বিশ্বে প্রায় ৬০টি সমুদ্রবন্দর রয়েছে, যেগুলোয় বছরে ৩০ লাখ বা তিন মিলিয়ন একক কনটেইনার ওঠানামা করে। এগুলোকে ডাকা হয় ‘থ্রি মিলিয়নেয়ার পোর্ট’ নামে। নানামুখী পদক্ষেপের ফলে গত বছর ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চট্টগ্রাম বন্দর এই তালিকায় প্রবেশ করতে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু করোনা মোকাবিলায় যথেষ্ট দ্রুত সাড়া দিতে না পারায় এই বন্দরে কনটেইনার ওঠানামা কমেছে। ফলে মর্যাদার ‘থ্রি মিলিয়নেয়ার পোর্ট’ নামক স্বীকৃতিটি হারাতে বসেছে দেশের প্রধান এই সমুদ্রবন্দর।
কাস্টমস বিভাগের সূত্রমতে, দেশে সমুদ্রপথে পণ্যের ৯৩ শতাংশই আমদানি-রফতানি হয় চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে। গত পাঁচ বছরের হিসাব বিবেচনায় নিলে এ বন্দরে পণ্যের ওঠানামায় গড়ে সাড়ে ৯ থেকে ১০ শতাংশ করে প্রবৃদ্ধি হচ্ছিল। তবে করোনায় ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতায় পাল্টে গেছে সেই চিত্র। করোনার প্রভাবে গত অর্থবছরে পণ্য হ্যান্ডলিংয়ে ৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধিও অর্জন হয়নি চট্টগ্রাম বন্দরে। মহামারী করোনার প্রভাবে বৈশ্বিক ব্যবসা-বাণিজ্য, বিশেষ করে রফতানি বাণিজ্যে যে ধাক্কা লেগেছে, তাতে চলতি বছর ‘থ্রি মিলিয়নেয়ার পোর্ট’ ক্লাব থেকে বিশ্বের আরো অনেক বন্দরই ছিটকে পড়তে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
জানা যায়, চলতি অর্থবছরের শুরুতে করোনার প্রভাব কিছুটা কাটিয়ে দেশে শিল্প-কারখানা সচল হতে থাকলে সরকারি প্রকল্পের আমদানির পাশাপাশি সক্রিয় হতে শুরু করেন বেসরকারি আমদানিকারকরা। বন্দরের আমদানি পরিচালন কার্যক্রমেও গত ছয় মাসে ইতিবাচক চিত্র দৃশ্যমান হতে থাকে ধারাবাহিকভাবে। কিন্তু রফতানির ধারাবাহিকতায় ফের ধাক্কা দিয়েছে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ। বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন দেশে বিশেষ করে ইউরোপের দেশগুলোতে দ্বিতীয় দফায় লকডাউনের কারণে আবারো স্থবিরতা নেমে এসেছে রফতানি কার্যক্রমে। এতে চট্টগ্রাম বন্দরে আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে রফতানি কনটেইনার হ্যান্ডলিং। এ অবস্থায় চলতি বছর শেষে দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দরে কনটেইনার হ্যান্ডলিং ২৮ লাখ পার করতে পারবে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এসএম আবুল কালাম আজাদ সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে বন্দরের পরিচালন কার্যক্রমে অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় আরো বেশি সচেতন ও সক্রিয় ছিলাম আমরা। প্রবৃদ্ধি সামাল দেয়া ও ধারাবাহিকতা রক্ষা করে দক্ষতাও বাড়িয়েছি। কিন্তু দেশে ব্যবসা-বাণিজ্য কমে গেছে। এমনকি কল-কারখানাও বন্ধ থেকেছে একটা সময় পর্যন্ত। যেহেতু হ্যান্ডলিং কার্যক্রম আমদানি-রফতানি বাড়া ও কমার সঙ্গে সম্পর্কিত, ফলে এসবের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে বন্দরের পরিচালন কার্যক্রমে। অথচ সবকিছু ঠিক থাকলে চলতি বছর বন্দরের প্রবৃদ্ধি রেকর্ড করতে পারত।’
চট্টগ্রাম বন্দরের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী করোনার প্রভাবে আমদানি সবচেয়ে বেশি কমেছে চলতি বছরের এপ্রিল, মে ও জুনে। তবে জুলাই থেকে ধারাবাহিকভাবে পণ্যের হ্যান্ডলিং বাড়তে থাকে। ওই মাসে আমদানি পণ্যভর্তি কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছে ১ লাখ ২ হাজার ৯৭৮ টিইইউ (টোয়েন্টি ফিট ইকুইভ্যালেন্ট ইউনিটস)। এরপর যথাক্রমে আগস্টে ১ লাখ ২৬ হাজার ৮০৩, সেপ্টেম্বরে ১ লাখ ২৮ হাজার ৬৮, অক্টোবরে ১ লাখ ৩৯ হাজার ৬৩৫ ও নভেম্বরে ১ লাখ ৪১ হাজার ১২১ টিইইউ কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দরের মূল ইয়ার্ডের সঙ্গে ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো (আইসিডি) ও ইনল্যান্ড কনটেইনার টার্মিনালের (আইসিটি) হ্যান্ডলিং কার্যক্রমও যুক্ত হয়েছে এ হিসাবে।
অন্যদিকে চট্টগ্রাম বন্দরের রফতানি পণ্য হ্যান্ডলিংয়ে কোভিডের প্রভাব সবচেয়ে বেশি দৃশ্যমান হয় এপ্রিল ও মে মাসে। ওই দুই মাসে যথাক্রমে ১৪ হাজার ৭৪৪ ও ৩৩ হাজার ৮৩৬ টিইইউ কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে। পরের দুই মাস রফতানিতে কিছুটা গতি এলে জুনে ৫২ হাজার ১৪৯ টিইইউ ও জুলাইয়ে ৭৪ হাজার ৮৪৯ টিইইউ কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয় বন্দর দিয়ে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে এ গতি স্থায়ী না হয়ে উল্টো কমেছে। আগস্টে চট্টগ্রাম বন্দরে রফতানি পণ্যভর্তি কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছে ৫৮ হাজার ৯৮৮ টিইইউ। এরপর সেপ্টেম্বরে ৬১ হাজার ২১৩, অক্টোবরে ৫৮ হাজার ৪২০ ও নভেম্বরে হ্যান্ডলিং হয়েছে ৫৭ হাজার ৯৩১ টিইইউ কনটেইনার।
প্রসঙ্গত, জার্মানির হামবুর্গ পোর্ট কনসালট্যান্সি (এইচপিসি) প্রণীত চট্টগ্রাম বন্দরের ৩০ বছর মেয়াদি মহাপরিকল্পনায় প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে মিনিমাম (ন্যূনতম), মিডিয়াম (মধ্যম) ও হাইয়েস্ট (সর্বোচ্চ) এ তিনভাবে ধারণা দেয়া হয়েছে। এতে ন্যূনতম হলে ৫ শতাংশ, মধ্যম ৭ শতাংশ এবং সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৯ শতাংশ। ওই মহাপরিকল্পনায় ধারণা দেয়া হয়েছিল, চট্টগ্রাম বন্দরে ২০১৮ সালে কনটেইনার ওঠানামা হবে প্রায় ২৪ লাখ; ২০১৯ সালে ২৬ লাখ ৬৬ হাজার ও ২০২০ সালে ২৯ লাখ একক কনটেইনার। তবে পূর্বাভাসের উল্লিখিত আড়াই বছর পরের সেই লক্ষ্যমাত্রা বিগত ২০১৭ সালেই পূরণ করেছে চট্টগ্রাম বন্দর। আর ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে কনটেইনার হ্যান্ডলিং ৩০ লাখ ছাড়িয়ে যাওয়ায় প্রথমবারের মতো থ্রি মিলিয়নেয়ার পোর্ট ক্লাবে প্রবেশ করে চট্টগ্রাম বন্দর। কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের ভিত্তিতে চলতি বছর লয়েড লিস্ট যে শীর্ষ ১০০টি বন্দরের তালিকা করেছে তাতে ৫৮তম অবস্থানে রয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর। কিন্তু কোভিড এসে ব্যাহত হয়েছে বন্দরের এ অগ্রযাত্রা।
চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি মাহবুবুল আলম এ বিষয়ে সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘দেশে লকডাউন উঠে যাওয়ার পর আমদানিতে গতি ফিরতে থাকলেও রফতানি নিয়ে দুশ্চিন্তা রয়ে গেছে। বাংলাদেশ থেকে বিশেষ করে যেসব দেশে পণ্য রফতানি হয় সেসব দেশে এখনো করোনাভাইরাস নিয়ে টালমাটাল অবস্থা। আবার বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ রফতানি পণ্যগুলোর কাঁচামাল আমদানি করেই পণ্য প্রস্তুত করতে হয়। ভারী শিল্পের কাঁচামাল আমদানির ক্ষেত্রেও আমরা বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধকতার কথা শুনতে পাচ্ছি। বিশ্বব্যাপী চাহিদা ও জোগানের ভারসাম্য নষ্ট হওয়ায় ভারী শিল্পের কারখানাগুলো আমদানির জন্য এলসি খুলেও বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছেন উদ্যোক্তারা। এসবের প্রভাব পড়ছে বন্দরের কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়েও।
এসডাব্লিউ/এমএন/আরা/১২৫০
আপনার মতামত জানানঃ