২০১৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত বিতর্কিত নির্বাচনে জয়লাভ করে ২০১৯ সালের ৭ই জানুয়ারি ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ তৃতীয় মেয়াদে সরকার গঠন করে। এর আগে ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয়েছিল একতরফা নির্বাচন।
পর পর দুটি জাতীয় নির্বাচন ত্রুটিপূর্ণ হওয়ায় আগামী জাতীয় নির্বাচন কেমন হবে সেটি এখন টক অব দ্য কান্ট্রি। এর মধ্যে টাঙ্গাইলের মধুপুরের অরণখোলা ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন ১৫ জুন। এ নির্বাচনে যাঁরা নৌকা মার্কায় ভোট দেবেন না, তাদের ভোটকেন্দ্রে আসতে নিষেধ করেছেন এক আওয়ামী লীগ নেতা।
অরণখোলা ইউনিয়নের আমলীতলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে গত বুধবার বিকেলে আয়োজিত এক নির্বাচনী সভায় সাদিকুল ইসলাম বক্তব্য দেওয়ার সময় ওই হুমকি দেন।
আওয়ামী লীগ মনোনীত চেয়ারম্যান প্রার্থী আবদুর রহিমের নির্বাচনী সভা ছিল সেটি। সাদিকুলের বক্তব্যটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে গত বৃহস্পতিবার রাতে ছড়িয়ে পড়ে।
ওই আওয়ামী লীগ নেতার নাম সাদিকুল ইসলাম। তিনি মধুপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও মির্জাবাড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান।
তবে ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে আসতে নিষেধ করার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন সাদিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘কেউ হয়তো এডিট করে এই ভিডিও দিয়েছে।’
সভায় উপস্থিত থাকা স্থানীয় একজন ব্যবসায়ী ও আওয়ামী লীগের কর্মী বলেন, সাদিকুলের বক্তব্যটি তারা অনুষ্ঠানস্থলে সরাসরি শুনেছেন। এমন কথা বলায় তারাও বিস্মিত।
ফেসবুকে সাদিকুলের বক্তব্যের পৃথক তিনটি ভিডিও ক্লিপ ফেসবুকে বিভিন্ন গ্রুপ ও ব্যক্তি শেয়ার করেছেন। একটি ভিডিও ক্লিপে দেখা যায়, সাদিকুল ইসলাম বক্তৃতায় বলছেন, ‘আমি আজকেও বলে দিতে চাই, ১৫ তারিখ ভোট হবে সারা দিন এবং নৌকা মার্কায় ভোট হবে। আপনারা ভোট দেবেন। যারা নৌকা মার্কায় ভোট দেবেন, তারাই কেন্দ্রে আসবেন। আর যারা নৌকায় ভোট দিতে নারাজ, দয়া করে কেন্দ্রে আসবেন না। আমরা কিন্তু আশপাশেই অবস্থান করব। এখানে ২৪০০ ভোট রয়েছেন, যদি দুই হাজার ভোট কাস্ট হয়, আমরা দুই হাজার ভোটই পেতে চাই।’
আরেকটি ভিডিও ক্লিপে দেখা যায় সাদিকুল ইসলাম বলছেন, ‘যেকোনো মূল্যে নৌকাকে আমাদের বিজয়ী করতেই হবে। এ জন্য আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, কৃষক লীগ, ছাত্রলীগ, মহিলা লীগের সর্বস্তরের নেতৃবৃন্দ আমরা প্রতিটি কেন্দ্রে দুর্গ গড়ে তুলব। যেখানে যা প্রয়োজন আমরা সেটাই ব্যবহার করব।’
সাদিকুল ইসলামের এই বক্তব্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেশ কয়েকজন ভোটার বলেন, এ রকম বক্তব্যের মাধ্যমে তিনি (সাদিকুল) সাধারণ ভোটারদের হুমকি দিচ্ছেন। এসব বক্তৃতা শুনে ভোটারদের মনে ভীতির সৃষ্টি হচ্ছে। বক্তব্যটির জন্য এই নেতার বিরুদ্ধে তারা ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন।
নির্বাচনে বিএনপি অংশ না নিলেও বিএনপি–সমর্থিত লস্কর আলী স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মোটরসাইকেল প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে অরণখোলা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক হাসান ইমাম আনারস প্রতীক নিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছিলেন। পরে দলীয় নেতাদের অনুরোধে তিনি নির্বাচন থেকে সরে যান।
বিএনপি–সমর্থিত চেয়ারম্যান প্রার্থী লস্কর আলী বলেন, এ ধরনের বক্তব্য দেওয়ায় জনমত তাঁর (লস্কর) দিকে আসছে। ভোটারদের এই হুমকি দেওয়ার জন্য তিনি কোথাও অভিযোগ করেননি বলে জানান।
মধুপুর উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা খন্দকার মোহাম্মদ আলী বলেন, বক্তৃতার বিষয়টি তিনি জানতে পেরেছেন। তবে এ বিষয়ে কেউ তাঁর কাছে কোনো অভিযোগ করেননি। অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এর আগে গত মাসের শেষ সপ্তাহে ভোটকেন্দ্রে ইভিএমের বাটন টিপতে না পারলে টিপে দেওয়ার জন্য নিজের লোক রাখবেন বলে প্রকাশ্যে ঘোষণা দেন আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান প্রার্থী মুজিবুল হক চৌধুরী। তিনি আরও বলেছেন, ইভিএম না থাকলে রাতেই সব ভোট নিয়ে ফেলতেন।
চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার চাম্বল ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) নৌকা প্রতীকের প্রার্থী বর্তমান চেয়ারম্যান মুজিবুল হক চৌধুরী নির্বাচনী সভায় এমন বক্তব্য দিয়েছেন। এ বক্তব্যের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে।
প্রায় ৪১ সেকেন্ডের ওই ভিডিওতে আওয়ামী লীগ প্রার্থী মুজিবুল হক চৌধুরী চট্টগ্রামের ভাষায় ভোটারদের উদ্দেশে হ্যান্ডমাইকে বলেন, ‘তো এখানে ইভিএম একটা করেছে সরকার। তো কী করতাম। একটু কষ্ট করে গিয়ে আঙুলে চাপ দিয়ে ভোট দিতে হবে। চাপ দিতে না পারলে চাপ দেওয়ার জন্য সেখানে আমি মানুষ রাখব। তো আমাকে একটু দোয়া করবেন সকলে।’
তিনি আরও বলেন, ‘রিকশা করে পারেন, যেভাবে পারেন ভোটটা দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। কারণ, ইভিএমের ভোট। ইভিএম না হলে আমি কাউকে খুঁজতাম না, ভোট আমি মেরে দিতাম। যেভাবে পারি ভোটটা মেরে দিতাম।’
মুজিবুল হক আরও বলেন, ‘ইভিএমে আইডি কার্ড ঢুকিয়ে দিতে হয়, নইলে হয় না। এটা না হলে আমি রাতেই নিয়ে ফেলতাম। তো আপনারা একটু কষ্ট করেন, আপনাদের একটু কষ্ট করে ওটা নিয়ে যেতে হবে। গিয়ে মেশিনে ফিঙ্গার দিতে হবে। কথা বুঝেননি?’
প্রসঙ্গত, ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় নির্বাচনের হিসাব দেখলে দেখা যাবে, মোট ৩০০ আসনের মধ্যে মাত্র ৭ টিতে জিততে দেয়া হয়েছিল বিরোধী দলকে। এদিকে, আগামী ২০ মাসের মধ্যে বাংলাদেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে আর এই নির্বাচন নিয়ে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার এই নির্বাচনকে কতখানি সুষ্ঠু ও স্বাধীন হতে দেবে এবং এতে জনগণের ইচ্ছা সঠিকভাবে প্রতিফলিত হবে কিনা।
গত ১৩ বছর ধরে বাংলাদেশে ক্ষমতায় আছে আওয়ামী লীগ। এর মধ্যে তিনটি জাতীয় নির্বাচন হয়েছে; ২০০৮, ২০১৩ এবং ২০১৮ সালে। ২০০৬ ও ২০০৭ এই দুই বছর সামরিক বাহিনী নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকার পর ২০০৮ সালে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় আর সেই নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। এবং ২০০৮ সালের সেই নির্বাচনই সর্বশেষ স্বাধীন ও সুষ্ঠু নির্বাচন হিসেবে স্বীকৃত। অর্থাৎ এরপরের দুইটি নির্বাচন পাতানো বলেই ধরে নেওয়া যায়।
এসডব্লিউ/এসএস/০৮১৫
আপনার মতামত জানানঃ