কিয়েভ থেকে সামান্য দূরে বুচা শহরে একটি গির্জার পাশে ৪৫ ফুট গভীর ট্রেঞ্চ বা গর্তের সন্ধান মিলেছে। সেখানে অসংখ্য সাধারণ মানুষের মৃতদেহ মিলেছে। রাশিয়ার সেনা ওই ব্যক্তিদের উপর অত্যাচার চালানোর পর তাদের হত্যা করা হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
রাশিয়ার সেনা এলাকা ছাড়ার পরেই ওই কবরের সন্ধান মেলে। রাজধানী কিয়েভ ছেড়ে ধীরে ধীরে পিছু হঠেছে রাশিয়ার সেনা। তারপরেই যুদ্ধের ভয়াবহতার ছবি ক্রমশ স্পষ্ট হতে শুরু করেছে।
ইউক্রেনের দাবি
ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভের আশপাশের এলাকা থেকে রুশ বাহিনী সরে যাওয়ার পর বুচা শহরে ৪১০টি মৃতদেহের সন্ধান পেয়েছে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ। রাশিয়ার সম্ভাব্য যুদ্ধাপরাধের বিষয়ে তদন্ত শুরু করতে গিয়ে এসব মৃতদেহ খুঁজে পেয়েছে তারা।
গতকাল রোববার ইউক্রেনের শীর্ষ প্রসিকিউটর বলেছেন, এ বিষয়ে প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু, তারা এতটাই মর্মাহত যে কথাও বলতে পারছে না। খবর রয়টার্সের।
গত শনিবার কিয়েভের আশপাশের এলাকা থেকে রাশিয়ার সেনা প্রত্যাহার করা হয়। এরপর শহরগুলোর বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে সংবাদমাধ্যমে খবর প্রচার শুরু হয়। রাজধানী কিয়েভের পার্শ্ববর্তী বুচা শহরের মেয়র বলেছেন, চেচেন যোদ্ধারা এলাকাটি নিয়ন্ত্রণ করার সময় রাশিয়ান বাহিনীর হাতে তিন শ জন বাসিন্দা নিহত হয়েছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের দাবি
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বেসরকারি মহাকাশপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান মাক্সার টেকনোলজিস বলেছে, ইউক্রেনের বুচা শহরের একটি গির্জায় ৪৫ ফুট দীর্ঘ পরিখায় গণকবর শনাক্ত হয়েছে। স্থানীয় সময় গতকাল রোববার স্যাটেলাইট চিত্র প্রকাশ করে এমন দাবি করেছে মাক্সার। খবর রয়টার্সের।
ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভের ৩৭ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর বুচা। প্রায় এক মাস ধরে রুশ সেনাবাহিনীর দখলে থাকার পর সম্প্রতি এর নিয়ন্ত্রণ নেয় ইউক্রেন। ইতিমধ্যে স্থানীয় মেয়র জানিয়েছেন, শহরের রাস্তায় রাস্তায় মরদেহ পড়ে আছে। অনেককে গণকবর দেওয়া হচ্ছে।
গত শনিবার রয়টার্সের সাংবাদিকেরা বুচা শহর পরিদর্শন করেছেন। তারা বলেন, একটি গির্জা এলাকায় শনাক্ত হওয়া গণকবর এখনো উন্মুক্ত অবস্থায় আছে। সেখানে দেখা গেছে, লাল কাদামাটি ভেদ করে মানুষের হাত–পা বের হয়ে আছে।
এরই মধ্যে নতুন স্যাটেলাইট চিত্র প্রকাশ করেছেন মাক্সার টেকনোলজিস। তারা বলেছে, সেন্ট অ্যান্ড্রু অ্যান্ড পেয়ারভজভান্নোহো অল সেইন্টস গির্জায় গণকবরের সন্ধান পাওয়া যায় গত ১০ মার্চ। আর গত ৩১ মার্চ দেখা গেছে, গির্জা এলাকার দক্ষিণ–পশ্চিম অংশে প্রায় ৪৫ ফুট দীর্ঘ পরিখাযুক্ত একটি সমাধিস্থল রয়েছে।
কতটা সত্য এই অভিযোগ
রয়টার্স বলছে, মাক্সার প্রকাশিত স্যাটেলাইট চিত্রগুলো তাৎক্ষণিকভাবে যাচাই করা যায়নি। শনিবার রয়টার্সের সাংবাদিকেরা যে গির্জা পরিদর্শন করেছেন, সেটি আর মাক্সার প্রকাশিত স্যাটেলাইট চিত্রের গির্জাটি একই কি না, তাও নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
গতকাল ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপি বলেছে, তাদের সাংবাদিকেরাও বুচা শহর পরিদর্শন করেছেন। শুধু বুচা শহরের একটি রাস্তাতেই কমপক্ষে ২০টি মরদেহ পড়ে থাকতে দেখেছেন তারা। মরদেহগুলোর সবার পরনে ছিল বেসামরিক পোশাক।
বুচার মেয়র আনাতোলি ফেদোরুক বলেন, ‘এসব মানুষকে মাথার পেছন দিক থেকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে।’ তবে রুশ বাহিনীর সঙ্গে লড়াইয়ে ঠিক কতজন বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছে, তা নিশ্চিত করতে পারেননি তিনি।
গতকাল ইউক্রেন অভিযোগ করেছেন, রুশ বাহিনী বুচা শহরে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে। রাশিয়া এ অভিযোগ অস্বীকার করেছে। উল্টো একে ইউক্রেনের উসকানিমূলক আচরণ বলে উল্লেখ করেছে তারা।
জেলেনস্কির বক্তব্য
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি বলেছেন, ওই কবর থেকে যাদের দেহ উদ্ধার হয়েছে, তারা প্রত্যেকেই সাধারণ মানুষ। সেনা নয়। তাদের শরীরে অত্যাচারের স্পষ্ট চিহ্ন আছে। পিছন থেকে তাদের মাথায় গুলি করা হয়েছে বলেও বোঝা যাচ্ছে।
এই ভয়াবহতার বিচার চেয়ে বিশ্ব রাজনীতির কাছে আর্জি জানিয়েছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট। তার বক্তব্য, ওই একটি কবরই বুঝিয়ে দেয়, রাশিয়া কী কাণ্ড করেছে। এছাড়াও কিয়েভ, বুচা-সহ একাধিক শহরে রাস্তায় মৃতদেহ ছড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে।
বস্তুত, গণকবরের ছবি উদ্ধার হওয়ার পরে বিশ্বের একাধিক দেশ এর বিরোধিতা করেছে। জার্মান চ্যান্সেলর ওলফ শলৎস রাশিয়ার বিরুদ্ধে নতুন নিষেধাজ্ঞা জারি হবে বলে জানিয়েছেন।
ম্যার্কেল, সারকোজির দিকে আঙুল
২০০৮ সালে ইউক্রেনকে ন্যাটোর সদস্য পদ দেওয়ার প্রক্রিয়া প্রায় সম্পূর্ণ হয়ে গেছিল। অ্যামেরিকার উদ্যোগে সে কাজ হচ্ছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে জার্মানি এবং ফ্রান্স বাধা দেয়। সে সময় জার্মান চ্যান্সেলর ছিলেন আঙ্গেলা ম্যার্কেল এবং ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ছিলেন নিকোলাস সারকোজি।
দুই বিশ্বনেতা জানান, ইউক্রেন এখনো ন্যাটো যোগ দেওয়ার জন্য প্রস্তুত নয়। আরো কিছুদিন পর এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হোক। বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, ইউক্রেনকে সদস্যপদ দিলে রাশিয়া আক্রমণাত্মক মনোভাব নিতে পারে, এই আশঙ্কাতেই ওই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ম্যার্কেল এবং সারকোজি।
রোববার জেলেনস্কি বলেছেন, ম্যার্কেল এবং সারকোজি গিয়ে ইউক্রেনের গণকবর দেখে আসতে পারেন। তাদের সিদ্ধান্তের জন্যই আজ ইউক্রেনকে এই সংকটে পড়তে হয়েছে।
ইউক্রেনের এই পরিস্থিতির জন্য ওই দুই বিশ্বনেতাকে সরাসরি দায়ী করেছেন জেলেনস্কি। তবে জেলেনস্কির ওই বক্তব্যের পর জার্মানি বা ফ্রান্স কেউই কোনো মন্তব্য করেনি।
কী বলছে রাশিয়া?
বুচায় বেসামরিক লোকদের হত্যার অভিযোগ অস্বীকার করেছে রাশিয়া। মস্কো বলেছে, সেখানকার কোনো বাসিন্দাই রাশিয়ান বাহিনীর সহিংসতার শিকার হয়নি। উল্টো এ বিষয়ে কিয়েভকে দোষারোপ করে রাশিয়া বলছে, পশ্চিমা সংবাদমাধ্যম ব্যবহার করে উসকানিমূলক সংবাদ ছড়াচ্ছে ইউক্রেন।
এসডব্লিউ/এসএস/১৪৩০
আপনার মতামত জানানঃ