শুক্রবার স্থানীয় সময় সকালে নারা শহরে এক ট্রেন স্টেশনের কাছে নির্বাচনী পথসভায় বক্তৃতা দেওয়ার সময় পেছন থেকে গুলি করা হয় জাপানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ৬৭ বছর বয়সী শিনজো আবেকে।
গুলিবিদ্ধ আবে ঘটনাস্থলে লুটিয়ে পড়লে রক্তাক্ত অবস্থায় তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। কয়েক ঘণ্টা পর চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
আবে দুই দফায় জাপানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পাশাপাশি টানা সবচেয়ে বেশিদিন দেশটির প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। ২০২০ সালে স্বাস্থ্যগত কারণ দেখিয়ে প্রধানমন্ত্রীত্ব ছেড়ে দিলেও ক্ষমতাসীন লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টিতে (এলডিপি) তার প্রভাব বিদ্যমান ছিল। দলটির গুরুত্বপূর্ণ অংশ তার নিয়ন্ত্রণেই ছিল।
রাজনৈতিক কর্মসূচীতে যোগ দিতেই নারা শহরে গিয়েছিলেন তিনি। সেখানে বক্তৃতা দেওয়ার সময় গুলিবিদ্ধ হওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে মারা যান।
এনএইচকে জানিয়েছে, বক্তৃতার প্রায় মাঝামাঝি সময়ে আবেকে পেছন থেকে গুলি করা হয়, তিনি পড়ে যান আর রক্তপাত হতে থাকে। সেখানে থেকে দ্রুত তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়।
বিবিসি জানিয়েছে, আবে যে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন সেই নারা মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে একটি সংবাদ সম্মেলন শুরু হয়েছে।
সেখানে একজন চিকিৎসক জানিয়েছেন, আবে জাপানের স্থানীয় সময় শুক্রবার বিকাল ৫টা ৩ মিনিটে (০৮:০৩ জিএমটি) মারা গেছেন।
আবের ঘাড়ের ডান দিকে গুলি লেগেছিল আর তার আঘাত হৃদপিণ্ড পর্যন্ত গভীর ছিল বলে জানিয়েছেন তিনি। তবে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর শরীরে কোনো বুলেট পাওয়া যায়নি বলে নিশ্চিত করেছেন তিনি। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণেই দেশটির প্রভাবশালী এ রাজনীতিকের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।
নারা মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের ২০ জন পেশাদার চিকিৎসক তাকে বাঁচানোর প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন। প্রথমে ১০ জন চিকিৎসকের একটি দল চিকিৎসা শুরু করলেও পরে সংখ্যাটি দ্বিগুণ করা হয়।
আবে ২০২০ সালে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করলেও জাপানের ক্ষমতাসীন লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির রাজনীতিতে তার বড় প্রভাব রয়েছে। এই দলের বড় একটি অংশের নিয়ন্ত্রণ আবের হাতে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর শিনজো আবে ছিলেন সবচেয়ে কম বয়সী প্রধানমন্ত্রী। ২০০৬ সালে তিনি প্রথবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন।
২০১২ সালে তিনি আবারো প্রধানমন্ত্রী হন।
আবে ধনাঢ্য রাজনৈতিক পরিবার থেকে এসেছেন। তার বাবা ছিলেন জাপানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। এছাড়া তার এক দাদা জাপানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন।
যে কারণে হত্যা করা হয়
আবের আততায়ী তাৎসুইয়া ইয়ামাগামি নামের ৪১ বছর বয়সী এক ব্যক্তিকে ইতিমধ্যেই গ্রেপ্তার করেছে জাপান পুলিশ। ম্যারাথন জেরা করা হচ্ছে ৪১ বছর বয়সী নারা শহরের ওই বাসিন্দাকে। ইতিমধ্যেই প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীকে গুলি করে হত্যা করার কারণ জানিয়েছে ওই ধৃত ব্যক্তি। তার বাড়ি থেকে অনেক বিস্ফোরক পদার্থও উদ্ধার হয়েছে। জানা গিয়েছে, শিনজোকে গুলি করার জন্য নিজেই বন্দুক এবং গুলি তৈরি করেছিল সে।
জানা গিয়েছে, শটগান এবং গুলি বাড়িতেই বানিয়েছিল সে। ৪১ বছর বয়সী ওই ব্যক্তির বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে উদ্ধার হয়েছে একাধিক বিস্ফোরক পদার্থও।
প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীকে গুলি করার পর আততায়ী পালানোর চেষ্টা করেনি। বন্দুকটি নিজের কাছেই রেখেছিল। এরপর আবের নিরাপত্তারক্ষীরা অভিযুক্তকে ধরে ফেলে।
জাপানের পুলিশ জানিয়েছে, ধৃত ব্যক্তি শিনজো আবের উপর এই হামলার কারণও জানিয়েছে। কেন এভাবে হত্যা করা হয় জাপানের প্রাক্তন রাষ্ট্রনায়ককে?
জানা গিয়েছে, পুলিশি জেরায় নিজের দোষ স্বীকার করেছে আততায়ী। হামলাকারীর বক্তব্য, শিনজো আবের উপর অত্যন্ত অসন্তুষ্ট ছিল সে। তার জন্যই শিনজোকে হত্যা করার পরিকল্পনা করেছিল।
এক প্রত্যক্ষদর্শী বলেছেন, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীকে গুলি করার পর আততায়ী পালানোর চেষ্টা করেনি। বন্দুকটি নিজের কাছেই রেখেছিল। এরপর আবের নিরাপত্তারক্ষীরা অভিযুক্তকে ধরে ফেলে।
ঘটনাস্থলের একটি সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে, আততায়ীর পরণে ছিল ধূসর রংয়ের টিশার্ট এবং বেইজ ট্রাউজার। ঘটনার পর নিরাপত্তরক্ষীদের সঙ্গে ধস্তাধস্তিতে জড়িয়ে পড়ে সে।
সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জাপানের হান্টারস অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান বলেছেন, আততায়ী হামলার জন্য যে অস্ত্রটি ব্যবহার করেছে, তা একটি স্বয়ংক্রিয় বন্দুক। যদিও পুলিশ সেটি শটগান বলে চিহ্নিত করেছিল।
আরও এক প্রত্যক্ষদর্শী জানিয়েছেন, ঘটনাস্থল থেকে যে আওয়াজ শোনা গিয়েছিল তা শটগানের আওয়াজের সঙ্গে মেলে না। তাই পুলিশের দাবি নিয়ে ইতিমধ্যে উঠতে শুরু করেছে প্রশ্ন।
কঠোর অস্ত্র আইনের জাপানে আবের হত্যা কীভাবে
জাপানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের গুলিতে নিহত হওয়ার ঘটনা শোকাহত করেছে পুরো দেশটিকে। সিএনএনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জাপানে গোলাগুলির ঘটনার হার বিশ্বের মধ্যে সর্বনিম্ন। এর কারণ, দেশটির কঠোর অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ আইন। এরপরও দেশটিতে সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর হত্যার ঘটনা বিস্মিত করেছে সারা বিশ্বকেই।
জাপানে বন্দুক নিয়ে হামলার ঘটনা একেবারেই বিরল।
অস্ট্রেলিয়ার ইউনিভার্সিটি অব সিডনির স্কুল অব পাবলিক হেলথের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালে জাপানে গুলিতে নয়জনের মৃত্যু হয়। আর সে বছর যুক্তরাষ্ট্রে গুলিতে নিহতের সংখ্যা ছিল ৩৯ হাজার ৭৪০।
ইন্টারন্যাশনাল সিকিউরিটি ইন্ডাস্ট্রিয়াল কাউন্সিলের জাপানবিষয়ক পরিচালক ন্যান্সি স্নো বলেন, আবের এই গুলিতে নিহত হওয়ার ঘটনা জাপানকে অনেকটা পাল্টে দেবে।
স্নো সিএনএনকে বলেন, জাপানে গুলি করে হত্যার ঘটনা শুরু বিরল নয়, এটি সত্যিকার অর্থে সাংস্কৃতিকভাবেও সাদৃশ্যপূর্ণ নয়। আমাদের দেশে অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রে বন্দুকের যে সংস্কৃতি আছে, তা জাপানের সাধারণ মানুষ কল্পনাও করতে পারে না। এ সময়টায় বলার মতো কিছু নেই। আমি আসলে ভাষা হারিয়ে ফেলেছি।
পুলিশকে উদ্ধৃত করে জাপানের সম্প্রচারমাধ্যম এনএইচকের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, আবেকে যিনি গুলি করেছিলেন, তিনি চল্লিশোর্ধ এক ব্যক্তি। এ হামলায় ঘরে তৈরি একটি বন্দুক ব্যবহার করা হয়েছে।
জাপানের আগ্নেয়াস্ত্র আইন অনুযায়ী, জাপানে শুধু শটগান বিক্রির অনুমোদন আছে। ক্ষুদ্র অস্ত্র (রিভলবার, পিস্তল) রাখা এখানে আইনবিরুদ্ধ। এই আগ্নেয়াস্ত্র পাওয়ার প্রক্রিয়াও অত্যন্ত জটিল এবং দীর্ঘ। এ জন্য প্রচণ্ড ধৈর্যের প্রয়োজন।
অস্ত্র পেতে হলে জাপানে একজন সম্ভাব্য ক্রেতাকে দিনব্যাপী ক্লাসে অংশ নিতে হয়, লিখিত পরীক্ষায় পাস করতে হয়। তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের পরীক্ষা এবং মাদকের পরীক্ষা দিতে হয়। তার অতীত কর্মকাণ্ড খতিয়ে দেখা হয় ব্যাপকভাবে। আগে অপরাধের কোনো ঘটনায় জড়িত ছিলেন কি না, ব্যক্তিগত ঋণ আছে কি না, সংঘববদ্ধ কোনো অপরাধে সম্পৃক্ততা আছে কি না বা পরিবার ও বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কও এখানে খতিয়ে দেখা হয়।
অস্ত্রের নিবন্ধন পাওয়ার পর এর মালিককের অবশ্যই পুলিশের কাছে থেকে এ অস্ত্রের নিবন্ধন করতে হয়। এ অস্ত্র কোথায় রাখা হবে তা জানাতে হয়। একটি পৃথক এবং তালাবদ্ধ স্থানে এটি রাখতে হয়। প্রতিবছর অন্তত একবার এ অস্ত্র পুলিশকে দেখাতে হয়। অস্ত্রের নিবন্ধনের নবায়ন করতে প্রতি তিন বছর পর প্রশিক্ষণ নিতে হয় এবং পরীক্ষায় বসতে হয়।
এসব কঠোর নিয়মনীতির কারণে জাপানে ব্যক্তিগত অস্ত্রের মালিকের সংখ্যা খুব কম।
২০১৭ সালে সাড়ে ১২ কোটি মানুষের দেশটিতে মাত্র ৩ লাখ ৭৭ হাজার মানুষের নিবন্ধিত অস্ত্র ছিল। প্রতি ১০০ জনে এ সংখ্যা শূন্য দশমিক ২৫ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্রে এ হার প্রতি ১০০ জনে ১২৫। এ তথ্য জেনেভার গ্র্যাজুয়েট ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের ক্ষুদ্র অস্ত্রসংক্রান্ত জরিপের।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯২৬
আপনার মতামত জানানঃ