নারীদের জন্য পৃথিবীতে নরক হয়ে উঠেছে আফগানিস্তান। হত্যা, নির্যাতন, বাল্যবিবাহ, ধর্ষণ, চাকরির সুযোগ হারানোর পর এবার বিক্রি করা হচ্ছে দাস হিসেবে। ১৯৯৬ সাল থেকেই আফগানিস্তানের নারীদের পথচলা অন্য যে কোনো দেশের তুলনায় বেশি বন্ধুর। এক পা এগোলে দশ পা পিছিয়ে যেতে হয় তাদের। দেশের শাসনব্যবস্থা বদলের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যায় আফগান নারীর জীবনযাত্রা। চলার পথের প্রতিবন্ধকতাও বেড়ে যায়।
গত আগস্টে কাবুলের নিয়ন্ত্রণ নেয়া তালিবান দাবি করেছিল, তারা পাল্টেছে অনেকটায়। নব্বইয়ের দশকের কট্টর অবস্থান থেকে বেশ উদার হবে এবার।
তবে গোটা আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ পোক্ত করার পর নারীদের নব্বইয়ের দশকের সেই শাসনের মতোই ঘরবন্দি করে ফেলেছে তারা।
নতুন সিদ্ধান্ত হচ্ছে, নারীরা ঘরের বাইরে যেতেই পারবেন না, যদিও আগে সিদ্ধান্ত ছিল পুরুষ সঙ্গে থাকলে যাওয়া যাবে।
মেয়েদের স্কুলে যাওয়া নিষিদ্ধ করার কিছুদিনের মধ্যে গত বুধবার এই নির্দেশ জারি করেছে তালিবান সরকার। কেবল তা-ই নয়, স্কুলের ইউনিফর্ম যথাযথ নয় দাবি করে কিছুদিন আগে হাজার হাজার ছাত্রীকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিল তালিবান।
আফগানিস্তানের সর্বোচ্চ নেতা হিবাতুল্লাহ আখুন্দজাদার বরাতে তালিবান নেতা ক্বারি এহসানউল্লাহর লেখা নতুন আদেশের চিঠিটি হাতে পেয়েছে ভাইস ওয়ার্ল্ড নিউজ।
চিঠির একটি অংশ গাঢ় করে লেখা। সেখানে বলা হয়েছে, তিনি আখুন্দজাদাকে বলতে শুনেছেন যে নারীদের অফিসে যাওয়া উচিত নয়, বাড়ির বাইরে যাওয়াও ঠিক না।
গত ১৫ আগস্ট কাবুলের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার পর তালিবান এমনটাও বলেছিল যে, সরকারে নারীরা যোগ দিতে পারবে। চাকরি করতে পারবে।
কিন্তু পরে অবস্থান পাল্টায়। কর্মজীবী নারীদেরকে ‘আপাতত’ ঘরে থাকার নির্দেশ দেয়া হয়। কারণ ব্যাখ্যা করে বলা হয়, তাদের যোদ্ধারা এখনও নারীদেরকে কর্মস্থলে দেখতে অভ্যস্ত নয়, তাদেরকে সময় দিতে হবে।
শুরুতে বলা হয়, মেয়েদের শিক্ষায় কোনো বাধা দেবে না তালিবান। পরে নারী শিক্ষা চালু করার ক্ষেত্রে দফায় দফায় সিদ্ধান্ত পাল্টানো হয়।
নতুন সিদ্ধান্ত হচ্ছে, নারীরা ঘরের বাইরে যেতেই পারবেন না, যদিও আগে সিদ্ধান্ত ছিল পুরুষ সঙ্গে থাকলে যাওয়া যাবে।
গত সেপ্টেম্বরে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে বলা হয়, ‘সুযোগ-সুবিধার ওপর ভিত্তি করে নারী শিক্ষার্থীদের জন্য নারী শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে। নারী ও পুরুষ শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকার ও বের হওয়া পথ আলাদা হতে হবে।’
কাবুল দখলের সাত মাসের মাথায় নানা সমালোচনার পর তালিবান মেয়েদের স্কুল খুলে দিলেও কয়েকদিন পরেই তা বন্ধ করে দেয়া হয়।
গত মার্চে আফগানিস্তানের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নোটিশে বলা হয়, ইসলামি আইন ও আফগান সংস্কৃতির সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ পরিকল্পনার আগে মেয়েদের স্কুল বন্ধ থাকবে।
এমনকি নারী মন্ত্রণালয়ের নামও পাল্টে দেয়া হয়। এই মন্ত্রণালয়ের নতুন নাম ‘ন্যায়-অন্যায় মন্ত্রণালয়’ করা হয়েছে।
তালিবানের সবশেষ শাসনামলে (১৯৯৬ থেকে ২০০১) নারীরা কাজ করতে পারত না। মেয়েদের স্কুলে যাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা ছিল। নারীরা বাড়ির বাইরে বের হলে চেহারা ঢেকে ও পুরুষ সঙ্গীকে নিয়ে বের হতে হতো।
যারা এই আইন অমান্য করতেন ইসলামি শরিয়া আইনের কট্টর ব্যাখ্যার অধীনে তাদের জনসমক্ষে পেটাত তালিবানের ধর্মীয় পুলিশ।
রাজনৈতিক সমঝোতার জন্য সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ব্যর্থ আলোচনা চালানো তালিবান পশ্চিমাদের কথা দেয়, নারীরাও ‘ইসলামী আইন’ অনুযায়ী কাজ করা ও শিক্ষা গ্রহণের সমান অধিকার পাবেন।
২০ বছর পর গত ১৫ আগস্ট আফগানিস্তান দখলে নেয় তালিবান। এরপর সেপ্টেম্বর মাসের শুরুতে তালিবান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রথম মন্ত্রিসভার ঘোষণা দেয়। অবশ্য সরকার গঠন করলেও বিশ্বের কোনো দেশই এখনও পর্যন্ত তালিবান সরকারকে স্বীকৃতি দেয়নি। এর জেরে বিশ্বের অধিকাংশ দেশ ও এর পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বিভিন্ন দাতা সংস্থাও আফগানিস্তানে মানবিক সহায়তাসহ অর্থ সাহায্য পাঠানো বন্ধ করে দেয়।
অধিকাংশ দেশ তালিবান শাসনাধীন আফগানিস্তানকে স্বীকৃতি না দিলেও তারা বারবার মানবধিকার ও নারী অধিকারের বিষয়টি তুলেছে। তাদের অন্যতম দাবি ছিল, মেয়েদের শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। তালিবান সরকারের স্বীকৃতি এবং আফগানিস্তানকে ত্রাণসাহায্য দেওয়ার ক্ষেত্রেও নারী অধিকার ও শিক্ষার বিষয়টি তারা সামনে এনেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, তালিবানের আফগান দখলের পর থেকেই দেশটিতে নারীদের অবস্থান নিয়ে নানা ধরনের শঙ্কা ইতিমধ্যে তৈরি হয়েছে। অত্যাচার নিপীড়নের পাশাপাশি বাড়ি থেকে কম বয়সী নারীদের জোর করে তুলে নিয়ে যাওয়া এমনকি মৃতদের ধর্ষণের অভিযোগও উঠেছে তালিবানের বিরুদ্ধে। আফগানিস্তানে নারী শিক্ষার অগ্রযাত্রা থমকে যাওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে বলে অনেকের ধারণা। কর্মজীবী নারীদের উপর নেমে আসছে নিয়মের খড়গ।
আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা প্রত্যাহার শুরু হওয়ার পর গত কয়েক মাসে পুরো পাল্টে গেছে দেশটির চেহারা। একের পর এক এলাকার দখলে নিয়েছে তালিবান। এরই মধ্যে আফগান নারী ও পুরুষের ওপর নানা বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। নারীরা বাড়ির বাইরে গেলে অবশ্যই তাদের বোরকা পরতে হবে। এ ছাড়া এ সময় তাদের সঙ্গে অবশ্যই একজন পুরুষ থাকতে হবে। ফলে নারীদের বাইরে চলাফেরা কঠিন হয়ে পড়েছে। ভয়ে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন নারীরা।
তালিবান শরিয়া মোতাবেক নারী স্বাধীনতা দেওয়ার ঘোষণা দিলেও আফগান নারীদের আতঙ্ক কাটেনি। তারা বলছেন, তালিবানের অতীত শাসনে যেভাবে নারীদের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছিল, তারই পুনরাবৃত্তি ঘটবে কি না, তা নিয়ে শঙ্কায় তারা।
আফগান নারী ও মেয়ে শিশুদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি ভাঙায় তালিবানের কঠোর নিন্দা জানিয়েছেন জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস।
অ্যান্তোনিও গুতেরেস বলেন, ‘আফগান নারী ও মেয়ে শিশুদের দেওয়া তালিবানের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ হতে দেখে আমি বিশেষ শঙ্কিত। আমি জোরালোভাবে তালিবানকে নারী ও মেয়ে শিশুদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষার এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার এবং মানবিক আইনের বাধ্যবাধকতা মেনে চলার আহ্বান জানাচ্ছি।’
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২০০৭
আপনার মতামত জানানঃ