২০২১ সালে বিশ্বব্যাপী মৃত্যুদণ্ড উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে বলে জানিয়েছে মানবাধিকারবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। বিশ্বে ২০২১ সালে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের সংখ্যা ২০ শতাংশ বেড়েছে, একই সঙ্গে মৃত্যুদণ্ডের রায়ের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪০ শতাংশ।
একই সঙ্গে সংস্থাটি বলেছে, ইরান ২০১৭ সাল থেকে রেকর্ডসংখ্যক মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছে। বার্তা সংস্থা এএফপি ও আল জাজিরা এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে।
আজ মঙ্গলবার(২৪ মে) এক বিবৃতিতে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলেছে, ২০২১ সালে বিশ্বের ১৮টি দেশে অন্তত ৫৭৯টি মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। এই সংখ্যা ২০২০ সালের তুলনায় ২০ শতাংশ বেশি। ইরান সবচেয়ে বেশি মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে। দেশটিতে গত চার বছরে ৩১৪ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে।
সংস্থাটির বার্ষিক রিপোর্ট বলছে, ২০২১ সালে সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে অন্তত ৫৭৯ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে এবং অন্তত ২ হাজার ৫২ জনের বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের রায় দেওয়া হয়েছে।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের রিপোর্ট থেকে আরও জানা যায়, মৃত্যুদণ্ড কার্যকর বেড়ে যাওয়ার শীর্ষে রয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ইরান। সেখানে ২০২১ সালে ৩১৪ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়, এর আগে ২০২০ সালে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয় ২৪৬ জনের, অর্থাৎ ২৮ শতাংশ বেড়েছে। দেশটিতে মাদক সংক্রান্ত মামলায় দোষী সাব্যস্ত ১৩২ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয় যা মোট মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার ৪২ শতাংশ এবং ২০২০ সাল থেকে পাঁচগুণেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে।
২০২১ সালে সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে অন্তত ৫৭৯ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে এবং অন্তত ২ হাজার ৫২ জনের বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের রায় দেওয়া হয়েছে।
সৌদি আরবেও মৃত্যুদণ্ড বাড়ছে বলে জানিয়েছে অ্যামনেস্টি। দেশটিতে ২০২০ সাল থেকে মৃত্যুদণ্ডের সংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি হয়েছে। অন্যদিকে মিয়ানমারে ৯০ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
অ্যামনেস্টি বলেছে, বাংলাদেশ, ভারত, কঙ্গো গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র, মিশর ও পাকিস্তানে মৃত্যুদণ্ডের হার বাড়তে দেখা গেছে। গত বছর বিশ্বের ৫৬ দেশে বিচারকেরা অন্তত ২ হাজার ৫২টি মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দিয়েছেন।
অ্যামনেস্টির প্রধান অ্যাগনেস ক্যালামার্ড বলেছেন, ‘২০২০ সালে (করোনা মহামারির কারণে) মৃত্যুদণ্ডের হার কমানোর সুযোগ ছিল, কিন্তু তার পরিবর্তে অনেক দেশ মৃত্যুদণ্ডকেই অপরাধ সমাধানের পথ হিসেবে বেছে নিয়েছে। দেশগুলো মানুষের বেঁচে থাকার অধিকারের প্রতি অবহেলা দেখিয়েছে।’
সংস্থাটির এই পরিসংখ্যানে চীন অন্তর্ভুক্ত নয়। তবে সেখানে গোপনীয়তার মধ্য দিয়ে একটি ব্যবস্থায় প্রতি বছর হাজার হাজার লোকের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা বা মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় বলে ধারণা করা হয়।
অ্যামনেস্টি বলছে যে, উত্তর কোরিয়া ও ভিয়েতনামেও গোপনীয়তা রক্ষা করা হয়। ফলে এসব দেশে মৃত্যুদণ্ডের ব্যবহার সংক্রান্ত তথ্য সহজে পাওয়া যায় না। একারণে বিশ্বব্যাপী মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার দেশগুলোর প্রবণতার সম্পূর্ণ মূল্যায়নকে বাধাগ্রস্ত করছে।
অ্যাগনেস ক্যালামার্ড আরও বলেন, ‘চীন, উত্তর কোরিয়া ও ভিয়েতনাম গোপনীয়তার আড়ালে তাদের দেশে মৃত্যুদণ্ড অব্যাহত রেখেছে। তার পরও সামান্য যা কিছু আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়েছে, তা বড় উদ্বেগের কারণ।’
অ্যামনেস্টি আরও উল্লেখ করেছে যে রক্ষণবাদী রাষ্ট্রগুলো ‘বিক্ষোভকারী ও সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের অস্ত্রাগার হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের আশ্রয় নিয়েছে’।
মিয়ানমার, যেখানে দেশটির সেনাবাহিনী ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে একটি অভ্যুত্থানের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকারের কাছ থেকে ক্ষমতা দখল করে নেয়। সেখানে সামরিক আইনের অধীনে মৃত্যুদণ্ড উদ্বেজনক হারে বেড়েছে। বিদ্যমান সামরিক ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে মামলা পরিচালনা এবং আপিল করার অধিকার ছাড়াই দেওয়া হচ্ছে মৃত্যুদণ্ড। দেশটিতে ৯০ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় এবং আসামিদের হাজিরও করা হয়নি মামলার রায়ের সময়।
ক্রমবর্ধমান সংখ্যা সত্ত্বেও, অ্যামনেস্টি বলছে যে বিশ্বব্যাপী মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার প্রবণতা রহিত করার পক্ষেই রয়েছে। গত বছর মাত্র ১৮টি দেশ মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছে বলে জানা গেছে। যা রেকর্ড রাখা শুরু করার পর থেকে এটি সর্বনিম্ন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৮৮ সালের পর থেকে মৃত্যুদণ্ড সর্বনিম্নে নেমে আসে। দেশটির ফেডারেল প্রশাসন মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার ওপর একটি অস্থায়ী স্থগিতাদেশ জারি করে সে সময়। ভার্জিনিয়া দেশটির ২৩তম রাজ্যে যেখানে মৃত্যুদণ্ড সম্পূর্ণভাবে বাতিল করা হয়েছে।
বেশ কয়েকটি দেশ মৃত্যুদণ্ডের ব্যবহার রহিত করতে বা এর ব্যবহার সীমিত করার জন্য পদক্ষেপ নিচ্ছে। গত জুলাই মাসে, সিয়েরা লিওনের পার্লামেন্ট সর্বসম্মতিক্রমে একটি বিল পাসের জন্য ভোট দেয় মৃত্যুদণ্ড সম্পূর্ণভাবে বাতিল করার জন্য। একই ধরনের আইন কাজাখস্তানে গত ডিসেম্বরে পাস হয়।
মালয়েশিয়াও মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার ওপরে স্থগিতাদেশ অব্যাহত রেখেছে এবং দেশটির সরকার বলছে যে তারা এ বছরের শেষ দিকে মৃত্যুদণ্ড ব্যবহারের বিষয়ে আইনী পরিবর্তন প্রস্তুত করবে। দেশটিতে বেশিরভাগ মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় মাদক সংক্রান্ত মামলায়।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, ‘লোকেরা মনে করে মৃত্যুদণ্ডে অবৈধ কাজ কমায়। মৃত্যুদণ্ডের বিধান থাকলেও অপরাধ হয়, না থাকলেও হয়। এটি কমানোর জন্য সামাজিক সচেতনতা দরকার। কোনো অপরাধ হলে ‘ন্যায়বিচার’ চাই বলে দাবি ওঠে। ফাঁসি চাই বলা হয়। মৃত্যুদণ্ড হলেই ন্যায়বিচার হয়েছে বলা যায়? এটি ভয়াবহ অবস্থা, এ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।’
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬২৭
আপনার মতামত জানানঃ