সামরিক শক্তিতে দুনিয়ার দ্বিতীয় রুশ বাহিনীর আগ্রাসনে ইউক্রেন এখন বাস্তবিকই দুনিয়ার নরকে পরিণত হয়েছে। বোমারু বিমান থেকে সামরিক স্থাপনার পাশাপাশি মানুষের ঘরবাড়ি, বিদ্যালয়সহ অন্যান্য স্থাপনায় চলছে বোমা হামলা। ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় বিধ্বস্ত হচ্ছে বাড়িঘর-স্থাপনা। অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ন্ত্রণে নিতে গিয়ে সংঘাতেও জড়িয়েছে দুই পক্ষ। একের পর এক শহর চারদিক থেকে ঘিরে বিমান, যুদ্ধজাহাজ, ক্ষেপণাস্ত্র ও ট্যাঙ্কের সাহায্যে দখলে নেওয়া হচ্ছে। সামরিক ব্যক্তিদের সঙ্গে বেসামরিক মানুষেরাও হতাহত হচ্ছেন। সেই মিছিলে নারী ও শিশুরাও বাদ যাচ্ছেন না।
ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের যুদ্ধের এক মাস পেরিয়ে গেছে। প্রকৃতপক্ষে সেখানে দুটি যুদ্ধ চলছে। একটি হলো ইউক্রেনের শহর এবং বেসামরিক লোকজনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার যুদ্ধ এবং আরেকটি হলো ইউক্রেনের সশস্ত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে রুশ সেনাদের যুদ্ধ। প্রথমোক্ত লড়াইয়ে রাশিয়ার জয় হচ্ছে। শেষোক্ত লড়াইয়ে ইউক্রেন জিতছে। তবে পুতিনের পরিকল্পনা নিয়ে অন্ধকারে পশ্চিমারা।
গত শুক্রবার (১ এপ্রিল) মারিউপোলে রাশিয়া ও ইউক্রেনের কর্মকর্তারা সাময়িক যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছেন। পাশাপাশি শহরটি থেকে অধিবাসীদের নিরাপদে সরিয়ে আনারও পরিকল্পনা করা হয়েছে ।
এর আগে বৃহস্পতিবার ৪৫টি বাস মারিউপোলের দিকে যাত্রা শুরু করে। ত্রাণসামগ্রী নিয়ে আসা ওই বাসগুলোতে করেই নাগরিকদের শহর থেকে সরিয়ে নেওয়ার কথা রয়েছে।
ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অব দ্য রেডক্রস-এর একজন মুখপাত্র এ প্রচেষ্টাকে ‘নিদারুণভাবে গুরুত্বপূর্ণ’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। মারিউপোলে এখনো এক লাখের মতো বেসামরিক মানুষ আটকে আছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
কর্মকর্তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী রাশিয়ান সেনারা দখলকৃত চেরনোবিল পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে সরে যেতে শুরু করেছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, পূর্বাঞ্চলীয় দনবাস অঞ্চলে অভিযান চালানোর জন্য মারিউপোলকে ব্যবহার করতে পারে মস্কো। এজন্য শহরটি দখল করার যত চেষ্টা তাদের। দনবাসে ইউক্রেনের বাহিনীকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলার পরিকল্পনা করছে রাশিয়ান সেনাবাহিনী।
এ মুহূর্তে পশ্চিমা কর্মকর্তারা রাশিয়ার পরবর্তী পদক্ষেপ বুঝতে চেষ্টা করছেন। চেরনোবিল থেকে রাশিয়ার সেনা অপসারণ, শুক্রবারে দুই পক্ষের আরও আলোচনা চালানোর প্রস্তুতি, এবং যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক তেল ও গ্যাস সরবরাহে অস্থিরতা; সব মিলিয়ে এখন মারিউপোলের ওপর নজর সবার।
যুদ্ধক্ষেত্রে রাশিয়ার ফ্রন্টলাইনে বিশৃঙ্খলা, আর ওদিকে ক্রেমলিনে সর্বোচ্চ পর্যায়ের নেতৃত্বের মধ্যে চাপ; এসবের পাশাপাশি এখন নতুন করে শোনা যাচ্ছে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন তার উপদেষ্টাদের কাছ থেকে ক্রমাগত দূরে সরে যাচ্ছেন।
ব্রিটেনের সিগন্যালস ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির প্রধান জেরেমি ফ্লেমিং বৃহস্পতিবার এক বক্তব্যে বলেছেন, রাশিয়ান সেনাদের মনোবল ভেঙে পড়েছে। তাদের অস্ত্রশস্ত্রের সংখ্যাও কমে গেছে। অনেক সেনা আদেশ মানতে অপারগতা প্রকাশ করেছেন। নিজেদের যন্ত্রপাতি নিজেরাই ক্ষতিগ্রস্ত (স্যাবোটেজ) করেছেন তারা। এমনকি তারা নিজেদের একটি বিমানও ভূপাতিত করেছেন।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, মনে হচ্ছে পুতিন এখন স্বেচ্ছায় অন্যদের কাছ থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখেছেন। কিছু কিছু ব্যাপার দেখে ধারণা করা হচ্ছে তিনি নিজের কিছু উপদেষ্টাকে বরখাস্ত করেছেন, কাউকে কাউকে গৃহবন্দী করেছেন। তবে বাইডেন আরও জানান, এ মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে এসব দাবির কোনো শক্ত প্রমাণ নেই।
বৃহস্পতিবার জো বাইডেন ও ন্যাটো মহাসচিব জ্যঁ স্টলটেনবার্গ রাশিয়ার কিয়েভ শহরের চারপাশ থেকে সেনা সরানোর দাবি বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।
স্টলটেনবার্গ বলেন, মস্কো এর আগেও মিথ্যা বলেছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে মনে হচ্ছে তারা স্রেফ নতুন করে আক্রমণের জন্য সৈন্যদের অবস্থান পরিবর্তন করছে।
ব্রাসেলসের এক সংবাদ সম্মেলনে স্টলটেনবার্গ মন্তব্য করেছেন, ‘আমরা রাশিয়াকে এর কাজ দেখে বিচার করতে পারি, তাদের মুখের কথায় নয়। আমাদের গোয়েন্দাদের তথ্য অনুযায়ী রাশিয়ান সেনারা জায়গা ছাড়ছেন না বরং নতুন করে ভিন্নভাবে অবস্থান নিচ্ছে।’
ইউক্রেনের জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী গারম্যান গালুশশেঙ্কো বলেছেন, রাশিয়ান সৈন্যরা চেরনোবিলের মূল অংশ থেকে কেবল সরছে। অনেক সেনা এখনো ওই প্ল্যান্ট এলাকায় অবস্থান করছে। বাকিদের মতো তিনিও ‘রাশিয়ানদের পরবর্তী চাল কেউই বলতে পারে না’ বলে মনে করেন।
ইউক্রেনের রাষ্ট্রায়ত্ত আণবিক শক্তি ফার্ম এনার্গোঅ্যাটম টেলিগ্রাম-এ এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, রাশিয়ান বাহিনী ইউক্রেন কর্তৃপক্ষের কাছে চেরনোবিলের কর্তৃত্ব হস্তান্তর করছে। যদিও এ দাবি এখনো স্বাধীনভাবে যাচাই করা সম্ভব হয়নি।
কিছু খবর অনুযায়ী চেরনোবিল ছেড়ে যাওয়া রাশিয়ার অনেক সেনা উচ্চমাত্রার তেজস্ক্রিয়তার কবলে পড়েছেন ও এ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন অসুস্থতার চিহ্ন তাদের শরীরে দেখা গিয়েছে। তবে বৃহস্পতিবার পেন্টাগন জানিয়েছে, এ খবরের সত্যতা নিয়ে সংস্থাটি এখনো নিশ্চিত নয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট ইতোমধ্যে রাশিয়ার প্রযুক্তি সেক্টরের ওপর নতুন নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। এ নিষেধাজ্ঞার আওতায় আছে রাশিয়ার সেনাবাহিনীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তি সংগ্রহের খাত, রাশিয়ার মাইক্রোচিপ তৈরির সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি।
‘আমরা পুতিনের ‘ওয়ার মেশিন’কে লক্ষ্য করে প্রতিটি দিক থেকে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে যাব যতক্ষণ না এ কাণ্ডজ্ঞানহীন যুদ্ধ শেষ না হয়,’ এক বিবৃতিতে এমনটা জানিয়েছেন ট্রেজারি ডিপার্টমেন্টের সচিব জ্যানেট এল. ইয়েলেন।
ওদিকে ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ পুতিনের উপদেষ্টাদের তাকে ইউক্রেন আক্রমণের বিষয়ে ভুলপথে পরিচালনা করার দাবি নাকচ করে দিয়েছেন।
‘তারা (পশ্চিমা সরকার ও গোয়েন্দা) প্রেসিডেন্ট পুতিনকে বোঝেন না। তারা এই সিদ্ধান্ত-প্রণয়ন প্রক্রিয়াটি বোঝেন না, এবং তারা আমাদের কাজের শৈলীও বুঝতে পারেন না,’ মন্তব্য করেন পেসকভ।
বৃহস্পতিবার পুতিন ঘোষণা দিয়েছেন, ‘অবন্ধুসুলভ দেশগুলো’কে প্রাকৃতিক গ্যাস কেনার জন্য রাশিয়ার ব্যাংকের মাধ্যমে রুবলে দাম পরিশোধ করা বিষয়ক একটি ডিক্রি জারি করেছেন তিনি। তিনি আরও জানান, যারা এ নিয়ম মানবে না তাদের সাথে চলমান চুক্তি বাতিল করা হবে। আজ শুক্রবার (১ এপ্রিল) থেকে এ শর্ত কার্যকর হওয়ার কথা রয়েছে।
তবে রুবলের বিনিময়ে গ্যাস কেনার রাশিয়ান শর্ত প্রত্যাখ্যান করছে ব্রিটিশ, ফ্রেঞ্চ, ও জার্মান কর্তৃপক্ষ। এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে জার্মান অর্থমন্ত্রী ক্রিস্টিয়ান লিন্ডনার ও ফরাসি অর্থমন্ত্রী ব্রুনো লে মারি বলেছেন, তারা ইউরো মুদ্রাতেই গ্যাসের দাম পরিশোধ করবেন। ওদিকে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের একজন মুখপাত্র সাংবাদিকদের বলেছেন, রুবলে গ্যাসের দাম পরিশোধ করা নিয়ে ‘আমরা আগ্রহী নই’।
বুধবার প্রকাশিত নতুন একটি ড্রোন ভিডিওতে মারিউপোলে বিস্তীর্ণ ধ্বংসযজ্ঞ দেখা গিয়েছে। ওই ভিডিও দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট কর্তৃক যাচাই করা হয়েছে। ওই ভিডিওতে ২০২১-এর মারিউপোলে শহর ও এখনকার শহরের অবস্থা তুলনা করা হয়েছে।
মারিউপোলের ধ্বংসযজ্ঞের সাথে ২০১৬ সালে সিরিয়ার আলেপ্পো’র ধ্বংসের তুলনা করা হয়েছে। সেসময় রাশিয়ার বাহিনী সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদকে সাহায্য করতে বিরোধীদের দমন করার জন্য আলেপ্পোতে আট মাসের ক্যাম্পেইনে ক্লাস্টার বোমা, রাসায়নিক অস্ত্রসহ অন্যান্য নিষিদ্ধ অস্ত্র ব্যবহার করেছিল। তার সঙ্গে সঙ্গে ভারী গোলাবর্ষণ ও গতানুগতিক বিমানহামলা তো ছিলই।
সিরিয়ায় রাশিয়ান বাহিনীর নেতৃত্ব দিয়েছিলেন কর্নেল জেনারেল মিখাইল মিজিন্তসেভ। তিন-তারকা এ জেনারেল মারিউপোল আক্রমণের নেতৃত্বও দিয়েছেন। সেজন্য তার কপালে নতুন নাম জুটেছে: মারিউপোলের কসাই। ইউক্রেনের কর্মকর্তারা মারিউপোলের মা-শিশু হাসপাতাল, ড্রামা থিয়েটার, ও অন্যান্য ভবনে বোমা হামলার জন্য তাকে দায়ী করেছে। এজন্য তাকে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে শাস্তি দেওয়ার শপথ নিয়েছে ইউক্রেন।
মারিউপোল থেকে কয়েক হাজার মানুষকে সরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। তাদেরকে ইউক্রেন-নিয়ন্ত্রিত জাপোরিজজিয়া শহরে নেওয়া হবে। রাশিয়া বা ইউক্রেন, কোনো দেশের কর্তৃপক্ষই নির্দিষ্ট করে জানায়নি কখন যুদ্ধবিরতি বা অপসারণ কাজ শেষ হবে। তবে ইউক্রেন জানিয়েছে তাদের সৈন্যরা একটি ‘পূর্ণ যুদ্ধবিরতির নিশ্চয়তা দেবে’।
ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অব দ্য রেড ক্রস-এর একজন মুখপাত্র জানিয়েছেন নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সাহায্য করার জন্য রেড ক্রস-এর দল বেসামরিক নাগরিকদের বহনকারী কনভয়ের সাথে থাকবে।
ইউক্রেনের ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী ইরিয়ানা ভেরেশচুক টেলিগ্রাম-এ দেওয়া এক বার্তায় জানিয়েছেন, ৩০টিরও বেশি বাস মারিউপোলের প্রবেশদ্বারে অপেক্ষা করছে। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর এখন পর্যন্ত প্রায় ৮০ হাজার মানুষকে মারিউপোলে থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
এর আগে স্থানীয় যুদ্ধবিরতি থাকা সত্ত্বেও বৃহস্পতিবার ওই বাসগুলোর কোনো কোনোটিকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়া হয়েছিল। এর আগেও বেসামরিক নাগরিকদের অপসারণের জন্য দেওয়া করিডোর বাধাগ্রস্ত হয়েছিল। তখন দুপক্ষই যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করার জন্য একে অপরের ওপর দোষ চাপিয়েছিল।
এসডব্লিউ/এসএস/২২১৫
আপনার মতামত জানানঃ