বাংলাদেশে একটি গবেষণা বলছে, ইন্টারনেটে পর্নোগ্রাফি সহজলভ্য হওয়ার কারণে নারীর প্রতি পুরুষের অবমাননাকর দৃষ্টিভঙ্গি এবং সহিংসতা বেড়েছে।
বেসরকারি সংস্থা মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন এবং ডি-নেট যৌথভাবে যে গবেষণা পরিচালনা করেছে সেখানে দেখা যাচ্ছে ৩৭ শতাংশ অংশগ্রহণকারী এ মতামত দিয়েছে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় ৫১৮জন নারী ও পুরুষের মধ্যে এই জরিপ পরিচালনা করা হয়।
গবেষণার ফলাফলে বলা হয়, ৮৮ শতাংশ অংশগ্রহণকারী বলেছেন অনলাইনে নারীর প্রতি অবমাননাকর কনটেন্ট বাড়ছে এবং অনেক ক্ষেত্রে এসব কনটেন্ট তৈরিতে নারীদের ব্যবহার করা হচ্ছে। অংশগ্রহণকারী ৮২ শতাংশ নারী ও পুরুষ মনে করছে সমাজে মেয়েদের প্রতি সহিংস ও নির্যাতনমূলক আচরণ বেড়েছে।
পর্নোগ্রাফি দেখলে কী হয়
অনেকে মনে করেন পর্নোগ্রাফি দেখার মধ্যে খারাপ কিছু নেই। ২০১০ সালে তিনশোটিরও বেশি পর্নোগ্রাফি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে তার ৮৮% জুড়ে আছে শারীরিক আগ্রাসনের দৃশ্য।
ওই একই গবেষণায় দেখা গেছে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পুরুষরাই সেই আচরণ করছে এবং তাদের লক্ষ্য হচ্ছে নারী। এবং নারীরা এসব দেখে আনন্দ পাচ্ছে বলেই পর্নোগ্রাফিতে দেখানো হচ্ছে।
পর্নোগ্রাফি দেখে এমন একজন নীলম। তিনি জানান, বয়স্ক পুরুষের সাথে কম বয়সী নারীর যৌন মিলনের ভিডিও দেখতে দেখতে তিনিও, যখন তার বয়স ১৭,১৮,১৯ তখন তিনিও বয়স্ক পুরুষের সাথে সম্পর্ক করতে আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন।
তিনি বলেন, আমি জানি না কেন এরকম হয়েছিল। পর্নোগ্রাফির কারণে নাকি অন্যকিছুর ফলে সেটা আমি বলতে পারবো না।
“যখন আমার বয়স কম ছিল সেক্সের কথা মনে হলেই মনে হতো যে আমাকে প্যাসিভ হতে হবে। সেক্স হচ্ছে এমন একটা জিনিস যা কেউ একজন আমাকে নিয়ে করবে। এটা কি সবসময় আমার মধ্যে ছিল নাকি পর্নোগ্রাফি দেখে আমার মধ্যে এটা তৈরি হয়েছিল?”
আরেকটি গবেষণায় আগ্রাসনধর্মী পর্নোগ্রাফির কী প্রভাব পড়ছে পুরুষের ওপর সেবিষয়ে সুনির্দিষ্ট করে কিছু বলা হয়নি। তবে বলা হয়েছে, এসব পর্নোগ্রাফির সাথে সহিংসতার সম্পর্ক খুব বেশি নয়।
তবে নারীদের ওপর এর কী ধরনের প্রভাব পড়ে সেবিষয়ে জানা যায় আরো কম। নীলম মনে করেন, এবিষয়ে স্কুলের আরো এগিয়ে আসা উচিত যৌন শিক্ষার ব্যাপারে।
“আমার মনে হয় সেক্স এবং পর্ন স্কুলগুলোতে এখনও একটা ট্যাবু। এসব বিষয়ে মেয়েরা জানতে পারবে হয় স্কুলে কিম্বা পর্নোগ্রাফি থেকে। কিন্তু আমি মনে করি না যে পর্নোগ্রাফি থেকে মেয়েরা ভাল যৌন-শিক্ষা পাবে।”
যদিও পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত এরিকা মনে করেন, পর্ন দেখার মধ্যে খারাপ কিছু নেই। এটা হচ্ছে ওয়াইন খাওয়ার মতো। কেউ এক গ্লাস খেয়েই রেখে দেবে আবার অন্য একজনকে হয়তো পুরো বোতলটাই খেয়ে ফেলতে হবে।”
নারীকে সেক্স অবজেক্ট হিসেবে দেখা
বাংলাদেশে হওয়া সাম্প্রতিক গবেষণাটির উদ্যোক্তা মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম বলছেন, নারীর প্রতি সহিংসতা এবং নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির নানা ধরণে এবং নানা অনেক কারণ আছে, পর্নোগ্রাফির সহজলভ্যতা তার মধ্যে একটি বিষয়।
তিনি বলেন, পর্নোগ্রাফি দেখে নারীকে মানুষ হিসেবে বিবেচনা না করে সেক্স অবজেক্ট হিসেবে দেখা হয়।
সাধারণ অর্থে পর্নোগ্রাফি বলতে এক সময় যা বোঝাতো, ডিজিটাল মাধ্যমে আবির্ভাবের সাথে সাথে সেটির ধরনও বদলেছে। এসব পর্নোগ্রাফির দর্শকের বেশিরভাগ হচ্ছে পুরুষ।
তবে কনটেন্ট তৈরির ক্ষেত্রে নারীদেরও ব্যবহার করা হচ্ছে বলে উল্লেখ করেন এই গবেষণার নেতৃত্ব দানকারী বেসরকারি সংস্থা দিয়েছেন ডিনেট-এর পরিচালক সিরাজুল হোসেন।
গবেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের সমাজে নারীর প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি এবং সহিংসতার প্রবণতা ইন্টারনেট বিস্তারের আগেও ছিল।
তবে অনলাইনে পর্নোগ্রাফি সহজলভ্য হাবার কারণে সে প্রবণতাগুলো আরো জোরালো হচ্ছে।
গবেষণায় সুপারিশ করা হয়েছে, এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে পর্নোগ্রাফির বিষয়টিকে শুধু নৈতিকতার দৃষ্টিতে দেখলে হবে না, এটি যে বড় একটি সামাজিক ক্ষতি করছে বিষয়টিকে সেভাবে দেখতে হবে এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে।
পর্নোগ্রাফি ও পুরুষের মস্তিষ্ক
জার্মান গবেষকদের বরাত দিয়ে যুক্তরাজ্যের পত্রিকা ডেইলি মেইল জানিয়েছিল, নিয়মিত পর্নোগ্রাফি দেখার ফলে মস্তিষ্কের একটি বিশেষ অংশ সংকুচিত হয়ে যায়। একই সাথে কমে যায় এর কার্যক্ষমতা।
গবেষকরা জানান, মানুষ যখন পর্নোগ্রাফি দেখে তখন মস্তিষ্কের অন্যতম পরিবাহক (নিউরোট্রান্সমিটার) ডোপামিনে একটি ঢেউ তোলে। এই পরিবাহকটির অন্যতম কাজ আনন্দ এবং সুখের অনুভূতিগুলো বহন করে তার স্মৃতি নিউরণে পাঠিয়ে দেওয়া।
একটা সময় মানুষ পর্নোগ্রাফি দেখা ছাড়তে চাইলেও মস্তিষ্ক অভ্যস্ততা থেকে একই রকম ঢেউ চায়, অর্থাৎ পর্নোগ্রাফি দেখতে আসক্ত হয়ে পড়ে। পাশাপাশি মানুষ বাস্তব জীবনে যৌনক্রিয়া থেকে আগ্রহও হারিয়ে ফেলে।
সাইকোলজি টুডেতে ২০১১ সালে প্রকাশিত অপর এক গবেষণায় দেখা গেছে, নিয়মিত পর্নোগ্রাফি দর্শকদের মস্তিষ্কের একটি বিশেষ অংশ ‘স্টেরিয়াটামের’ আকৃতি ও কার্যক্ষমতা কমতে থাকে। মস্তিষ্কের এই অংশটি উদ্দীপনা গ্রহণ ও সুখানুভূতির সাথে সম্পৃক্ত।
গবেষকরা জানান, এই গবেষণাটি প্রথম দেখিয়েছে নিয়মিত পর্নোগ্রাফি দেখার ফলে মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা কমতে পারে।
এদিকে, ব্রিটেনে এঞ্জেলা গ্রেগরি নামে একজন ব্রিটিশ যৌন থেরাপিস্ট ২০১৬ সালে সংবাদমাধ্যম বিবিসিকে বলেছিলেন, খুব সহজেই দেখা যায় বলে পুরুষদের মধ্যে যৌন সমস্যার সংখ্যা বাড়ছে। এবিষয়ে চিকিৎসা নিতে তারা ডাক্তারদের দ্বারস্থ হতেন। তিনি হাসপাতালে কাজ করতেন।
ব্রিটিশ একটি দাতব্য সংস্থা তার গবেষণায় বলেছে, ব্রিটেনে যখন ব্রডব্যান্ডের যাত্রা শুরু হলো, ২০০০ সালের দিকে, তখন এই পুরুষদের ২ থেকে ৫% যৌন অক্ষমতার জন্যে পর্নোগ্রাফিকে দায়ী করা হতো। বর্তমানে এই হার প্রায় ৩০%।
এটা শুধু শারীরিক অক্ষমতারই কারণ নয়। যুক্তরাষ্ট্রে গবেষকরা বলছেন, যেসব পুরুষ অল্প বয়সে পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত হয়ে পড়ে তাদের মধ্যে পুরুষতান্ত্রিক আধিপত্যও গড়ে উঠতে দেখা যায়।
ব্রিটেনে আরো একজন থেরাপিস্ট থ্যাডিয়াস বির্চার্ড যৌনতায় আসক্তদের চিকিৎসার ব্যাপারে কিছু পরামর্শ দিয়েছেন। সাধারণত পর্নোগ্রাফিতে পুরুষদের চিন্তাভাবনাই প্রতিফলিত হয়।
শিশুদের মধ্যে পর্নোগ্রাফির প্রভাব
যেসব শিশু তাদের ১১ থেকে ১৬ বছর বয়সে পর্নোগ্রাফি দেখে তাদের ৯৪% এসব দেখতে শুরু করে ১৪ বছর বয়স থেকেই। তাদের মধ্যে কিশোর যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে অনেক কিশোরীও।
যুক্তরাজ্যে শিশুদের নিয়ে কাজ করে এরকম একটি দাতব্য সংস্থা প্ল্যান ইউকে এবং ইন্সটিটিউট অফ সাইকোসেক্সুয়াল মেডিসিন শিশুদের ওপর পর্নোগ্রাফির এই প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
তারা বলছে, পর্নোগ্রাফি দেখার ফলে পরবর্তীতে কী ধরনের বিপদ হতে পারে সে বিষয়ে স্কুলে পড়ানো উচিত।
যুক্তরাজ্যে ওয়েলসের, নিকি ব্রায়ান্ট যে অঞ্চলের, সেখানকার স্থানীয় সরকার বলেছে, কীভাবে পর্নোগ্রাফির মতো বিষয়কে স্কুলের পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা যায় তারা এখন সেই উপায় খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে।
সারা ব্রিটেনে ২০১৯ সালে ১৮ থেকে ২৫ বছর বয়সী লোকজনের ওপর চালানো এক জরিপে দেখা গেছে, ৭৭% পুরুষ এবং ৪৭% নারী বলেছে যে জরিপের আগের মাসে তারা পর্নোগ্রাফি দেখেছে।
তবে তাদের বেশিরভাগই বলেছে, পর্নোগ্রাফিতে যে সেক্স দেখানো হয় তার সঙ্গে বাস্তব জীবনের সেক্সের কোন সম্পর্ক নেই। তিন চতুর্থাংশ নারী পুরুষ বলেছেন, পর্নে যেভাবে সেক্স দেখানো হয় সেটা একেবারেই ভিন্ন।
এসডব্লিউ/এসএস/১৪৪০
আপনার মতামত জানানঃ