চীন ও তাইওয়ানের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে চলা উত্তেজনা বর্তমানে এক নতুন মাত্রায় পৌঁছেছে। চীন গণতান্ত্রিক এই ভূখণ্ডকে নিজেদের অংশ বলে দাবি করে থাকে। সম্প্রতি তাইওয়ানের আকাশ প্রতিরক্ষা অঞ্চলে চীনের সামরিক বিমানের আনাগোনা বেড়ে যাওয়ায় উত্তেজনার পারদ এখন চরমে।
তাইওয়ান-চীনের সামরিক উত্তেজনা তুঙ্গে। তাইওয়ানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক নির্মাণের আভাসের পর থেকেই চীন তাইওয়ানের আকাশ দখলে নেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে বহুদিন ধরেই। এবার স্বায়ত্তশাসিত তাইওয়ানের আকাশসীমায় অবৈধভাবে এশিয়ার পরাশক্তি চীনের ৩০টি যুদ্ধবিমান অনুপ্রবেশ করেছে।
তাইওয়ানের পক্ষ থেকে জানানো হয়, সোমবার (৩০ মে) তাদের আকাশ প্রতিরক্ষা অঞ্চলে চীনের এসব যুদ্ধবিমানকে সতর্ক করতে তারাও অঞ্চলটিতে বেশ কিছু যুদ্ধবিমান মোতায়েন করেছে। খবর বিবিসির।
গত জানুয়ারির পর এটাই চীনের সর্বোচ্চ সংখ্যক যুদ্ধবিমান অনুপ্রবেশের ঘটনা। মাত্র কয়েকদিন আগেই তাইওয়ানে আক্রমণের বিষয়ে চীনকে সতর্ক করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। এছাড়া সম্প্রতি এক মার্কিন কর্মকর্তা তাইওয়ানের নেতাদের সঙ্গে নিরাপত্তা বিষয়ে আলোচনা করতে দ্বীপটিতে সফর করেছেন।
গত কয়েক মাস ধরেই তাইওয়ানের আকাশসীমায় চীনের যুদ্ধবিমানের অনুপ্রবেশ বাড়তে দেখা গেছে। যদিও বেইজিংয়ের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে যে, সামরিক মহড়ার অংশ হিসেবেই এসব যুদ্ধবিমান পাঠানো হয়েছে।
কিন্তু চীনের এমন কর্মকাণ্ডে তাইওয়ানে ক্ষোভ বেড়ে গেছে এবং ওই অঞ্চলে উত্তেজনা আরও বাড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। চীন তাইওয়ানকে তাদের একটি বিচ্ছিন্ন প্রদেশ হিসাবে মনে করে। কিন্তু তাইওয়ান নিজেদের স্বাধীন রাষ্ট্র বলেই দাবি করে আসছে।
তাইওয়ানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, সোমবার ২২টি যুদ্ধবিমানের সঙ্গে ইলেকট্রনিক যুদ্ধবিমান, আগাম সতর্কতা ও অ্যান্টি-সাবমেরিন বিমানও অন্তর্ভুক্ত ছিল।
তাইওয়ানের প্রতাস দ্বীপপুঞ্জের উত্তর-পূর্ব দিকে এসব যুদ্ধবিমান উড়তে দেখা গেছে। ওই এলাকা তাইওয়ানের বিমান প্রতিরক্ষা শনাক্তকরণ অঞ্চলের (এডিআইজেড) অংশ।
গত সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন তাইওয়ান ইস্যুতে চীনকে সতর্কবার্তা দেওয়া এবং রোববার বাইডেন প্রশাসনের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা তাইওয়ানের সরকারের সঙ্গে নিরাপত্তা বৈঠক করতে সেই দ্বীপ ভূখণ্ড সফরের পরদিনই ঘটল এ ঘটনা।
গত কয়েক মাস ধরেই তাইওয়ানের আকাশসীমায় চীনের যুদ্ধবিমানের অনুপ্রবেশ বাড়তে দেখা গেছে। যদিও বেইজিংয়ের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে যে, সামরিক মহড়ার অংশ হিসেবেই এসব যুদ্ধবিমান পাঠানো হয়েছে।
তাইওয়ানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, চীনের যুদ্ধ বিমান প্রতাস দ্বীপের আকাশসীমায় প্রবেশ করলেও তাইওয়ানের আকাশসীমা অতিক্রম করার কোনো প্রবণতা সেসবের মধ্যে দেখা যায়নি। যদি এমন হতো, তাহলে সেটি চরম বৈরী আচরণ হিসেবে গণ্য করা হতো।
এক সময়ের স্বাধীন রাষ্ট্র তাইওয়ান আসলে পূর্ব এশিয়ার একটি দ্বীপ, যা তাইওয়ান প্রণালীর পূর্বদিকে চীনের মূল ভূখণ্ডের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলে অবস্থিত। প্রায় ৫ দশক ধরে এই দ্বীপ ভূখণ্ডকে নিজেদের বলে দাবি করে আসা চীন গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে বার বার তাদের আকাশসীমা লঙ্ঘন করছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
১৯৪৯ সালে চীনের ক্ষমতাসীন গণতান্ত্রিক সরকার ও কমিউনিস্টদের মধ্যে চলমান গৃহযুদ্ধে জয় হয়েছিল কমিউনিস্টদের। পরাজিত গণতান্ত্রিক সরকারের নেতারা তাইওয়ানে পালিয়ে গিয়েছিলেন। তারপর থেকেই তাইওয়ানকে নিজেদের ভূখণ্ডের অংশ বলে দাবি করছে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিসি)।
তাইওয়ানের স্বাধীনতাপন্থী শক্তি অবশ্য বরাবরই চীনের এই দাবির তীব্র বিরোধিতা করে আসছে।
এদিকে, চীনের কবল থেকে তাইওয়ানকে রক্ষায় দীর্ঘদিন ধরে ‘কৌশলগত প্রচেষ্টা’ চালিয়ে যাচ্ছে ওয়াশিংটন। এ কারণেই তাইওয়ানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো কূটনৈতিক সম্পর্ক না থাকলেও ‘তাইওয়ান রিলেশন অ্যাক্ট’ নামে একটি চুক্তি অনুসারে দ্বীপটির কাছে অস্ত্র বিক্রিসহ বাণিজ্যিক সম্পর্ক ও যোগাযোগ বজায় রাখছে যুক্তরাষ্ট্র।
যে কারণে দুই কোরিয়া আছে এবং দুই ভিয়েতনাম ছিল, ঠিক দুই চীন থাকার কারণও সেটাই—স্নায়ুযুদ্ধ ও এর আগে-পরের ইতিহাস। দুই দেশই নিজেকে চীন মনে করে। এবং দুই দেশের মধ্যে দা-কুমড়ায় সম্পর্ক। কমিউনিস্টশাসিত চীনের কাছে তাইওয়ান হলো তাদের দলছুট অংশ। এই দলত্যাগী অংশ চীনের ক্ষমতার জন্য হুমকি।
বেইজিং ইতিমধ্যে বলপূর্বক তাইওয়ান প্রণালির দুই পারকে পুনরায় এক করার জন্য কাজ করছে। কিন্তু তাইওয়ান বলেছে, তারা নিজের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করবে।
চীন বরাবরই তাইওয়ানকে নিজেদের অধিভুক্ত প্রদেশ হিসেবে দাবি করে আসছে এবং এই দাবিকে শক্তিশালী করতে তাইওয়ানের ওপর রাজনৈতিক ও সামরিক চাপ প্রতিনিয়ত বাড়িয়ে চলছে দেশটি। কিন্তু এক সময়ের সার্বভৌম দেশ তাইওয়ান বরাবরই চীনের এই দাবি অস্বীকার করে নিজেদের স্বাধীনতার পক্ষে অনড় অবস্থানে থেকেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অঞ্চলটিতে উত্তেজনা বেড়েছে এবং দ্বীপটিকে নিয়ন্ত্রণে পেতে শক্তি ব্যবহারের হুঁশিয়ারিও দিয়েছে চীন।
চীন তাইওয়ানকে একটি নিজেদের বিচ্ছিন্ন প্রদেশ হিসেবে দেখে, কিন্তু তাইওয়ান নিজেদের সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে দাবি করে আসছে। এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় নিজেদের সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করছে তাইওয়ান। কিন্তু চীনের অভ্যন্তরীণ ইস্যুতে হস্তক্ষেপ না করতে ওয়াশিংটন সতর্ক করে আসছে দেশটি।
চীনের ‘ এক দেশ, দুই নীতিতে’ সর্বোচ্চ মাত্রায় স্বায়ত্তশানের নিশ্চয়তার কথা বলা হয়েছে। সাবেক ব্রিটিশ উপনিবেশ হংকংও সেভাবে পরিচালিত হচ্ছে। ১৯৯৭ সালে দেশটিকে চীনের হাতে হস্তান্তর করে ব্রিটেন। তাইওয়ানকেও সেই প্রস্তাব দিয়েছে চীন, কিন্তু দেশটির অধিকাংশ বড় রাজনৈতিক দল তা প্রত্যাখ্যান করছে ।
চীনের সামরিক কৌশল হলো বিদেশি সামরিক বাহিনী, বিশেষ করে মার্কিন বাহিনীকে চীনা অঞ্চল থেকে যতটা সম্ভব দূরে রাখা। চীন এই কাজ করেছে খানিকটা দক্ষিণ চীন সাগরে কৃত্রিম দ্বীপ তৈরি এবং ওইসব দ্বীপে সামরিক ঘাঁটি তৈরির মাধ্যমে।
গেল কয়েক বছরে কৌশলের অংশ হিসেবে ওয়ারশিপ, অ্যান্টি-শিপ মিসাইলের সংখ্যা বাড়িয়েছে চীন। একে সম্পূর্ণ প্রতিরক্ষা কৌশল—কিংবা উপসাগর থেকে মার্কিন বাহিনীকে দূরে রাখার উপায়—হিসেবে দেখা যায়। এর ফলে দক্ষিণ চীন সাগরের গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রপথগুলোতে চীনের সামরিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সেইসঙ্গে তাইওয়ানকে বশে রাখার আকাঙ্ক্ষাও চরিতার্থ করেছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫২৬
আপনার মতামত জানানঃ