আমরা যে সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন দেখেছিলাম সেই সমাজতন্ত্র সংসদীয় সমাজতন্ত্র না। সে সমাজতন্ত্র মানুষের ঐকমত্য গড়ে তুলে মানুষের মধ্যে সমতা সৃষ্টির সমাজতন্ত্র। সেটাও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ছাড়া সম্ভব না।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) অষ্টম জাতীয় সম্মেলনে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে এ কথা বলেন অর্থনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা আকবর আলি খান ।
আজ শনিবার(১৮ জুন) দুপুরে কাকরাইলের ইনস্টিটিউট অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্সের মাল্টিপারপাস মিলনায়তনে এ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
আকবর আলি খান বলেছেন, ‘দেশে গণতন্ত্র, সুশাসন, আইনের শাসন, স্বাধীনতা ও জনসাধারণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হলে সাধারণ মানুষের পাশাপাশি প্রত্যেকটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানকে সাহসী ভূমিকা পালন করতে হবে।’ ক্ষমতা একজনের হাতে কুক্ষিগত হওয়টাকে জনগণের অধিকার রক্ষায় বড় বাধা বলেও উল্লেখ করেছেন তিনি।
বাংলাদেশের অস্তিত্বের নির্যাস হচ্ছে গণতন্ত্র উল্লেখ করে আকবর আলি খান বলেন, ‘বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদ গণতান্ত্রিক ধারায় গড়ে উঠেছে। গণতন্ত্রের মাধ্যমেই আমাদের জাতীয়তাবাদের বিকাশ। বাংলাদেশে গণতন্ত্র দরকার সেটাও এই জাতীয়তাবাদই ব্যক্ত করে। আমরা বলছি, একটা ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ গড়ে তুলতে চাই। যে দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নাই সেখানে সংখ্যালঘুদের অধিকার ভূলুণ্ঠিত হয়ে যায়। তাই গণতন্ত্র ছাড়া ধর্মনিরপেক্ষতা গড়ে তোলা সম্ভব না। আর সবশেষে আমরা যে সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন দেখেছিলাম সেই সমাজতন্ত্র সংসদীয় সমাজতন্ত্র না। সে সমাজতন্ত্র মানুষের ঐকমত্য গড়ে তুলে মানুষের মধ্যে সমতা সৃষ্টির সমাজতন্ত্র। সেটাও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ছাড়া সম্ভব না।’
পৃথিবীর সর্বত্র গণতন্ত্র অনেক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে জানিয়ে সাবেক এ আমলা বলেন, ‘কোথাও কোথাও কিছু চ্যালেঞ্জ উত্তরণ করা গেছে, আবার কিছু চ্যালেঞ্জ উত্তরণ করা যাচ্ছে না। এর মধ্যে বাংলাদেশ দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে।’
আকবর আলি খান বলেন, ‘বাংলাদেশের গণতন্ত্রের প্রথম চ্যালেঞ্জ হলো, বাংলাদেশে যে সরকার প্রতিষ্ঠিত হয় সেই সরকার ভোটের সংখ্যাধিক্যের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু ভোটের সংখ্যাধিক্য মানে জনগণের মধ্যে সংখ্যাধিক্য না। এবং সে জন্য পৃথিবীর অনেক দেশে সিম্পল মেজরটির বদলে প্রপোরশনাল মেজরিটির ওপরে জোর দেওয়া হয়।’
ক্ষমতা একজনের হাতে কুক্ষিগত হওয়টা জনগণের অধিকার রক্ষায় বড় বাধা।
অনেক দেশেই দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদীয়পদ্ধতি চালু আছে উল্লেখ করে আকবর আলি খান বলেন, ‘দুই কক্ষের সংসদ থাকলে দ্বিতীয় কক্ষের যে নির্বাচনী পদ্ধতি তা প্রথম কক্ষের নির্বাচন পদ্ধতি থেকে ভিন্ন হয়। তার ফলে ভিন্ন মতের প্রতিফলন ঘটে। যেমন যুক্তরাষ্ট্রে সিনেট থাকার ফলে সেখানে হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে না। ভারতেও এ ধরনের দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ চালু আছে। দুর্ভাগ্যবশত বাংলাদেশে তা নেই।’
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এই উপদেষ্টা আরও বলেন, ‘বাংলাদেশে শুধু এক কক্ষবিশিষ্ট সংসদ আছে তা-ই নয় এখানে সমস্ত ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের ইতিহাস দেখলে দেখা যায়, এর ফলে সমস্ত ক্ষমতা একজনের হাতে কুক্ষিগত হয়ে যায়। আরও বড় সমস্যা হচ্ছে, দেশের যিনি পরিচালক হোন তিনিই আবার রাজনৈতিক দলেরও নেতা। সুতরাং তাকে দলের দিকেও দেখতে হয় এবং এর ফলে দেশের জনগণ মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।’
নির্বাচন প্রসঙ্গে আকবর আলি খান বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন পরিচালনা করতে পারছে কি না, সে ব্যাপারেও কথা আছে। আমাদের দেশে কেন এমন হচ্ছে? প্রতিবেশী ভারতে কিন্তু এমন সমস্যা নাই। তার কারণ হলো, ভারতে দুই কক্ষবিশিষ্ট সরকার আছে। কেন্দ্রীয় সরকার আর রাজ্য সরকার সব সময় একই দলের দখলে থাকে না। না থাকার ফলে কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্য সরকারের নির্বাচন প্রভাবমুক্ত করার চেষ্টা করে।’
নির্বাচন কমিশনের ভূমিকার সমালোচনা করে আকবর আলি খান বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনের আদেশ যদি কেউ না মানে তাহলে কমিশনের অবশ্যই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। ভারতের টিএন সেশন (প্রয়াত প্রধান নির্বাচন কমিশনার) কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে মামলা করেছিলেন তাঁর অধিকারের জন্য। তার তুলনায় আমাদের এখানে বলা হয়, এটা দুর্ভাগ্যজনক, আমরা কিছু করতে পারব না। সেই সাহস নাই। এই সাহসটাই হলো মূল কথা। ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের সমস্যা রয়েছে। শুধু ডিজিটালাইজেশনের মধ্য দিয়ে এই সমস্যার সমাধান করা যাবে না। সুশাসন, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। কিন্তু জনগণের মধ্য থেকে এসব দাবি না উঠলে ৫০ বছরেও এসব হবে না। জনগণই একমাত্র পারে দেশকে সংশোধন করতে। জনগণই পারে রাজনৈতিক দলকে নিয়ন্ত্রণ করতে। এথেন্সের এক মনীষী বলেছেন, যদি আমরা সুখী হতে চাই তাহলে আমাদের স্বাধীন হতে হবে, যদি আমরা স্বাধীন হতে চাই তাহলে সাহসী হতে হবে।’
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯০৪
আপনার মতামত জানানঃ