সীতাকুণ্ডে বিস্ফোরণের ঘটনায় দগ্ধরা অন্যান্য অগ্নিকাণ্ডে আহতদের মতো নন। আহতদের শরীরে বার্ন ও কেমিক্যাল ইনজুরি আছে। এর সঙ্গে স্মোক ইনহেলেশন (ধোঁয়ায় শ্বাসতন্ত্র দগ্ধ) হয়েছে।
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে কনটেইনার ডিপোতে বিস্ফোরণে আহতদের সবার শরীরেই কেমিক্যাল ইনজুরি আছে। এদের মধ্যে আটজনের অবস্থা সঙ্কটাপন্ন ও পাঁচজনের চোখের কর্ণিয়া মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানিয়েছে চিকিৎসকরা।
মঙ্গলবার চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, পার্কভিউ হাসপাতাল ও শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
উল্লেখ্য, চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোতে বিস্ফোরণে আহত ব্যক্তিদের ৬৩ জনের চোখ কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাঁদের ৬ জনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকার জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
প্রসঙ্গত, শনিবার রাতে সীতাকুণ্ডের সোনাইছড়ি ইউনিয়নের কেশবপুর এলাকায় বিএম কন্টেইনার ডিপোতে আগুন লাগার পর বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এতে নিহত হন ৪৩ (সরকারি হিসাব) জন। তাদের মধ্যে ফায়ার সার্ভিসের সদস্য রয়েছেন নয়জন। আহত হন প্রায় আড়াই শতাধিক মানুষ। ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্স জানিয়েছে, হাইড্রোজেন পার অক্সাইড ভর্তি কনটেইনার বিস্ফোরিত হয়ে এই হতাহতের ঘটনা ঘটেছে।
শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক আবুল কালাম বলেছেন, “সীতাকুণ্ডে বিস্ফোরণের ঘটনায় দগ্ধরা অন্যান্য অগ্নিকাণ্ডে আহতদের মতো নন। আহতদের শরীরে বার্ন ও কেমিক্যাল ইনজুরি আছে। এর সঙ্গে স্মোক ইনহেলেশন (ধোঁয়ায় শ্বাসতন্ত্র দগ্ধ) হয়েছে।”
“এই তিনটার সমন্বয়ে তারা যতটুকু দগ্ধ হয়েছে তারচেয়ে বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। কেউ হয়তো ১০ শতাংশ পুড়েছেন কিন্তু অসুস্থ হয়েছেন ৪০ শতাংশের মতো। ঢাকায় চিকিৎসাধীনদের মধ্যে আইসিইউতে আছেন ৩ জন; এদের মধ্যে একজন আছেন লাইফ সাপোর্টে। বাকিরা পোস্ট অপারেটিভ ইউনিটে আছেন। কিন্তু এদের কেউ শঙ্কামুক্ত নন।”
অন্যদিকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পরিদর্শনে এসে ন্যাশনাল আই কেয়ারের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক দীন মোহাম্মদ নুরুল হক জানিয়েছেন বিএম কনটেইনার ডিপোতে বিস্ফোরণে আহতদের সবার চোখেই কেমিক্যাল ইনজুরি হয়েছে। এদের মধ্যে ৬ জনকে জরুরীভাবে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় নিতে হবে।
তিনি বলেন, ”চমেকে চিকিৎসাধীন ৬৩ জন রোগী আমি দেখেছি। তারা কোনো না কোনোভাবে চোখে কেমিক্যালের ধোঁয়া ও আগুনের তাপে আঘাত পেয়েছেন। এখানে কিছু রোগী রয়েছেন তাদের চোখে বেশি ক্ষতি হয়েছে। একজনের অবস্থা খুবই খারাপ, তাকে দেশের বাইরেও নিয়ে যেতে হতে পারে। দুইজনের চোখের কর্ণিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বাকিরা কোনো না কোনোভাবে চোখে আঘাত পেয়েছেন।”
অধ্যাপক দীন মোহাম্মদ নুরুল হক বলেন, “আমরা জরুরী ভিত্তিতে ৬ জনকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার জন্য সুপারিশ করেছি। বাকিদেরও পর্যায়ক্রমে চোখের চিকিৎসার জন্য ঢাকায় নিয়ে যেতে হবে। যেসব রোগীর শরীরের অন্যান্য অঙ্গের অবস্থা খুবই খারাপ তাদের এখনই ঢাকা নেওয়া সম্ভব না।”
ইতোমধ্যে আহতদের মধ্যে যারা চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি গেছেন তাদেরও চক্ষু বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হওয়ার পরামর্শ এই প্রবীন চিকিৎসকের।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বার্ন ইউনিটের সহকারী রেজিস্ট্রার লিটন কুমার পালিত বলেন, “চিকিৎসাধীন ৬৩ জন রোগীর মধ্যে তিনজনের অবস্থা সঙ্কটাপন্ন। তাদের শ্বাসনালীসহ শরীরের ৭০ শতাংশের বেশি পুড়ে গেছে। তারা ইনফেকশনে আক্রান্ত বলে ধারণা করছি। এছাড়া শ্বাসনালী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আরও ১৪ জনের।”
চট্টগ্রামের বেসরকারি পার্ক ভিউ হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. রেজাউল করিম বলেন, “বর্তমানে আমাদের হাসপাতালে ১১ জন চিকিৎসাধীন আছেন। এর মধ্যে দুইজনের অবস্থা সঙ্কটাপন্ন, তাদের চোখের কর্ণিয়ায় আঘাত পেয়েছে। একজনকে আইসিইউতে রাখা হয়েছে। তার বেঁচে ফেরার সম্ভাবনা খুব কম।”
কানাডার সাচকাচুন বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়া ও জলবায়ু বিষয়ক গবেষক মোস্তফা কামাল পলাশ জানিয়েছেন, “ডিপোতে রাসায়নিক পদার্থের বিস্ফোরণ স্থলে হাইড্রোজেন পার অক্সাইড ছাড়া আর কোন রাসায়নিক পদার্থ ছিল কি না তা এখন পর্যন্ত নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তাই আহত শ্রমিকরা এসব কেমিক্যালে আক্রান্ত হয়েও থাকতে পারেন। রোগীদের চিকিৎসা দেওয়ার ক্ষেত্রে বিষয়টি বিশেষভাবে দেখতে হবে। এছাড়া বাতাসে ছড়িয়ে যাওয়া রাসায়নিক পদার্থের কারণে আশপাশের এলাকায় বসবাসরত মানুষের মাঝেও নানা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে।”
বিস্ফোরণে হতাহতের সামগ্রিক পরিস্থিতি তুলে ধরে সংবাদ সম্মেলনে চমেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম আহসান আহসান জানান, নিহত ব্যক্তিদের ২৬ জনের পরিচয় শনাক্ত করা গেছে।
তাদের মরদেহ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। বাকি মরদেহগুলো বর্তমানে ফ্রিজে সংরক্ষণ করা হয়েছে। তাঁদের পরিচয় শনাক্তে ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হচ্ছে।
শামীম আহসান বলেন, হাসপাতালে ২৩০ জন রোগী আহত অবস্থায় এসেছিলেন। তাঁদের মধ্যে ১৬৭ জন ভর্তি হন। বর্তমানে ভর্তি আছেন আছেন ৬৩ জন। নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) আছেন দুজন। এ ছাড়া চট্টগ্রামের জেনারেল হাসপাতালে একজন, পার্কভিউ হাসপাতালে ১২ জন ও চট্টগ্রামের সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) ভর্তি আছেন ১৪ জন।
এসডব্লিউ/এসএস/১৪৩৫
আপনার মতামত জানানঃ