আলোচিত নরসিংদী রেলওয়ে স্টেশনে তরুনীকে হেনস্থাকারী নারীকে গ্রেফতার করেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। গতকাল রোববার দিবাগত রাত ৩টার দিকে শিবপুর উপজেলার ইটাখোলা এলাকায় থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়।
এ প্রসঙ্গে র্যাব-১১ নরসিংদী ক্যাম্পের কোম্পানি কমান্ডার ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌহিদুল মবিন খান জানান, গত ১৮ মে ভোর সাড়ে ৫টার দিকে নরসিংদী স্টেশনের ১ নম্বর প্ল্যাটফর্মে ওই নারী বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া এক তরুণীকে পোশাক নিয়ে গালিগালাজ, মারধর ও শ্লীলতাহানি করেন এবং মুঠোফোনে ছবি তুলেন। তিনি বলেন র্যাবের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে আজ সোমবার ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন করে বিস্তারিত জানানো হবে।
নরসিংদী রেল স্টেশনে পোশাকের জন্য তরুণী ও তার বন্ধুদের লাঞ্ছনার ঘটনার অডিওসহ ভিডিওটি দেখে হতবাক গোটা দেশ। লাঞ্ছিত ছাত্রীটিকে যারা লাঞ্ছনা করেছে, তারাই গলা ফাটিয়ে বলছে “মাফ চা’, ‘মাথা নিচু কর, ক্ষমা চা”। মেয়েটির অপরাধ সে তার পছন্দমতো পোশাক পরেছে।
এক গবেষণা বলছে, পোশাক বা আচরণ দেখে মুহুর্তে কোন মেয়েকে “ভাল মেয়ে বা মন্দ মেয়ে” হিসাবে বিচার করার এবং “মন্দ মেয়ে” বলে মনে হলে তাদের উপর আক্রমণের মানসিকতা বেড়ে যায়। এই আক্রমণ করাটাকেও তারা যৌক্তিক বলে মনে করে।
গবেষণা বলছে একটি মেয়ে যখন খানিকটা পশ্চিমা ধাঁচের পোশাক পরে, স্বাধীনভাবে চলাফেরা ও মেলামেশা করে, সেই মেয়েদের নানাভাবে হেয় করা হয় ও তাদের প্রতি অপমানজনক আচরণ করা হয়, এমন ধারণা পোষণ করেন শতকরা ৮১ জন উত্তরদাতা।
অবাক করা তথ্য হচ্ছে, এর পাশাপাশি শতকরা ৬৪ জন মানুষ মনে করে যেসব মেয়ে আচরণ ও পোশাকে সামাজিকতা মানে না, স্বাধীনভাবে চলতে চায় এবং আচরণে নারী-পুরুষ বিভেদ করে না, তাদের প্রতি অন্য মানুষ কটুক্তি, সমালোচনা, তির্যক মন্তব্য ও অপমানজনক আচরণ করতেই পারে।
এর মানে স্বাধীন আচরণ করা নারীদের প্রতি কটুক্তি করলে তাতে কোন দোষ হবে না। যে কারণে স্টেশনে একজন নারী মেয়েটিকে হেনস্তা করতে শুরু করলে সবাই তার পক্ষ নিয়ে মেয়েটির ও তার সঙ্গীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।
আসলে নারীর পছন্দের পোশাকের প্রতি অন্য নারীর যে ক্ষোভ এর সাথে ধর্মের কোন সম্পর্ক নেই। এর সাথে সম্পর্ক আছে হীনতা, নীচতা, নিজের পরাধীন জীবন, বন্দীত্ব, যৌন ঈর্ষা ও নিজের স্বামী বা ছেলেকে নিয়ে অনিরাপত্তার বোধ (ইনসিকিউরিটি)।
নারী যে কারণে অন্য নারীকে পোশাকের জন্য হেয় করে সেটার প্রধান কারণ হলো নিজের ভেতরে থাকা নারীবিদ্বেষ (ইন্টার্নালাইজড মিসোজিনি)। সাম্প্রতিক করা আমাদের গবেষণা বলছে আমাদের দেশে ইন্টার্নালাইজড মিসোজিনি বাড়ছে। এই বিদ্বেষ থেকেই এরা নারী হয়েও নারীর বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছে।
নৃতত্ত্ববিদরা মনে করেন প্রায় সত্তর হাজার বছর আগে পোশাক পরিধান শুরু করেছিলো মানুষ। কালক্রমে বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠীর অনেকের মধ্যে পোশাকের একটি ধরণও তৈরি হয়। ফলে সবক্ষেত্রে না হলেও অনেক সময় পোশাক দেখেও ধারণা করা হয় যে ব্যক্তিটি কোন দেশ বা সমাজ বা অঞ্চলের।
তবে পোশাক বিষয়টি এভাবে একটা বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠেছে মূলত সমাজ আর পরিবেশের প্রভাবে। গত কয়েক দশকে সামাজিক রাজনৈতিক ও ধর্মীয় কারণে যে কটি দেশে পোশাকের ক্ষেত্রে পরিবর্তন এসেছে তার মধ্যে বাংলাদেশও একটি।
নৃবিজ্ঞানের শিক্ষক জোবাইদা নাসরিন বলেন, পোশাকের ক্ষেত্রে নারীর ইচ্ছা অনিচ্ছার প্রতি সম্মান আগেও কম ছিলো, এখন আরও কমেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কারণে এটি আরও দৃশ্যমান হয়েছে মাত্র। তিনি বলেন হিজাব বা বোরকা পরলেই অনেকে ট্যাগ দেন এই নারী পশ্চাৎপদ। আবার অনেকে চাইলেও তার ইচ্ছে মতো পোশাক পরার সাহস দেখাতে পারেন না।
আমার মাকে আশির দশকে স্লিভলেজ ব্লাউজ পরতে দেখেছি। তিনি কিন্তু মফস্বলের সাধারণ একজন নারী। কিন্তু আমি এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্লিভলেজ ব্লাউজ পরে ক্লাস নিবো চিন্তা করলেও ভরসা পাইনা।
জোবাইদা নাসরিন বলেন, ”কারণ আমি জানি আজ স্লিভলেজ ব্লাউজ পরে আমি ক্লাস নিতে এলে সঙ্গে সঙ্গে মিছিল শুরু হবে। এমনকী ১২ বছর আগে যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের পর পরীক্ষা হলে জিন্স প্যান্ট পরে ডিউটি করতে গিয়েছিলাম তখন একজন ডিন অভিযোগ করেছিলেন আমার বিরুদ্ধে।
বাংলাদেশে বিপুল সংখ্যক বেসরকারি টেলিভিশনে সংবাদ উপস্থাপক হিসেবে কাজ করেন অনেক নারী। কিন্তু ২০১৯ সালে একজন উপস্থাপককে ঘিরে শোরগোল হয়েছিলো কারণ যখন তিনি সংবাদ পাঠ করছিলেন , তখন শাড়ির সাথে তিনি স্লিভলেজ ব্লাউজ পরেছিলেন। তার সংবাদ পাঠ ছাপিয়ে তখন আলোচনার তুঙ্গে ছিলো ওই ব্লাউজ ।
আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ছাত্রী হলে টি শার্ট পরে হল অফিসে যাওয়া যাবে না এমন বিজ্ঞপ্তি দিয়ে তা তুলে নিতে হয়েছিলো প্রবল সমালোচনার মুখে।
২০১৪ সালে ঢাকার মোহাম্মদপুরে একটি মহিলা হোস্টেলে একদল বখাটের হামলার পর গণমাধ্যমে খবর এসেছিলো যে হোস্টেলের তত্ত্বাবধায়ক- যিনি ছিলেন একজন নারী তিনিই হোস্টেলের মেয়েদের বলেছেন তারা কেন শার্ট প্যান্ট পরে বাইরে যায়?
আবার বছর খানেক আগে একটি বহুজাতিক কোম্পানির একটি পণ্যের ফ্যাশান শোতে একজন মডেল শাড়ির ওপর ব্লাউজ পরেছিলেন যা পণ্যটিকে নিয়ে আলোচনা থেকে সরিয়ে শোরগোল তুলেছিলো পোশাক নিয়ে। এই যে পোশাক এখন এতো আলোচনায় আসছে এটি কি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কারণে নাকি আসলে পোশাককেন্দ্রিক সামাজিক দ্বন্দ্বও প্রকট হয়ে উঠেছে?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আজরিন আফরিন বলছেন, সব ধরণের পোশাক নিয়েই বাড়াবাড়ি রকমের প্রতিক্রিয়া দেখানোর একটা প্রবণতা চলছে এখন আর এটা নিয়ে সব পক্ষের অতি কট্টররাই সক্রিয়। তারা নারীর যোগ্যতা, মেধা, কাজ, ভালো লাগা কিংবা ইচ্ছা অনিচ্ছাকে ঢেকে দেন পোশাককে সামনে নিয়ে আসার মাধ্যমে, অথচ পোশাক নির্বাচন ব্যক্তির নিজস্ব অধিকার ও পছন্দের বিষয়।
যে যেই পেশারই হোক না কেন সব কিছু ছাপিয়ে আলোচনায় আসে পোশাক। পোশাক ডিফাইন করে দিচ্ছে আপনি কথিত ‘প্রগতিশীল, উগ্রপন্থী, নাকি পশ্চাদ ধারণার অধিকারী’। পোশাক তো আর মানদণ্ড হতে পারেনা। অনেকে পোশাক পরে সামাজিক বা পারিবারিক চাপ বা আকাঙ্ক্ষার কারণে। এর সাথে আছে নিজের স্বাচ্ছন্দ্য বা নিরাপত্তা বিবেচনা।
আফরিন বলেন, বাংলাদেশে সাইবার বুলিং বাড়ছে। বিবিসির পেইজ দেখলেও দেখবেন কমেন্ট সেকশনে অনেকে পোশাককে আলোচনায় নিয়ে আসেন। দু ভাগে ভাগ হয়ে যায়- সেটা অতি প্রগতিশীলতা হোক বা অতি উগ্রবাদী হোক। এটা পোশাক এবং এ নিয়ে কমেন্টের ক্ষেত্রেও দেখতে পাই।
সব মিলিয়ে নারী কেন কোন পোশাক নির্বাচন করছেন তা নিয়ে চিন্তা না করেই পোশাক নিয়ে নিজের মতামতকেই চাপিয়ে দেয়ার প্রবণতা সমাজে জোরালো হয়েছে বলে মনে করেন আজরিন আফরিন।
এসডব্লিউ/এসএস/১৫২০
আপনার মতামত জানানঃ