ফেনীতে পার্কে অভিযান চালিয়ে আবারও শিক্ষার্থী হেনস্তার অভিযোগ উঠেছে পুলিশের বিরুদ্ধে। পার্কে আড্ডা দেয়ার সময় জেলার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ২৫ শিক্ষার্থীকে আটক করেছে পুলিশ। আটককৃতদের মধ্যে ১০ জন ছাত্র ও ১৫ জন ছাত্রী। রবিবার (২৯ মে) দুপুর ১২টার দিকে বিজয়সিং দিঘীর পড় পুলিশের স্পেশাল টিম তাদের আটক করেন।
সেখানে তাদের আটকে রাখার পর অভিভাবকদের ডেকে তাদের জিম্মায় দেওয়া হয়। আটক শিশু-কিশোরদের বেশিরভাগই শহরের বিভিন্ন স্কুল-কলেজের অষ্টম শ্রেণি থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণির শিক্ষার্থী। থানায় নেওয়ার পর তাদের লজ্জায় মুখ ঢাকতে দেখা গেছে। সামাজিক মর্যাদার ভয়ে তাদের চোখেমুখে ছিল ভীতি-আতঙ্ক।
আটক শিক্ষার্থীদের ভিডিও ধারণ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ায় এখনও জেলাজুড়ে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বইছে। অনেকেই এ নিয়ে প্রশ্ন তুলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে স্ট্যাটাস দিয়েছেন।
বিনোদন পার্ক থেকে পুলিশ দিয়ে আটক করে থানায় নিয়ে যাওয়ার ঘটনায় বেশির ভাগ শিক্ষার্থী এখনো ভীতসন্ত্রস্ত। থানা থেকে ছেড়ে দিলেও লোকলজ্জা ও অভিভাবকদের কাছে ছোট হওয়ায় এখনো তারা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত।
একজন শিক্ষার্থী বলে, তারা বিদ্যালয়ে মর্নিং শিফটের ক্লাস শেষে বন্ধুর সঙ্গে বিজয় সিংহ দীঘির পার্কে ঘুরতে যায়। উন্মুক্ত পার্কের গাছের ছায়ায় বসে তারা আইসক্রিম খাচ্ছিল। স্কুলের পোশাক দেখে সেখান থেকে তাদের আটক করে গাড়িতে তোলে পুলিশ। অনেক কাকুতি-মিনতি করলেও কোনও কথা শোনেনি পুলিশ।
আরেকজন কলেজশিক্ষার্থী জানান, কোচিং শেষে সহপাঠীর কাছে থেকে নোট নেওয়ার জন্য তিনি পার্কে যান। পার্কের একটি গাছতলায় দাঁড়িয়ে কথা বলার সময় পুলিশ তাকে আটক করে থানায় নেয়। এ সময় এক পুলিশ সদস্য নানা আপত্তিকর কথাবার্তা বলেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ফেনীর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ বদরুল আলম মোল্লা সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘এটি আইনের বিষয় নয়, নৈতিকতার বিষয়। পুলিশ সেই নৈতিকতার তাগিদেই শিক্ষার্থীদের পার্ক থেকে থানায় নিয়ে অভিভাবকদের জিম্মায় দিয়েছে। আটক করা শিক্ষার্থীদের সচেতন হওয়া, এর কুফল সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘স্কুল-কলেজ চলাকালে শিক্ষার্থীরা পার্কে বা বিনোদনে কেন্দ্র ঘুরতে আসে। অনেক সময় নোংরামিতে জড়িয়ে পড়ে অনেক অপ্রীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। তাদের মা-বাবাও সন্তানদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠিয়ে নিশ্চিন্তে থাকেন। কিন্তু মা-বাবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে তারা সময় কাটায় ভিন্ন স্থানে।’ শিক্ষক ও অভিভাবকদের এ বিষয়ে আরও সচেতন হওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি।
এদিকে আটকের ঘটনায় অভিভাবকরা ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা ও ভবিষ্যত নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন। একই সঙ্গে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীদের মানসিক বিকাশ নিয়ে চিন্তিত অভিভাবকরা৷ কারণ থানা থেকে ছেড়ে দিলেও লোকলজ্জা এবং অভিভাবকদের কাছে হেয় হওয়ায় মানসিকভাবে বিপর্যস্ত শিক্ষার্থীরা। তবে পুলিশের এমন কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অভিভাবক, সচেতন মহল ও আইনবিদরা। তারা বলছেন, পুলিশ চাইলেই কি পার্ক কিংবা বিনোদন কেন্দ্রে অভিযান চালিয়ে শিক্ষার্থীদের আটক করে থানায় নিয়ে আইনের মুখোমুখি করতে পারে? এটি তো মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো অপরাধ।
পুলিশ চাইলেই কি পার্ক কিংবা বিনোদন কেন্দ্রে অভিযান চালিয়ে শিক্ষার্থীদের আটক করে থানায় নিয়ে আইনের মুখোমুখি করতে পারে? এটি তো মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো অপরাধ।
পুলিশ চাইলেই কি কোনও শিক্ষার্থীকে পার্ক থেকে তুলে বা আটক করে থানায় নিতে পারে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে ফেনীর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বদরুল আলম মোল্লা সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘বিনা অভিযোগে কিংবা অপরাধে পুলিশ চাইলে শুধু শিক্ষার্থী নয়, কোনও নাগরিককে পার্ক থেকে তুলে আনতে পারে না। তবে শিক্ষার্থীদের অভিভাবক ও নাগরিকদের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ওই শিক্ষার্থীদের বিজয়সিংহ দিঘীর পার্ক থেকে আটক করে থানায় আনা হয়েছিল। পরে তাদের পরিবারের জিম্মায় ছেড়ে দেওয়া হয়।’
তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে আটক পাঁচ শিক্ষার্থীর অভিভাবক জানিয়েছেন, তারা এসব বিষয়ে থানা পুলিশ কিংবা কারও কাছে কোনও ধরনের অভিযোগ দেননি। কাদের অভিযোগের ভিত্তিতে তাদের ছেলেমেয়েদের পার্ক থেকে পুলিশ আটক করেছে, তা পরিষ্কারভাবে জানতে চান তারা। এভাবে আটক করে থানায় নেওয়ায় তাদের ছেলেমেয়েরা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন। ছেলেমেয়েরা লোকলজ্জায় এখন ঘর থেকে বের হতে পারছে না। বিদ্যালয়ে যেতেও ভয় পাচ্ছে। পড়াশোনা ও ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যত নিয়ে এখন চিন্তিত অভিভাবকরা।
শিক্ষার্থীদের পার্ক থেকে আটকের বিষয়ে দেশের আইন কি বলে জানতে চাইলে ফেনী আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট ফয়েজুল হক মিলকী বলেন, ‘বিনা অপরাধে পার্ক কিংবা যেকোনো স্থান থেকে শুধু শিক্ষার্থী কিংবা শিশু-কিশোর নয়, কাউকে আটক করতে পারে না পুলিশ। এটি আমাদের সংবিধান পরিপন্থী কাজ ও অপরাধ।’
তিনি বলেন, ‘পুলিশের কাজ অপরাধ দমন। অথচ অপরাধ দমন বাদ দিয়ে অতি উৎসাহী হয়ে পুলিশ
বিনোদন পার্কে অভিযানের নামে শিশু-কিশোরদের মানসিক নির্যাতন করেছে। এর আগেও একই ঘটনা ঘটেছিল। অথচ আইনে বলা আছে, অপরাধ ছাড়া কাউকে আটক করে থানায় নেওয়া যাবে না। এটি তো পুলিশের জানার কথা ছিল। এখন এসব শিক্ষার্থীকে থানায় নিয়ে তাদের মনোবল ভেঙে দিলো পুলিশ। এতে তাদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা তৈরি হবে। এর দায়ভার পুলিশকেই নিতে হবে। কারণ পুলিশ শিশু অধিকার আইনের ধারা রীতিমতো লঙ্ঘন করেছে। ফলে ওই কিশোর-কিশোরীদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘিত হয়েছে। ভুক্তভোগী শিশুরা মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এজন্য চাইলে পুলিশের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে পারেন অভিভাবকরা।’
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলেন, বিনোদন পার্ক থেকে আটক করে থানায় নিয়ে আটকে রেখে অভিভাবকদের কাছে সোপর্দ করে নৈতিক শিক্ষার জ্ঞান দেওয়ার অধিকার পুলিশকে কে দিয়েছে? উন্মুক্ত পার্ক থেকে এভাবে শিশু-কিশোরদের আটক করা পুলিশের অতিরঞ্জিত কাজ।
তারা বলেন, ‘পুলিশ দিয়ে শিশু-কিশোরদের আটক করে থানায় নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জানার পর নিজেও হতবাক হয়েছি, কষ্ট পেয়েছি। শিশু-কিশোরদের একসঙ্গে বিনোদন পার্কে বসার স্বাধীনতাটুকুও কি এ দেশে নেই? এভাবে শিশু-কিশোরদের পুলিশ দিয়ে হেনস্তা করলে শিশুমনে একধরনের মানসিক ভীতি ও হীনম্মন্যতা তৈরি হবে। মানসিক বিকাশ ব্যাহত হবে। স্কুল-কলেজ ফাঁকি দিয়ে কেউ আড্ডা দিলে সেটা দেখার দায়িত্ব শিক্ষক-অভিভাবকের। পুলিশ সুপার বড়জোর কমিউনিটি পুলিশ দিয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে অভিভাবকদের সচেতন করতে পারতেন। শিক্ষার্থীদের ক্লাসমুখী করতে কাউন্সেলিং ও শিক্ষক-অভিভাবকদের নিয়ে সচেতনতামূলক সভা করতে পারতেন, চিঠি দিয়ে বিষয়টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও অভিভাবকদের অবগত করতে পারতেন।
শহরে ফুটপাত ভাড়া দিয়ে চাঁদাবাজি হচ্ছে, পরিবহনে চাঁদাবাজি হচ্ছে, অবৈধ যানবাহন থেকে চাঁদা তোলা হচ্ছে, মাদক বিক্রি হচ্ছে—সেসব অপরাধ দমন বাদ দিয়ে অতি উৎসাহী হয়ে পুলিশ বিনোদন পার্কে অভিযানের নামে শিশু-কিশোরদের মানসিক নির্যাতন করছে। অপরাধ ছাড়া শিশুদের আটক করে থানায় নেওয়া যাবে না। একবার থানা পর্যন্ত নিলে শিশুমনে ভয় ভেঙে যাবে। অপরাধপ্রবণতা বাড়বে।
তারা আরও বলেন, স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা উন্মুক্ত বিনোদন পার্কে একসঙ্গে বসতে পারবে না, ছেলেমেয়েরা একসঙ্গে বসে গল্প করতে পারবে না, এমনটা রাষ্ট্রতন্ত্রের কোথাও লেখা নেই।
নির্মল বিনোদনের জায়গা হলো পার্ক। সেখানে বসে ছেলেমেয়েরা আড্ডা দেবে, গল্প করবে, জীবনকে জানার চেষ্টা করবে, এটাই স্বাভাবিক। এতে বন্ধুত্ব ও ভালোবাসা এবং পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস বাড়বে। সামাজিক বন্ধন আরও মজবুত হবে। তাদের পুলিশ দিয়ে আটক করা নিষ্ঠুর আচরণের শামিল।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭০৩
আপনার মতামত জানানঃ