কোনোরকম নিয়মনীতির কোনো তোয়াক্কা করছে না কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়ায় আশ্রিত রোহিঙ্গারা। প্রতিনিয়ত ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে দেশের আনাচে-কানাচে। উখিয়া-টেকনাফের ত্রিশটি ক্যাম্পে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গার বসবাস। মিয়ানমারের সামরিক জান্তার নির্যাতনের শিকার হয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে ঢুকে পড়া এসব রোহিঙ্গা এখন প্রতিদিন ক্যাম্প ছেড়ে পালাচ্ছেন। বড় একটি অংশ শিকার হচ্ছেন পাচারের। সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ক্যাম্প ছেড়ে পালিয়ে থাকা প্রায় পাঁচ শতাধিক রোহিঙ্গা আটকের খবর পাওয়া গেছে।
নিয়ম ভেঙে ক্যাম্পের বাইরে আসায় কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়া উপজেলার বিভিন্ন স্থান থেকে ২ নারীসহ ২৮৭ রোহিঙ্গাকে আটক করেছে পুলিশ। গতকাল মঙ্গলবার(০৫ এপ্রিল) রাত নয়টা থেকে আজ বুধবার(০৬ এপ্রিল) বেলা দেড়টা পর্যন্ত টেকনাফ ও উখিয়া থানা-পুলিশ অভিযান চালিয়ে তাদের আটক করে।
এর মধ্যে টেকনাফ থেকে ৭৯ ও উখিয়া থেকে ২০৮ রোহিঙ্গাকে আটক করা হয়। কক্সবাজার জেলা পুলিশ সুপার মোহাম্মদ হাসানুজ্জামান গণমাধ্যমকে এ তথ্য জানান।
এর আগে উখিয়া থেকে ১৩৬ ও টেকনাফ থেকে ৫০ রোহিঙ্গাকে আটক করা হয়। আজ বেলা দেড়টা পর্যন্ত দুটি উপজেলা থেকে মোট ৪৭৩ জন রোহিঙ্গাকে আটক করা হয়েছে।
উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে ২ নারীসহ ৭৯ জন রোহিঙ্গাকে আটক করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন টেকনাফ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. হাফিজুর রহমান। উখিয়া থানার ওসি আহমেদ সনজুর মোরশেদ বলেন, আজ উখিয়া স্টেশন এলাকার আশপাশে অভিযান চালিয়ে ২০৮ রোহিঙ্গাকে আটক করা হয়েছে। তাদের কুতুপালং ট্রানজিট ক্যাম্পে পাঠানোর প্রক্রিয়া চলছে।
পুলিশ সুপার মোহাম্মদ হাসানুজ্জামান বলেন, নিয়ম ভেঙে ক্যাম্প থেকে রোহিঙ্গাদের বের হওয়ার প্রবণতা অনেকে বেড়ে গেছে। এটি নিয়ন্ত্রণ করতে অভিযান অব্যাহত আছে। আটক রোহিঙ্গাদের নিজ নিজ ক্যাম্পের পাশাপাশি উখিয়ার কুতুপালংয়ের ট্রানজিট ক্যাম্পে পাঠানো হচ্ছে।
পুলিশ সুপার জানান, প্রশাসনের অনুমতি ছাড়া ক্যাম্পের বাইরে আসা রোহিঙ্গারা সস্তায় শ্রম বিক্রি করছে। তারা বিভিন্ন পরিবহনে চালক ও চালকের সহকারী বা শ্রমিক হিসেবে কাজ করছে। কেউ কেউ বাসাবাড়িতে গিয়েও কাজ করছে। এতে স্থানীয় শ্রমজীবীরা ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। পাশাপাশি এসব রোহিঙ্গার সঙ্গে স্থানীয় অপরাধীচক্রের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে উঠায় জেলার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
পুলিশের এ কর্মকর্তা বলেন, রোহিঙ্গাদের ক্যাম্পের বাইরে আসার প্রবণতা রোধে পুলিশ অভিযান অব্যাহত রেখেছে। আটকদের ফের নিজ নিজ শিবিরে পাঠানোর হচ্ছে।
এ বিষয়ে অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ সামছু-দৌজ্জা নয়ন বলেন, ক্যাম্পে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের জন্য সরকার ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে সব ধরনের সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। তারপরও কেউ কেউ সচ্ছল জীবনের তাগিদে, আবার কেউ অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে প্রশাসনের অনুমতি ছাড়াই ক্যাম্পের বাইরে যাচ্ছে।
এদিকে টেকনাফ থানার ওসি মো. হাফিজুর রহমান বলেন, টেকনাফ পৌরসভা, সদর, হ্নীলা ও সাবরাং ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের আটক করা হয়। শিবির থেকে অকারণে বাইরে আসার সুযোগ নেই রোহিঙ্গাদের। তাদের নিরাপত্তার জন্য শিবির এলাকাজুড়ে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ করা হয়েছে।
ক্যাম্পে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের জন্য সরকার ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে সব ধরনের সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। তারপরও কেউ কেউ সচ্ছল জীবনের তাগিদে, আবার কেউ অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে প্রশাসনের অনুমতি ছাড়াই ক্যাম্পের বাইরে যাচ্ছে।
টেকনাফ উপজেলা রোহিঙ্গা প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি মোজাম্মেল হক বলেন, ‘ক্যাম্পের বাইরে যাওয়ার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও রোহিঙ্গা শরণার্থীরা সেটা মানছেন না। রোহিঙ্গা শিবিরে এত নিরাপত্তা জোরদার করার পরও তাঁরা কীভাবে ক্যাম্প ছেড়ে বাইরে আসছেন? অথচ স্থানীয় লোকজন অনুমতি ছাড়া ক্যাম্পের ভেতরে ঢুকতে পারেন না’।
মোজাম্মেল হক আরও বলেন, ক্যাম্পের বাইরে এসে কাজ করার কোনো ধরনের বৈধতা নেই রোহিঙ্গাদের। কারণ, তারা প্রতি সপ্তাহে খাদ্যসামগ্রী পাচ্ছেন। ক্যাম্পের বাইরে এসে কাজ করলে স্থানীয়দের শ্রমবাজারের জন্য হুমকি তৈরি হবে।
‘বর্তমানে রোহিঙ্গারা স্থানীয় বাসিন্দাদের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। রোহিঙ্গারা যাতে ক্যাম্প থেকে বাইরে যেতে না পারে, সে জন্য সংশ্লিষ্ট রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত এপিবিএন পুলিশ কর্তৃপক্ষের সুদৃষ্টি কামনা করছি’।
জানা গেছে, রোহিঙ্গারা যাতে দেশের মূল জনস্রোতে মিশে যেতে না পারে সে জন্য টেকনাফ থেকে উখিয়া পর্যন্ত বসানো হয়েছে বেশ কয়েকটি চেকপোস্ট। পুলিশ, বিজিবি, সেনাবাহিনী ও অন্যান্য সংস্থার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা এসব চেকপোস্টে তল্লাশি চালান। রোহিঙ্গাদের অবাধ যাতায়াত রোধ করতে স্থানীয়দের যাতায়াতের ক্ষেত্রে জাতীয় পরিচয়পত্র দেখিয়ে চলাচল করতে হয়। এত সতর্কতা সত্ত্বেও রোহিঙ্গারা ছড়িয়ে পড়ছে দেশের নানা প্রান্তে। জড়িয়ে পড়ছে সামাজিক ও অসামাজিক পেশায়।
প্রতিদিন ভোরে রোহিঙ্গা নারী-পুরুষের অনেকে কাজের সন্ধানে ক্যাম্প থেকে বের হন। সন্ধ্যা বা রাতে কেউ ফেরেন কেউ ফেরেন না এমনটাই জানালেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। যারা ফিরে আসেন না তারা দূরপাল্লার কোনো বাসে বা ট্রাকে চেপে বসেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এক শ্রেণির সদস্য টাকার বিনিময়ে তাদের বাইরে যেতে দেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া অরক্ষিত ক্যাম্পগুলোতে ন্যূনতম কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ার কথা থাকলেও তা এখনো বাস্তবায়ন হয়নি।
বিশ্লেষকরা বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সীমানা প্রাচীর দিতে হবে। নইলে তারা অচিরেই দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যাবে। ইতিমধ্যে অনেকে ক্যাম্প ছেড়ে দেশের নানা প্রান্ত থেকে নাগরিকত্ব সনদও গ্রহণ করেছে বলে জানা গেছে, যা আমাদের জন্য অত্যন্ত হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে কাজ করছেন এমন কয়েকটি বেসরকারি সংস্থা সূত্রে জানা গেছে, রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার সময় সরকারের পক্ষ থেকে হোটেল, রাস্তা, যানবাহনে সার্বক্ষণিক নজরদারি ও তল্লাশির ব্যবস্থা রাখার কথা বলা হলেও বাস্তবে তা অনেকটাই শিথিল।
তারা বলেন, রোহিঙ্গাদের মত কিছু স্থানীয় ব্যক্তিরা পরিস্থিতির জন্য অনেকটা দায়ি। কারণ কম মজুরিতে পাওয়ায় রোহিঙ্গাদের অনেকে নিজেদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, গৃহস্থালী এবং কৃষি ক্ষেত্রে শ্রমিক হিসেবে কাজ করার সুযোগ দেয়। তাই অনেক রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সকল সুবিধা পাওয়ার পরও লোভের বশবর্তী হয়ে কাজের আশায় দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িড়ে পড়ছে। তাই যারা রোহিঙ্গাদের কাজের সুযোগ বা আশ্রয় দিচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮৩৭
আপনার মতামত জানানঃ