২০১৯ সালে, ‘ঢাকা ওয়াসার পানি শতভাগ সুপেয়’—ঢাকা ওয়াসার এমডির এমন দাবির প্রতিবাদে ওয়াসা ভবনের সামনে অবস্থান নেন মিজানুর রহমান। এমডির কাছে তার চাওয়া ছিল সামান্য; ওয়াসার পানি দিয়ে বানানো শরবত খেতে হবে তাকে।
সম্প্রতি আবারও পত্রিকায় তার নাম। কয়েক দিন আগে জুরাইনে মানুষের হাতে পুলিশের হেনস্তা হওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে তাকে ‘জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তুলে নিয়ে যায়’ শ্যামপুর থানা-পুলিশ। পুলিশ তুলে নিয়ে যাওয়ার পর ফিরে এসে অন্য সব ক্ষেত্রে যা হয়, তা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ঘটনা ঘটল তার ক্ষেত্রে।
আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা বলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কাউকে তুলে নিলে যদি অতি সৌভাগ্যবান কেউ হন, তবেই ফিরে আসতে পারেন তিনি। কিন্তু ফিরে আসা কাউকে আজ পর্যন্ত মুখ খুলতে দেখিনি আমরা। এর মধ্যে একটা বিরাট ব্যতিক্রম দেখলাম মিজানুর রহমান। তাকে তুলে নিয়ে যাওয়ার সময় থেকে শুরু করে পুলিশি হেফাজতে থাকা—পুরো সময়ের ঘটনার আদ্যোপান্ত বর্ণনা করেছেন তিনি।
পুলিশ যেনো এক বিভীষিকা
মিজানুরকে তুলে নিয়ে যাওয়ার কারণ আর মুক্ত হওয়ার পর ডেইলি স্টার বাংলায় তার পুলিশি হেফাজতে থাকার সময়ের যে বর্ণনা প্রকাশিত হয়েছে, সেটা বর্তমান বাংলাদেশের চিত্রকে তুলে ধরেছে।
জুরাইনে পুলিশের সার্জেন্টের ওপরে হামলার ঘটনায় পুলিশ একটি মামলা করে, যাতে তিনজনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা আরও ৪৫০ জনকে আসামি করা হয়। এটা নিয়ে মিডিয়ায় কথা বলেন মিজানুর এবং একটি ফেসবুক স্ট্যাটাসও দেন, যাতে তিনি লিখেছিলেন—‘দুটি ঘটনা ঘটবে বলা যায়। এক. মামলা-বাণিজ্য। দুই. মামলার ভয় দেখিয়ে ঘুষ-বাণিজ্য। এমন একটি রাষ্ট্রে বাস করছি, যেখানে এ ঘটনার নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু তদন্ত চাইব, সে অবস্থাও নেই।’
পুলিশের সঙ্গে সমস্যা হলে তো বটেই, এমনকি পুলিশের সঙ্গে বাগ্বিতণ্ডার জেরে শত শত অজ্ঞাতনামা আসামি রেখে পুলিশের মামলা করার চর্চা আমরা দেখেছি। আমরা দেখেছি, পুলিশের মামলা করার জন্য কোনো অপরাধের অভিযোগও দরকার নেই; অসত্য অভিযোগে পুলিশের মামলা-বাণিজ্য এবং ঘুষ-বাণিজ্য চলতে পারে। এমন মিথ্যা মামলা যা এখন পরিচিত ‘গায়েবি মামলা’ নামে, সেটা এই সরকারই চিনিয়েছে দেশের মানুষকে। এ ধরনের মামলার প্রধান ভুক্তভোগী সাধারণত বিরোধী দলের নেতা-কর্মীরা। আবার বাণিজ্যের উদ্দেশ্য সফল করতে নিজেরদের পছন্দমতো ব্যক্তিদেরও আসামি করে পুলিশ।
গায়েবি মামলা কত ভয়ানক হতে পারে, তা নিয়ে প্রথম আলোতে একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয় ২০১৮ সালে ডিসেম্বর মাসে। রিপোর্টের শিরোনাম ছিল ‘এক ভয়ংকর সেপ্টেম্বর!’ ২০১৮ সালের ওই মাসে নাশকতার মামলা হয়েছে ৫৭৮টি। প্রায় সব মামলার বাদী পুলিশ। এসব মামলার তথ্য বলছে, পুলিশের ওপর হামলা হয়েছে ৯০ বার। ওই মাসে উদ্ধার হয়েছে ১ হাজার ১৮৬টি ককটেল ও ৩৭০টি পেট্রলবোমা। প্রথম আলোর রিপোর্ট আরও বলছে, ‘আর এ বছরের সেপ্টেম্বরে শহরময় পুলিশের ওপর এত হামলা, সহিংসতা হলেও কিছুই টের পায়নি ঢাকা শহরের মানুষ। জীবনযাত্রা ছিল একদম স্বাভাবিক…এসব মামলায় বিএনপির কয়েক হাজার নেতা-কর্মীকে আসামি করা হয়েছে। এখন এই আসামিদের ধরতে “বিশেষ অভিযান” শুরু করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। ফলে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রচারণা শুরু হলেও বিএনপির নেতা-কর্মীরা পালিয়েই বেড়াচ্ছেন।’ রাষ্ট্রীয় থেকে সরকারি বাহিনীতে পরিণত হওয়া পুলিশ কত ভয়ানক হতে পারে, তার জলজ্যান্ত উদাহরণ এই রিপোর্ট।
এমনকি গ্রেপ্তারের পর অস্বীকার এই সরকারের আমলের এক নতুন সংস্কৃতি। সম্ভবত অস্বীকারের সময়ের কয়েক ঘণ্টা থেকে শুরু করে কয়েক দিন পুলিশ প্রশাসন সিদ্ধান্ত নেয় গ্রেপ্তার করা ব্যক্তিকে ঠিক কী করা হবে। টাকার বিনিময়ে ছাড়া হবে, মামলা দেওয়া হবে, গ্রেপ্তার দেখানো হবে, নাকি গুম করা হবে। এগুলো অনেকাংশেই নির্ভর করে ব্যক্তিটি কে তার ওপর এবং তাঁর রাজনৈতিক পরিচয় ও ওপরের নির্দেশের ওপর।
মিজানুর প্রাথমিকভাবে পুলিশের হাতে আটক হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি তার কন্যাকে ফোন করে জানাতে পেরেছিলেন। কিন্তু তার পরিবার যখন শ্যামপুর থানায় তার খোঁজ নিতে যায়, পুলিশ জানায় তারা মিজানুরকে গ্রেপ্তার করেনি। ঠিক তখনই ভীষণ রকম আতঙ্কিত হয়ে পড়েন তারা। এ দেশে পুলিশের গ্রেপ্তার অস্বীকারের অর্থ কী, তা ভালোই জানে মানুষ। তাঁর পরিবার তাঁর গ্রেপ্তার সম্পর্কে নিশ্চিত হন সাড়ে চার ঘণ্টা পর।
আমাদের সংবিধান এবং আইনে গ্রেপ্তারের স্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া আছে। সংবিধানের ৩৩ (২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তিকে গ্রেপ্তারের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তাকে আদালতে হাজির করতে হবে। আর গ্রেপ্তারের সময় ঠিক কোনো নিয়মপালন করতে হবে, সেটির বিষয়ে হাইকোর্টের স্পষ্ট নির্দেশনা আছে।
ফৌজদারি কার্যবিধির বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার (৫৪ ধারা) ও হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের ধারা (১৬৭ ধারা) নিয়ে রিটের রায়ে ২০১৬ সালেই আপিল বিভাগ স্পষ্টভাবে জানিয়েছিল, গ্রেপ্তারের সময় পুলিশ তাঁর পরিচয়পত্র দেখাতে বাধ্য থাকবে; গ্রেপ্তারের তিন ঘণ্টার মধ্যে তাঁর কারণ জানাতে হবে এবং গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তির নিকটাত্মীয়কে এক ঘণ্টার মধ্যে টেলিফোন বা বিশেষ বার্তাবাহকের মাধ্যমে জানাতে হবে ইত্যাদি। বাংলাদেশে এর একটিও পালন করা হয় কি না, তা বিচারের ভার আমি পাঠকের হাতেই ছেড়ে দিলাম।
মিজানুর থানা এবং ডিবি হেফাজতে থাকার সময় নানা রকম নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। তাকে গালিগালাজ করা হয়েছে, হুমকি দেওয়া হয়েছে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে বাধ্য করা হয়েছে, খাবার দূরে থাকুক পানি খেতে চাইলে তাকে রোজা রাখার উপদেশ দেওয়া হয়েছে। সর্বোপরি তাকে লাঠি দিয়ে পেটানো হয়েছে।
মিজানুরের ওপর যা হয়েছে, সেগুলো এ দেশে খুব স্বাভাবিক ঘটনা। কেউ এমনকি ভাবতে পারেন, তিনি সৌভাগ্যবান, তার ওপর তো কমই হয়েছে। ‘পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা, পালিয়ে বেড়াচ্ছেন বাদী’ শিরোনামে প্রথম আলোতে কয়েক দিন আগে প্রকাশিত একটি রিপোর্টে ভুক্তভোগী রাজীব করের ওপর পুলিশি হেফাজতে শারীরিক নির্যাতনের যে বর্ণনা পাওয়া যায়, সেটা এ রকম—পুলিশ প্রথমে তাকে ব্যাট দিয়ে পেটায়, বুট দিয়ে মুখ মাড়িয়ে দেয় ও প্লাস দিয়ে নখ তুলে নেয়। সবশেষে উলঙ্গ করে পুরুষাঙ্গে বৈদ্যুতিক শক দেয়। এক রাতে তিনি নির্যাতনে তিনবার জ্ঞান হারান।
পুলিশি নির্যাতন বলতে অনেকে শুধু শারীরিক নির্যাতন বলে মনে করেন, কিন্তু বাংলাদেশেরই নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন-২০১৩-এ নির্যাতনের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে-‘নির্যাতন’ অর্থ কষ্ট হয় এমন ধরনের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। মজার ব্যাপার, এমন একটি আইন সরকারকে জাতিসংঘের চাপে করতে হলেও এই আইনের আশ্রয় কেউ নিক, এটা সরকার কোনোভাবেই চায় না। নির্যাতনের শিকার রাজীব কর এই আইনে মামলা করে কীভাবে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন প্রথম আলোর রিপোর্টে কেউ সেই গল্প পড়লে শিউরে উঠবেন।
একজন ব্যক্তিকে তার সামাজিক প্রতিবাদ থেকে সরানোর জন্য যতগুলো পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে, তার মধ্যে সবচেয়ে ভয়ংকর পদক্ষেপটি হচ্ছে, সন্তানের নিরাপত্তা নিয়ে হুমকি দেওয়া। আর ব্যক্তিটি যদি হন কন্যাসন্তানের বাবা এবং নিরাপত্তার হুমকি যদি দেওয়া হয় তাঁর কন্যাসন্তানকে উদ্দেশ করে, তাহলে? আটক অবস্থায় মিজানুরকে বলা হয়েছিল, ‘এমন হলে আমার মেয়েদের সরকারি চাকরি হবে না। আর রাস্তাঘাটে চলাফেরার ক্ষেত্রে তাদের ঝুঁকির কথাও মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে।’ এই হলো আমাদের পুলিশ বাহিনী!
এ দেশে গত কয়েক বছরে কোনো নাগরিকের ওপর করা অন্যায়, অত্যাচারকে জায়েজ করতে সবচেয়ে বড় অজুহাত হিসেবে সামনে আনা হয়েছে তার রাজনৈতিক পরিচয়কে। পুলিশ, প্রশাসন বা সরকারদলীয় কর্মী-সমর্থকদের যেকোনো অন্যায় আচরণকে ন্যায্যতা দিতে অবলীলায় বলে দেওয়া হয় “ভুক্তভোগী তো জামায়াত, বিএনপি’র লোক”। যেন বিএনপি বা জামায়াতের কোনো কর্মীর ন্যূনতম কোনো অধিকার নেই। মানবাধিকার, আইনের শাসন, ন্যায়বিচার শব্দগুলো তাদের জন্য প্রযোজ্য নয়। তাদের সঙ্গে যাচ্ছেতাই করা যায়।
মিজানের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম কিছু হয়নি। থানায় হয়রানির মধ্যে তার অন্যতম ‘অপরাধ’ হিসেবে কিংবা নিজেদের অবৈধ কর্মকাণ্ড জায়েজ করতে ওসিকে আরেক পুলিশ অফিসার শোনান—‘স্যার ও তো বিএনপির কমিটির লোক’।
মত প্রকাশকে নিয়ন্ত্রণ
বাংলাদেশের মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতার অবস্থা কেমন, সেটি মোটামুটি সবাই জানি। বিশেষ করে ২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচনের পর নতুন নতুন আইন তৈরির মাধ্যমে সর্বত্র একটা ভয়ের সংস্কৃতি তৈরিতে সফল হয়েছে সরকার। তবে আন্তর্জাতিকভাবে নিজেকে কিছুটা গণতান্ত্রিক দেখানোর স্বার্থে কিছু কিছু নিয়ন্ত্রিত সমালোচনাও হজম করে সরকার, কিন্তু সেটি হতে হবে তার চৌহদ্দির মধ্যে।
এ বিষয়ে পুলিশের দেওয়া উপদেশ প্রসঙ্গে মিজান বলেন, ‘জাফর ইকবাল ও আনু মুহাম্মদ স্যারের উদাহরণ দিয়ে আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করা হয় যে জ্ঞানীরা এত কথা বলে না। সমালোচনা করতে হয় দায়িত্বের সঙ্গে, ইত্যাদি।’
ছেড়ে দেওয়ার আগে মিজানুরকে সতর্ক করা হয়েছিল সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার ব্যাপারে। তাকে বলা হয়, ‘এই যে থানা থেকে এখান পর্যন্ত এত কিছু হলো, এগুলো কাউরে না বলাই ভালো। সাংবাদিকেরা নানাভাবে প্রশ্ন করবে।’ সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলায় সমস্যা কী হতে পারে, সেটাও বলে দেওয়া হয়েছে তার পরিবারের সদস্যদের, ‘আমরা তো ওনাকে সবার সামনে দিয়ে নিয়ে আসছি। যদি গোপনে ধরে নিয়ে যাই, কাকপক্ষীও টের পাবে না, তখন কী করবেন?’
এসডব্লিউ/এসএস/১০২০
আপনার মতামত জানানঃ