নবরাত্রির নয় দিনে ভারতের রাজধানী দিল্লিতে সব মাংসের দোকান বন্ধ রাখতে নগর কর্তৃপক্ষের এক নির্দেশের পর বহু দোকানে গত দুদিন ধরে মাংস বিক্রি বন্ধ রয়েছে। দিল্লির দক্ষিণ ও উত্তরের মেয়ররা যুক্তি দিয়েছেন নবরাত্রির সময় সিংহভাগ হিন্দু মাছ-মাংস অর্থাৎ আমিষ খান না, এবং অনেকে তাদের কাছে অভিযোগ করেছেন দোকানে মাংস দেখে তারা অস্বস্তিতে ভোগেন। খবর বিবিসি
বিজেপি পরিচালিত দক্ষিণ দিল্লি কর্পোরেশনের মেয়র বলছেন, নবরাত্রির সময় বেশীরভাগ হিন্দুই মাছ-মাংস, এমনকি পেঁয়াজ রসুনও খান না। তাই খোলা জায়গায় মাছ-মাংস বিক্রি হতে দেখলে সেই সব হিন্দুদের অস্বস্তি হয়। সেকারণেই এমন নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
তবে মেয়রের এই নির্দেশ নিয়ে রাজনৈতিক মহল এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। সাধারণ মানুষ, যারা মাছ-মাংস খান, তারা বলছেন এভাবে তাদের খাদ্যাভ্যাস নিয়ন্ত্রণ করা ঠিক হচ্ছে না। যদি কারও নিরামিষ খেতে ইচ্ছা হয়, তিনি খেতেই পারেন, কিন্তু মাংসের দোকান কেন বন্ধ থাকবে এমন প্রশ্ন তাদের।
হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে পবিত্র চৈত্র নবরাত্রি শুরু হয়েছে গত ২ এপ্রিল। এই উৎসব চলবে চলতি মাসের ১১ তারিখ পর্যন্ত। তারা মনে করেন, এ সময় তাদের আরাধ্য দেবী দুর্গা মহিষাসুরকে বধ করেছিলেন।
মূলত উত্তর আর পশ্চিম ভারতের হিন্দুদের একাংশ এই উৎসব পালন করেন। তারা কেউ এ সময় উপোস করেন অথবা কঠোরভাবে নিরামিষ খাবার খান এমন কি অনেকে পেঁয়াজ বা রসুনও খান না।
বিজেপি পরিচালিত দক্ষিণ দিল্লির মেয়র মুকেশ সুরিয়ানের দাবী, দিল্লির প্রায় ৯৯ শতাংশ মানুষই এসব কঠোর নিয়ম পালন করেন। মাছ-মাংস ইত্যাদি বিক্রির দৃশ্য দেখে তাদের যেন অস্বস্তিতে পড়তে না হয় সেজন্যই এমন নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।
বার্তা সংস্থা এএনআইকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মেয়র বলেন, মানুষের একটা আবেগ আছে যে নবরাত্রির সময় আমিষ খাবার বা রসুন, পেঁয়াজও বাড়িতে ঢোকে না। প্রায় ৯৯ শতাংশ দিল্লিবাসীই এটা মেনে চলেন।
এই বিষয়টি মাথায় রেখেই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যেখানে রসুন পেয়াজও খাওয়া হয় না, তখন দক্ষিণ দিল্লির মাংসের দোকানগুলোও বন্ধ রাখা উচিত। এই নির্দেশ যারা মেনে চলবেন না, তাদের জরিমানা করা হবে বলে জানান মুকেশ সুরিয়ান।
তিনি আরও বলেন, এরপর থেকে নীতি বদল করে লাইসেন্স দেওয়ার সময় এই শর্ত রাখা থাকবে যে নবরাত্রির সময় মাছ-মাংসের দোকান বন্ধ থাকতে হবে। বিজেপির মেয়রের এই নির্দেশের পর রাজনৈতিক মহলে কড়া প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে।
তবে প্রচুর মানুষ, এমনকি অনেক হিন্দুও, মাংস বিক্রি বন্ধ রাখার সিদ্ধান্তে তাদের ক্ষোভ সোশ্যাল মিডিয়াতে জানাচ্ছেন। তারা বলছেন, এ ধরণের সিদ্ধান্তে ভারতের বহুত্ববাদ লঙ্ঘিত হয়েছে।
নবরাত্রির সময় বেশীরভাগ হিন্দুই মাছ-মাংস, এমনকি পেঁয়াজ রসুনও খান না। তাই খোলা জায়গায় মাছ-মাংস বিক্রি হতে দেখলে সেই সব হিন্দুদের অস্বস্তি হয়। সেকারণেই এমন নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
দিল্লির সরকার চালায় অরবিন্দ কেজরিওয়ালের আম আদমি পার্টি । তারা মাংসের দোকান বন্ধ রাখা নিয়ে কোনো নির্দেশনা দেয়নি। যে দুই মেয়র ১১ এপ্রিল পর্যন্ত মাংসের দোকান বন্ধ রাখার নির্দেশ জারি করেছেন তারা ভারতের ক্ষমতাসীন হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল বিজেপির রাজনীতির সাথে জড়িত। এই নির্দেশের কড়া সমালোচনা হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। অনেকে বলছেন কারো মাংস না খাওয়ার যুক্তিতে অন্যের মাংস খাওয়ার অধিকার বা অন্যের জীবিকার অধিকার লঙ্ঘন করা যায় না।
ভারতের পার্লামেন্ট লোকসভার সদস্য এবং পশ্চিমা বাংলার ক্ষমতাসীন দলের নেত্রী মহুয়া মৈত্র তার এক টুইটে লিখেছেন, ‘ভারতের সংবিধান আমার খুশিমতো যে কোনো সময়ে খাওয়ার অধিকার দিয়েছে’।
জম্মু ও কাশ্মীরের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ওমর আব্দুল্লাহ তার এক টুইটে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছেন— তাহলে কি রোজার মাসে মুসলিম প্রধান এই রাজ্যে সমস্ত অমুসলিম এবং পর্যটকদের জনসমক্ষে খাওয়া নিষিদ্ধ করে দেওয়া যাবে?
ভারতনিয়ন্ত্রিত পূর্বতন জম্মু-কাশ্মীরের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাহ বলেন, সংখ্যাগুরুর খাদ্যাভ্যাসই যদি এই নির্দেশের কারণ হয়, তাহলে কাশ্মীরের সংখ্যাগুরু মুসলিমরা যখন রোজা রাখেন, তখন অমুসলিম কাউকে দিনের বেলায় প্রকাশ্যে খাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা চাপানো উচিত।
আবার তৃণমূল কংগ্রেসের সংসদ সদস্য মহুয়া মৈত্র এক টুইট বার্তায় বলেন, আমি দক্ষিণ দিল্লিতে থাকি। সংবিধান আমাকে যেমন, যখন খুশি মাংস খাওয়ার অধিকার দিয়েছে, তেমনই দোকানিদেরও স্বাধীনতা আছে তাদের ব্যবসা চালিয়ে যাওয়ার।
দক্ষিণ দিল্লির আইএনএ মার্কেটে মাছ-মাংসের এক দোকানি বলেন, পৌর কর্পোরেশন যদি নির্দেশ দেয় তাহলে মানতেই হবে। কিন্তু আমার কাছে যে কয়েক লাখ টাকার মাছ-মাংস মজুত হয়ে আছে, তার কী হবে?
তিনি বলেন, আমার কাছে যে কয়েকজন কাজ করে তাদের দৈনিক আয় গড়ে ২০০ টাকা। তারা এই ছয় দিন কাজ না করলে খাবে কী? আরেক দোকানী বলেন, আমার দোকান থেকে নানা হোটেল রেস্তোরাঁয় মাংস যায়। সেগুলো বন্ধ হয়ে গেলে কী করে চলবে আমার?
দক্ষিণ দিল্লির বাসিন্দা শুভাশীষ দত্ত বলেন, তার খাদ্যাভ্যাস কী হবে, সেটা কেন অন্য কেউ ঠিক করে দেবে?
তিনি বলেন, খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে আমি নিরামিষ খাব না আমিষ খাব, সেটা সম্পূর্ণভাবে আমার সিদ্ধান্ত, আমার ব্যক্তিগত পছন্দ। এটা যদি কেউ আমার ওপর চাপিয়ে দেয়, খারাপ তো লাগবেই।
অনেকে আবার প্রশ্ন করছেন অনেক হিন্দু যখন নবরাত্রিতে পেঁয়াজ রসুনও ছোঁননা, তাহলে সেগুলোর বিক্রি কেন নিষিদ্ধ করা হচ্ছেনা। ‘শুধু মাংসের বেলায় এই সিদ্ধান্ত কেন’? টুইটারে একজন লিখেছেন, ‘হোটেলে গিয়ে মাংস খাওয়া চলবে। অনলাইনে বিক্রেতারা মাংস সরবরাহ করতে থাকবেন। কিন্তু গরীব মুসলিমদের মাংসের দোকান খোলা রাখলেই শুধু হিন্দুদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগে’।
অনেক দোকান মালিক এমন কোনো নির্দেশনা না পেলেও ভয়ে তারা বন্ধ রেখেছেন বলে রিপোর্ট করেছে ইংরেজি দৈনিক ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস। যদিও সাধারণ একটি বিশ্বাস রয়েছে যে ভারতের সিংহভাগ মানুষই মাংসভোজী নন, গবেষণা বলছে সে দেশের মাত্র ২০ শতাংশ মানুষ নিরামিষাশী। ভারতের জনসংখ্যার ৮০ শতাংশই হিন্দু এবং তারাই মাংসের প্রধান ভোক্তা। রাজধানী দিল্লির বাসিন্দাদের বড়জোর এক-তৃতীয়াংশ নিরামিষাশী, এবং দিল্লি ভারতের ‘বাটার-চিকেন ক্যাপিটাল’ বলে খ্যাতি পেয়েছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২১২০
আপনার মতামত জানানঃ