অল্টারনেটিভ ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড অব বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনায় আছে স্ট্রাটেজিক ইকুইটি ম্যানেজমেন্ট লিমিটেড। আর ট্রাস্টি হিসেবে আছে প্রিমিয়ার ব্যাংক লিমিটেড।
প্রিমিয়ার ব্যাংকের পর্ষদে একজন স্বতন্ত্র পরিচালক হিসেবে আছেন চৌধুরী জাফরউল্লাহ শারাফাত, যিনি পদ্মা ব্যাংকের চেয়ারম্যান নাফিজের বড় ভাই।
আমিন মোহাম্মদ হিলালীকে ফরমায়েশী গুম করিয়ে বিপাকে নাফিজ
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির কয়েকজন ট্রাস্ট বোর্ড সদস্যের বিরুদ্ধে পরিকল্পিত ৩০৩ কোটি টাকা আত্মসাতের দুর্নীতির মামলায় আশালয় হাউজিং এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিন মোহাম্মদ হিলালীর বিরুদ্ধেও ঘুষ প্রদানের অভিযোগ আনা হয়েছে, বিশ্বস্ত গোয়েন্দা সুত্রমতে জানতে পারা যায় এই ব্যক্তিকে দিয়ে জোরপূর্বক মিথ্যা স্বীকারোক্তি আদায়ের উদ্দ্যেশ্যে গত ১লা জুলাই রাজধানীর উত্তরা থেকে ব্যবসায়ী আমিন হিলালীকে জোর পূর্বক অপহরন করে রাষ্ট্রের বিশেষ একটি সংস্থা, যারা প্রায় ২ দিন তাকে অজ্ঞাতস্থানে আটকে রেখে বিভিন্ন ধরনের মিথ্যা-বানোয়াট স্বীকারোক্তি প্রদানে বাধ্য করে।
পরবর্তীতে বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশের পর প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অবঃ) তারিক সিদ্দিকীর তোপের মুখে পড়ে নাফিজ, এবং প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের হস্তক্ষেপে দ্রুত আমিন হিলালীকে ছেড়ে দেয়া হয়।
কিভাবে ১৯৯৯ সালে ANZ Grindlays এর সেল্স অফিসার নাফিজ সরাফত ২০০১ সালে এসসিবি এর হেড অফ প্রায়োরিটি ব্যাংকিং হয়ে গেলো আর ২০০৮ সালে থেকে রেইস ম্যানেজমেন্টে সাওয়ার হয়ে গ্রাস করতে থাকে একটার পর একটা দেশসেরা লাভজনক প্রতিষ্ঠান?
এসডব্লিউ/এসএস/১৩১০
আপনার মতামত জানানঃ