ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জে ইসলামের নবী মোহাম্মদকে নিয়ে কথিত কটূক্তিমূলক বিষয় সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করার অভিযোগে উজ্জ্বল রায় (২১) নামে এক যুবককে আটক করেছে পুলিশ। বুধবার (১৫ জুন) তাকে কারাগারে পাঠানো হয়।
আটক উজ্জ্বল রায় পীরগঞ্জ উপজেলার মছনন্দপুর গ্রামের নরেশের ছেলে।
পুলিশ সূত্রে জানা যায়, ১৩ জুন উজ্জ্বল চন্দ্র রায় তার জুই রায় নামে ফেসবুক আইডি থেকে ইসলামের নবী মোহাম্মদকে নিয়ে কথিত কটূক্তিমূলক বিষয় শেয়ার করেন। এতে এলাকাজুড়ে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। বিষয়টি এলাকায় জানাজানি হলে চাপোড় বাজারে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। পরে ওই যুবককে আটক করে পীরগঞ্জ থানা পুলিশ। বুধবার তাকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়।
ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে পীরগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জাহাঙ্গীর হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, ‘হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে কটূক্তি করার প্রতিবাদে সারা দেশে বিক্ষোভ চলাকালীন গত সোমবার পীরগঞ্জ উপজেলার উজ্জল চন্দ্র রায় তার জুই রায় নামের ফেসবুক আইডি থেকে নবীকে নিয়ে কটূক্তিমূলক পোস্ট করে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেন।
‘এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে পরদিন মঙ্গলবার উপজেলার চাপোড় বাজারে উত্তেজনা তৈরি হয়। পরে ওই যুবককে আটক করে থানায় নিয়ে আসে পুলিশ। বুধবার তাকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়।’
এদিকে ইসলামের নবী মোহাম্মদকে নিয়ে কটূক্তির অভিযোগে গাইবান্ধায় সুলতান আরিফিন নামে এক ব্যক্তিকে আটক করেছে পুলিশ।
এবিষয়ে সুলতান আরিফিনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। বৃহস্পতিবার (১৬ জুন) দুপুরে সাদুল্লাপুর থানায় এ মামলা হয়।
মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করে সাদুল্লাপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার জানান, বাংলাদেশ দণ্ডবিধি আইনের ২৯৫ এর ক ধারা মোতাবেক ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানা ও বিশ্বাস ভঙ্গ করায় সুলতান আরিফিনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। বিকেলে আদালতের মাধ্যমে তাকে জেলা কারাগরে পাঠানো হবে।
স্থানীয়দের বরাত দিয়ে ওসি জানান, আটক সুলতান আরিফিন নলডাঙ্গা সোনার বাংলা বিদ্যাপিঠ নামে একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুলের পরিচালক। তার বাড়ি সাদুল্লাপুর উপজেলার নলডাঙ্গা ইউনিয়নের দশলিয়া গ্রামে।
আরিফিনের বিরুদ্ধে কথিত ইসলামবিরোধী নানা মন্তব্য করার অভিযোগ তোলে স্থানীয়রা। এ নিয়ে তারা ক্ষুব্ধ ছিলেন।
বুধবার দুপুরে স্থানীয় কয়েকজন মুসল্লি আরিফিনের সঙ্গে কথা বলতে তার বাসায় যান। তাদের সঙ্গে ফের তর্কে জড়ালে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। লোকজন তার বাড়ি ঘেরাও করেন। কিছু মানুষ স্থানীয় ডিগ্রি কলেজ সড়ক অবরোধ করেন। এক পর্যায়ে বন্ধ হয়ে যায় আশপাশের দোকানপাট ও যানবাহন চলাচল।
সাদুল্লাপুর থানার ওসি প্রদীপ কুমার সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘সুলতান আরিফিনকে তার বাসায় অবরুদ্ধ করে রেখেছিল বিক্ষুব্ধ জনতা। খবর পেয়ে তাকে উদ্ধার করে থানায় নিয়ে এসেছি। বর্তমানে সেখানকার পরিবেশ শান্ত রয়েছে।’
এদিকে নওগাঁর মহাদেবপুরে ইসলামের নবী মোহাম্মদকে নিয়ে ফেসবুকে কমেন্ট করায় পল্লব কুমার মহন্ত নামের এক কিশোরকে গ্রেপ্তার করেছে থানা পুলিশ। শনিবার(১১ জুন) দিনগত রাত সাড়ে ১২টার দিকে এলাকাবাসী তাকে আটক করে থানায় খবর দিলে পুলিশ গিয়ে রাত ২টার দিকে থানায় নিয়ে আসে।
বিষয়টিতে দেশের মানুষের বাকস্বাধীনতা বিশেষ করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের বাকস্বাধীনতা দিনেদিনে হুমকির মুখে পড়ে যাচ্ছে।
পুলিশ ও স্থানীয়রা জানান, গত দুদিন (১০ জুন) আগে পল্লব কুমার মহন্ত তার ফেসবুক আইডি থেকে নবী মুহাম্মদকে নিয়ে ফেসবুকে কমেন্ট করে। সেটি ফেসবুকে ভাইরাল হলে এলাকার ধর্মীয় অনুভূতিসম্পন্ন মুসল্লিরা ক্ষোভে ফেটে পড়েন। তারা পল্লব কুমার মহন্তকে গ্রেপ্তারের দাবিতে মিছিল বের করে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশে কয়েকদিন পরপরেই শোনা যায় কথিত ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের ঘটনা। ধর্মীয় অনুভূতির বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে আপেক্ষিক। এরপরেও যদি কেউ মনে করে যে কোন ঘটনা তার ধর্মীয় অনুভূতিকে আঘাত করেছে; তাহলে দেশের আইন আদালত সব আছে, তিনি আইনের দারস্থ হতে পারেন। কিন্তু গত কয়েকটি দশকে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের কথা বলে বিভিন্ন সময়ে কথিত অভিযুক্ত ব্যক্তিকে নির্মমভাবে আক্রমণসহ তার ঘরবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভাংচুরসহ অগ্নিসংযোগ করে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। বিষয়টিতে দেশের মানুষের বাকস্বাধীনতা বিশেষ করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের বাকস্বাধীনতা দিনেদিনে হুমকির মুখে পড়ে যাচ্ছে।
প্রচলিত আইনে অনুভূতির সংজ্ঞা এখনও অস্পষ্ট বলে, অনেক আইনজ্ঞদের মতামত দিতে দেখেছি বিভিন্ন সময়ে। ২৯৫ ধারায় জেল-জরিমানার কথা বলা হয়েছে। ২৯৫ এর ‘ক’ ধরার অপরাধ অজামিনযোগ্য। আইনজীবীরা বলছেন, ‘সাম্প্রতিক সময়ে এই আইনের প্রয়োগ হচ্ছে প্রতিপক্ষকে ‘হয়রানির হাতিয়ার’ হিসেবে’।
‘দণ্ডবিধির ২৯৫ এর ‘ক’ ধারা মতে, কোনও শ্রেণির ধর্মীয় বিশ্বাসকে অবমাননা করে ওই শ্রেণির ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার উদ্দেশ্যে দুরভিসন্ধিমূলক কাজ করা হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি দুই বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
ওই ধারায় আরও বলা হয়েছে, ম্যাজিস্ট্রেট মামলা আমলে নিতে পারবেন। আর এ ধারার অপরাধ জামিন-অযোগ্য।
বিশ্লেষকরা বলেন, কোন ধর্মীয় টেক্সটে যদি কোন বিষয়ের উল্লেখ থাকে, সে বিষয়টি নিয়ে লেখালেখি করলেও কি ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হবে? বিষয়গুলি আমাদের কাছে সুস্পষ্ট নয়। এ কারণেই সমস্যাগুলো দিনেদিনে জট পাকিয়ে যাচ্ছে। জ্ঞানের চর্চা করা মানুষের মধ্যে হতাশা তৈরি হচ্ছে। নারী, অমানবিকতা, বর্বরতা, নৃশংসতার নির্দেশনা যদি কোন ধর্মীয় টেক্সটে থাকে, এরপরেও সে বিষয়টি নিয়ে কথা বলা যাবে কি যাবে না তা আমাদের কাছে পরিস্কার না। আমরা দেখলাম বিষয়গুলোর উপরে একটি অলিখিত নিষেধাজ্ঞা আছে।
আমাদের দেশে বিগত বছরগুলোতে ধর্মীয় অনুভূতি বলতে কেবলমাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠের অনুভূতিতেই প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। আইনের প্রয়োগের ক্ষেত্রে একটা প্রচণ্ড একচোখা দৃষ্টিভঙ্গি দেখি। সংখ্যাগরিষ্ঠের পক্ষ থেকে যদি কারও নামে ধর্মীয় অনুভূতির অভিযোগ করা হয়, প্রতিটি ক্ষেত্রেই আমরা দেখেছি কথিত অভিযুক্ত ব্যক্তিটি অপরাধ করেছেন কি করেননি এটা যাচাই না করেই আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়েই তাকে সাথে সাথে গ্রেপ্তার করা হয়। অভিযুক্ত ব্যক্তিটি যদি সংখ্যালঘু বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের হয় তাহলে তো কোন কথাই নেই। বিষয়টি দিনে দিনে সংখ্যালঘুদের কাছে শ্বাসরুদ্ধকর হয়ে যাচ্ছে।
তারা বলেন, ‘দেশের সংবিধানে বাকস্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। পরবর্তী সময়ে ডিজিটাল অ্যাক্টসহ যেসব আইন হয়েছে, সেগুলো রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে যে বাকস্বাধীনতা ও গণতন্ত্র অর্জন করেছি, তার সঙ্গে সুস্পষ্টভাবে বিপরীতমুখী ও সাংঘর্ষিক। এগুলো বাকস্বাধীনতার পথকে সংকুচিত করেছে।’
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭৪১
আপনার মতামত জানানঃ