২০১৯ সালের ৭ অক্টোবর বুয়েটের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে হত্যা করেন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। এই হত্যার দায়ে ছাত্রলীগের ২০ নেতা-কর্মীকে মৃত্যুদণ্ড দেন বিচারিক আদালত। এরপর খুলনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষকের অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনায় ছাত্রলীগের চার নেতা-কর্মীকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করে কর্তৃপক্ষ। দুটি ঘটনাই শিক্ষাঙ্গন তো বটেই, এর বাইরেও চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। তা সত্ত্বেও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের চৈতন্যোদয় ঘটেছে বলে মনে হয় না।
এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) বিজয় একাত্তর হলে মাস্টার্সের এক শিক্ষার্থীর ওপর ছাত্রলীগের কর্মীরা অতর্কিত হামলা চালিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। শনিবার সকালে হলের পদ্মা ব্লকের ২০১০ নম্বর কক্ষে এ ঘটনা ঘটে বলে জানা গেছে।
ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীর নাম মো. আখলাকুজ্জামান অনিক। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার অ্যান্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ বিভাগের ২০১৫-১৬ সেশনের শিক্ষার্থী। আহত হয়ে তিনি এখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
ছাত্রলীগের ওপর হামলার অভিযোগ এনে এবং এর বিচার চেয়ে ইতোমধ্যে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী হল প্রভোস্ট অধ্যাপক ড. আব্দুল বাছির বরাবর একটি লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। অভিযোগপত্রে ১০-১২ জন হামলায় অংশ নেন বলে জানান তিনি। তবে প্রাথমিকভাবে উল্লেখ করেছেন চারজনের নাম।
অভিযুক্তরা হলেন, সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের ২০১৯-২০২০ শিক্ষাবর্ষের মাসফিউর রহমান, ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের সফিউল্লাহ সুমন (পিটার), ম্যানেজমেন্ট বিভাগের সাব্বির আল হাসান, সাংবাদিকতা বিভাগের নাইমুর রশিদ নাঈম।
হামলাকারীরা হল শাখা ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মী ও হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি সজিবুর রহমান সজীবের অনুসারী বলে জানা গেছে। সজীব ছাত্রলীগের ঢাবি শাখা সভাপতি সনজিত চন্দ্র দাসের অনুসারী।
হামলার বিষয়ে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী অনিক বলেন, ‘সকালের দিকে আমি ঘুমে ছিলাম। দরজায় হঠাৎ নক করার শব্দ পাই। দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে আকস্মিকভাবে ১০ থেকে ১২ জন কক্ষে ঢুকে আমার ওপর অতর্কিত হামলা করে। আমি হতভম্ব হয়ে যাই। এ সময় তারা স্ট্যাম্প দিয়ে আঘাত করে আমার মাথা ফাটিয়ে দেয় এবং শরীরের অন্যান্য জায়গায় এলোপাতাড়ি আঘাত করে।’
তিনি বলেন, ‘বিভাগের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের সহযোগিতায় আমি ঢাকা মেডিকেল কলেজে চিকিৎসা নিচ্ছি। হামলাকারীদের মধ্যে শুধু চারজনকে চিনতে পারি। আজ আমার স্নাতকোত্তর ২য় সেমিস্টারের অভিনয় কোর্সের পরীক্ষা আজ সন্ধ্যায় অনুষ্ঠিত হবে।’
এ হামলার পেছনে কোনো কারণ ছিল কি না জানতে চাইলে অনিক বলেন, ‘আজ থেকে তিন দিন আগে হামলাকারীদের কে নাকি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গিয়েছিল মেয়ে নিয়ে। তাদের অভিযোগ, আমি তাদের সঙ্গে সেখানে দুর্ব্যবহার করেছি। অথচ সেদিন আমার পরীক্ষা ছিল। হামলার সময় তারা আমার ফোন কেড়ে নেয়।’
অভিযোগের বিষয়ে জানতে অভিযুক্ত শিক্ষার্থীদের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হলেও রিসিভ না করায় তাদের মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
‘সকালের দিকে আমি ঘুমে ছিলাম। দরজায় হঠাৎ নক করার শব্দ পাই। দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে আকস্মিকভাবে ১০ থেকে ১২ জন কক্ষে ঢুকে আমার ওপর অতর্কিত হামলা করে।
এ বিষয়ে হল ছাত্রলীগের সভাপতি সজিবুর রহমান সজীব ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘পূর্ব একটি ঘটনার জের ধরে আজকের এ ঘটনা ঘটেছে বলে জানতে পেরেছি। যারা এই ঘটনা ঘটিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে হল প্রশাসন তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেবে। এক্ষেত্রে আমাদের পূর্ণ সহযোগিতা থাকবে।’
জড়িতদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি ও আমার সাধারণ সম্পাদক আমরা দুজন দুপক্ষের সঙ্গে কথা বলেছি। হল প্রশাসনকে ঘটনাটি যাচাই-বাছাই করে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করেছি। যদি সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার প্রয়োজন মনে হয় এবং আমাদের সিনিয়র নেতারা নির্দেশনা দেন তাহলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
এ বিষয়ে হল প্রভোস্ট অধ্যাপক ড. আব্দুল বাছির সাংবাদিকদের বলেন, ‘ঘটনাটি শুনেছি। ইতোমধ্যে দায়িত্বরত শিক্ষককে সেখানে পাঠিয়েছি। তিনি কথা বলেছেন। আমরা কাল (রোববার) সকালে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেব।’
এদিকে মানবাধিকারবিষয়ক শিক্ষার্থীদের প্ল্যাটফর্ম ‘স্টুডেন্টস অ্যাগেইনস্ট টর্চার (এসএটি)’ তাদের এক প্রতিবেদনে জানায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) বিভিন্ন হলগুলোতে বিগত পাঁচ মাসে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ১৮ জন শিক্ষার্থী। এছাড়া ৩ জন সাংবাদিক ও দুইজন ফটো সাংবাদিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এসব ঘটনায় নির্যাতকের ভূমিকা পালন করেছে ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা।
প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ৫ অক্টোবর থেকে শুরু করে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত পাঁচ মাসে ছয়টি হলে ১৮ জন শিক্ষার্থী শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছে।
এর মধ্যে স্যার এ এফ রহমান হলে সবচেয়ে বেশি সাতজনকে নির্যাতন করা হয়। মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান, মাস্টারদা সূর্য সেন ও বিজয় একাত্তর হলে নির্যাতন করা হয় তিনজন করে।
রোকেয়া হল ও জগন্নাথ হলে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন একজন করে।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী সালেহ উদ্দিন সিফাত বলেন, বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে চলমান নির্যাতন, নিপীড়ন ও সহিংসতাকে আমরা মানবাধিকারের লঙ্ঘন হিসেবে দেখি। নাগরিকরা কোনো নির্যাতন, নিষ্ঠুর ও অমানবিক দণ্ডের শিকার হবে না- এ প্রতিশ্রুতি দেওয়া যেমন রাষ্ট্রের দায়িত্ব। তেমনি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান কিংবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কর্তৃপক্ষেরও দায়িত্ব শিক্ষার্থীরা যে কোনো নির্যাতন, নিপীড়ন কিংবা সহিংসতার শিকার হবে না, তা নিশ্চিত করা এবং শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করা। কিন্তু আমরা গভীর উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করছি যে, বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীদের মানবাধিকার চরমভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে। এই নির্যাতনের হার সবচেয়ে বেশি আবাসিক হলগুলোর অতিথি কক্ষে। যা নির্যাতিত শিক্ষার্থীদের শিক্ষার অধিকারকেও নীরবে হরণ করছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রায় প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালাচ্ছেন। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগ ছাড়া অন্য কোনো সংগঠনের তৎপরতা নেই বললেই চলে। এরপরও ছাত্রলীগ না করলে বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকতে পারবে না বলে হুমকি দেওয়া তাদের রাজনৈতিক দেউলিয়াত্বই প্রকাশ পেয়েছে।
তারা বলেন, ছাত্রলীগ নামধারী যারা সহপাঠীকে মারধর করেছেন এবং হত্যার হুমকি দিয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে হবে কর্তৃপক্ষকে। অবিলম্বে তাদের গ্রেপ্তার করে বিচারের মুখোমুখি করা হোক। আমরা জানি, অপরাধের বিচার হলে ও অপরাধীরা শাস্তি পেলে তাদের শঙ্কিত হওয়ার কথা। কিন্তু ছাত্রলীগের ছত্রচ্ছায়ায় থাকা সন্ত্রাসীরা এতটাই বেপরোয়া যে শাস্তিও তাদের দুষ্কর্ম থেকে বিরত রাখতে পারছে না। ছাত্রলীগ নেতৃত্ব কীভাবে এর দায় এড়াবে?
বিশ্লেষকরা বলছেন, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একের পর এক সংঘর্ষ ও খুনের ঘটনাসহ বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের জন্য বারবার আলোচনায় আসে ছাত্রলীগ। মাদক ব্যবসা, টেন্ডার-বাণিজ্য, পুলিশকে মারধরসহ একের পর এক নানা অভিযোগ উঠেছে সংগঠনটির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে। ছাত্রলীগ যে আদর্শ ও নীতিতে একটি সংগঠনে রূপ নিয়েছিল সেই আদর্শ এখন আর নেই। বিশ্লেষকরা বলেছেন, আদর্শের চর্চা না থাকার ফলে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের নেতারা দুর্নীতিসহ নানান অনিয়মের সাথে জড়িয়ে পড়ছে।
তারা মনে করেন, ছাত্রলীগ আর আগের মতো আদর্শিক ছাত্রলীগ হতে পারছে না। তারা মনে করেন, ছাত্রলীগ এখন আর ছাত্রলীগের সঙ্গে আদর্শিকভাবে নেই। তারা কোনো ভাই বা সিন্ডিকেটের রাজনীতি করছে। তাদের ভাষ্যমতে, সিন্ডিকেট হলো তারাই, যারা ছাত্রলীগকে ব্যবহার করে অর্থ, সম্পদ, বিত্ত, বৈভব বানিয়েছে। আর ছাত্রলীগও তাদের ব্যবহার করে ধান্দার রাজনীতি করছে।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের দৌরাত্ম্য দিনদিন চাউর হয়ে উঠছে। ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিভিন্ন অপরাধ কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি স্থানীয়ভাবে ক্ষমতার চূড়ান্তে বসবাস করেন। তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসন ও সরকার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে আগ্রহবোধ না করায় তাদের দৌরাত্ম্য আরও বেড়ে চলেছে। ছাত্রলীগের এই আইনের উর্ধে চলে যাওয়ার পেছনে অবশ্য রাজনৈতিক নেতাদের কুৎসিত হাতের ভূমিকা রয়েছে। তারা বলেন, ছাত্রলীগ সংগঠনটির ছাত্রদের ধীরে ধীরে উগ্র এবং একটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীতে রুপদানের পেছনে রয়েছে রাজনৈতিক নেতাদের অনৈতিক মদদ ও উস্কানি। এ বিষয়ে প্রশাসনের জরুরি পদক্ষেপ হস্তক্ষেপ কামনা করেন তারা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮২৬
আপনার মতামত জানানঃ