বিশ্ব আরও একটি মন্দা দেখবে কি না সে বিষয় নিয়ে জল্পনা-কল্পনা চলছে বেশ কিছুদিন যাবত। করোনা মহামারি কাটিয়ে যখন অর্থনীতি গতিশীল হয় তখনই রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়। ফলে বিশ্ব অর্থনীতির আকাশে মেঘ নেমে আসার শঙ্কা দেখছেন কেউ কেউ
এর মধ্যেই চরম মুদ্রাস্ফীতি বর্তমান বিশ্বের নতুন দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটি এশিয়ার দেশসহ বিশ্ব অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এই মুদ্রাস্ফীতি মোকাবিলা করতে যেখানে দেশগুলো হিমশিম খাচ্ছে, সেখানে যুক্তরাষ্ট্র এ নিয়ে কথা বলতে বা সমাধানে পদক্ষেপ গ্রহণে তেমন কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না।
ইউক্রেন সংকটের কারণে বিশ্বব্যাপী জ্বালানি, খাদ্য ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি চলমান পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে এবং এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রে চরম মুদ্রাস্ফীতি ঘটছে।
যুক্তরাষ্ট্রে মূল্যস্ফীতি বেড়ে গত ৪০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ হয়েছে। দেশটিতে লাফিয়ে বাড়ছে ভোগ্য পণ্যের দাম। ফলে বিশ্বের বড় অর্থনীতির দেশটিতে সংকট তৈরি হওয়ায় শঙ্কা দেখা দিয়েছে। কারণ এর প্রভাব বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়তে পারে। কমে যেতে পারে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি। করোনা মহামারিতে বিশ্ব অর্থনীতি সংকোচিত হয় চার দশমিক তিন শতাংশ।
সম্প্রতি নিউ ইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ডুডলি এক মতামতে সতর্ক করে বলেন, একটি মন্দা এখন কার্যত অনিবার্য। সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে আরেকটি সতর্কতা সংকেত হলো স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি মার্কিন ট্রেজারি বন্ডগুলোর ওপর নতুন নিয়ম আরোপ করা। যা বিনিয়োগকারীদের হতাশ করেছে।
ক্যাম্পবেল আর হার্ভে নামের একজন অর্থনীতিবিদ বলেন, ফেডের নীতির কারণে মন্দার ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে। যারা মনে করেন চলমান মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে ফেড ধীর গতিতে এগোচ্ছে তাদের সঙ্গেও একমত পোষণ করেন তিনি।
সম্প্রতি সিএনবিসির পক্ষ থেকে পরিচালিত একটি জরিপে ৮১ শতাংশ মার্কিন প্রাপ্তবয়স্করা জানিয়েছেন, তারা বিশ্বাস করেন চলতি বছরে মন্দার সম্ভাবনা রয়েছে।
এদিকে ইউক্রেনে হামলার পর রাশিয়ার ওপর একের পর এক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করছে পশ্চিমা বিশ্ব। রাশিয়ার জ্বালানি আমদানি নিষিদ্ধ করেছে বাইডেন প্রশাসন। ইউরোপীয় ইউনিয়নও একই পথে হাঁটছে। রাশিয়ারও সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য চালিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে অনেক দেশকে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। এতে বিশ্বজুড়ে জ্বালানিতে প্রভাব পড়েছে। এরই মধ্যে বিশ্বব্যাপী সংকট দেখা দিয়েছে। দেশে দেশে মূল্যস্ফীতি রেকর্ড ছুঁয়েছে। নাগরিকদের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে গেছে।
অন্যদিকে করোনা মহামারি থামতে চীনের কঠোর নীতি বিশ্ব অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলেছে। কারণ দেশটিতে এখনো লকডাউন, সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ অব্যাহত রয়েছে। এতে সরবরাহ ব্যবস্থায় ঘাটতি দেখা দিয়েছে।
এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের অল্প সময়ে অত্যধিক পরিমাণগত সহজকরণ, চীনের বিরুদ্ধে বাণিজ্যযুদ্ধ, বৈশ্বিক সাপ্লাই চেইনে ব্যাঘাতের মতো অযৌক্তিক নীতি অনুসরণের পাশাপাশি ইউক্রেন সংকট বৃদ্ধি এবং দেশের অভ্যন্তরে মহামারি মোকাবিলায় বিশাল পরিমাণে আর্থিক ভর্তুকি প্রদানের মতো বিষয়গুলোর কারণে পরিস্থিতি ধীরে ধীরে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে থাকে।
অর্ধশতাংশ পয়েন্টের রেকর্ড উত্থানসহ ফেডারেল রিজার্ভ এই বছর দুবার সুদের হার বাড়িয়েছে। উল্লেখ্য, ২০০০ সালের পর এই প্রথম এত বেশি পয়েন্ট বৃদ্ধি পেয়েছে। ফেডারেল রিজার্ভ ঘোষণা করেছে যে এটি জুন মাসে ব্যালেন্স শিট হ্রাস করা শুরু করবে। এসব পদক্ষেপ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে।
কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, এই মুদ্রাস্ফীতির দেশের মানচিত্র ছাড়িয়ে অন্য দেশকে প্রভাবিত করার আশঙ্কা রয়েছে। সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রে মুদ্রাস্ফীতি দ্রুতগতিতে বেড়ে চলেছে এবং এর কুফল ভোগ করছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া। ইতিমধ্যে এই অঞ্চলের অনেক দেশে মুদ্রাস্ফীতির হার নতুন রেকর্ড গড়েছে।
এপ্রিল মাসে লাওসে এই হার ৯ দশমিক ৯ শতাংশে পৌঁছায়, আর ইন্দোনেশিয়ায় পাঁচ বছরের সর্বোচ্চ মুদ্রাস্ফীতি ঘটে। মার্চ মাসে সিঙ্গাপুরের মুদ্রাস্ফীতির হার ৫ দশমিক ৪ শতাংশে পৌঁছায়, যা ১০ বছরে সর্বোচ্চ বৃদ্ধি এবং ১৪ বছরের সিপিআই রেকর্ডের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। আর থাইল্যান্ডে আগের বছরের তুলনায় মুদ্রাস্ফীতি প্রায় ৫ দশমিক ৭ শতাংশ বৃদ্ধি পায়।
এপ্রিল মাসে ৪ দশমিক ৯ শতাংশ বছর প্রতি সিপিআই বৃদ্ধির পরে ফিলিপাইন ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের পর সবচেয়ে ভয়াবহ মুদ্রাস্ফীতির শিকার হয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনা করলে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্য দেশগুলোর পরিস্থিতি তুলনামূলক ভালো মনে হতে পারে।
তবে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন যে মালয়েশিয়া, কম্বোডিয়া ও ভিয়েতনামে অদূর ভবিষ্যতে মুদ্রাস্ফীতি নতুন রেকর্ড গড়বে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো এই পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছে। তথ্যসেবা প্রতিষ্ঠান ফোকাস ইকোনমিকসের মতে, এই অঞ্চলের মুদ্রাস্ফীতির হার ফেব্রুয়ারিতে ছিল ৩ শতাংশ, যা মার্চে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ দশমিক ৫ শতাংশে।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বেশির ভাগ দেশই হচ্ছে উন্নয়নশীল দেশ, যেখানে সামগ্রিক জাতীয় ব্যয়ের অপেক্ষাকৃত বড় অংশ জুড়ে রয়েছে খাদ্যের জন্য বরাদ্দকৃত ব্যয়। এ বিষয়ে ব্যাংক অব আমেরিকা সিকিউরিটিজের আসিয়ান অর্থনীতিবিদ মোহাম্মদ ফয়েজ নাগুথা উল্লেখ করেন, মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির পাশাপাশি উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টির উচ্চ ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির হার স্বাভাবিকভাবেই দুঃসহ স্মৃতি মনে করিয়ে দিচ্ছে। ১৯৯৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রে সুদের হার বৃদ্ধি এবং ডলারের মূল্যবৃদ্ধির পরে এশিয়ার আর্থিক সংকট দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল।
বৈদেশিক মুদ্রা ও শেয়ারবাজারে ডমিনোদের মতো একের পর এক পতন ঘটতে থাকে। ইন্দোনেশিয়া ও থাইল্যান্ড সবচেয়ে মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। দুই বছরের মধ্যে তাদের জিডিপি যথাক্রমে ৮৩ দশমিক ৪ শতাংশ ও ৪০ শতাংশ হ্রাস পায়।
২০০৮ সালে মার্কিন মুলুকের সাবপ্রাইম মর্টগেজ সংকট সারা বিশ্বে আর্থিক সংকট তৈরি করে। এটি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর আর্থিক ব্যবস্থা আবারও নড়বড়ে করে দেয়। সিঙ্গাপুর স্ট্রেট সূচক ৪৫ শতাংশের বেশি কমে যায়।
একটানা ভয়াবহ দরপতনের পর ইন্দোনেশিয়ার শেয়ারবাজারের কার্যক্রম অনির্দিষ্টকালের জন্য বাধাগ্রস্ত হয়। ফিলিপাইনের ৮০ লাখের বেশি বিদেশী কর্মী চাকরিচ্যুতি এবং আয় হ্রাসের ঝুঁকির সম্মুখীন হয়। আর থাইল্যান্ডের প্রায় ১০ লাখ শ্রমিক বেকারত্বের দ্বারপ্রান্তে অবস্থান করে।
এখন ফেডারেল রিজার্ভের সুদের হার বৃদ্ধির ক্ষেত্রে অদূরদর্শিতা বিভিন্ন দিক থেকে আবারও উন্নয়নশীল দেশের অর্থনীতির ওপর চাপ সৃষ্টি করবে। প্রথমত, এই হার বৃদ্ধির ফলে অর্থায়ন ব্যয় আরও বৃদ্ধি পাবে এবং ক্যাপিটাল ফ্লাইটের সম্ভাবনা তৈরি হবে। উভয়ই উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনীতির মৌলিক বিষয়গুলোকে প্রভাবিত করবে এবং এসব দেশের কোভিড-পরবর্তী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের পথ জটিল করে দেবে।
দ্বিতীয়ত, মার্কিন ডলারের উচ্চমূল্য ঋণগ্রস্ত দেশগুলোর বোঝা আরও ভারী করবে, কারণ, অনুন্নত দেশের বৈদেশিক ঋণের অনুপাত সাধারণত বেশি থাকে। তৃতীয়ত, বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে ডলার সূচকের ক্রমবৃদ্ধি অন্যান্য মুদ্রার ওপর অবমূল্যায়ন চাপ সৃষ্টি করতে পারে। এভাবে অন্যান্য দেশে আরও বেশি মুদ্রাস্ফীতি ঘটতে পারে।
যেহেতু চরম মুদ্রাস্ফীতি উন্নয়নশীল দেশগুলোর ভয়াবহ দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রকে অবশ্যই এর দায় নিতে হবে এবং অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের পথ সুগম করতে নেতৃত্ব দিতে হবে। একই সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকে এই অভূতপূর্ব পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে এবং এর প্রভাব প্রশমিত করতে নিজেদের প্রস্তুত করার ব্যাপারে বিশেষভাবে সচেতন হতে হবে।
এসডব্লিউএসএস১৩৪০
আপনার মতামত জানানঃ