পাকিস্তানি শাসন শোষণের বিরুদ্ধে দীর্ঘ সংগ্রাম আর সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে নয় মাসের সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালে স্বাধীন হয় বাংলাদেশ। স্বাধীনতা পরবর্তী বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের যে পরিচিতি আর ভাবমূর্তি ছিল সেটি পাল্টেছে বহুভাবে।
স্বাধীনতার ৫ দশকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অগ্রগতিতে বাংলাদেশের ইতিবাচক ইমেজ যেমন তৈরি হয়েছে আবার রাজনীতি ও গণতন্ত্রের প্রশ্নে বাংলাদেশ সম্পর্কে বিশ্বে নেতিবাচক ভাবমূর্তী এখনো দেখা যায়।
স্বাধীন নির্বাচনের ইতি
গণতন্ত্র ও নির্বাচন সমার্থক শব্দ নয়, তবে দ্বিতীয়টি প্রথমটির পরিপূরক। নির্বাচন ছাড়া গণতন্ত্র হয় না আবার গণতন্ত্র ছাড়া নির্বাচন প্রায় অর্থহীন। গণতন্ত্র ছাড়া নির্বাচন আত্মাহীন দেহের মতো। তাই দেশে দেশে গণতন্ত্র পাওয়ার আশায় হাজার বছর ধরে নির্বাচনচর্চা অব্যাহত রয়েছে।
বাংলাদেশে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ছয় মাস পর প্রকাশিত কেন্দ্র-ভিত্তিক ফলাফলে অস্বাভাবিক ভোট পড়ার চিত্র উঠে এসেছিল। ফলাফল পর্যালোচনা করে দেখা যায়, কমপক্ষে ১৯৭টি কেন্দ্রে ১০০% ভোট পড়েছে। আর অন্তত ১ হাজার ৮৮৯টি কেন্দ্রে ভোট পড়েছে ৯৫% থেকে ৯৯.৯৯ শতাংশ।
যা একপ্রকার সম্ভব নয় বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে। জালভোট আর কারচুপির প্রমাণ এই পরিসংখ্যানই। মূলত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনই বাংলাদেশের নির্বাচনব্যবস্থাকে গলা টিপে হত্যা করেছে। আর এই গলা টিপে ধরা হাত দু’টি আওয়ামী লীগের।
বাংলাদেশে ক্ষমতা যেভাবে কেন্দ্রীভূত হয়ে যায়, সেটিকে সুষ্ঠু নির্বাচনের ক্ষেত্রে অন্যতম একটি বাধা হিসাবে দেখেন অধ্যাপক শাহনাজ হুদা। তিনি বলেন, ক্ষমতাটা এমনভাবে তারা প্রয়োগ করে যে ক্ষমতায় না থাকলে তাদের ওপর বিপদ আসতে পারে। এই একটা ধারণা থাকার ফলে তারা ক্ষমতা ছাড়তে রাজি থাকে না। মানে একটা সুষ্ঠুভাবে সরকার পরিবর্তনতো হয় না আমাদের দেশে।
বাংলাদেশে একবারই সুষ্ঠুভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর হয়েছিল বলা যায়। আওয়ামী লীগ সরকার পাঁচ বছরের পূর্ণ মেয়াদ শেষ করে নির্বাচনের জন্য তত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেছিল ২০০১ সালে। সেই নির্বাচনে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট ক্ষমতায় এসেছিল।
কিন্তু জোট সরকারের মেয়াদের শেষদিকে যে তত্বাবধায়ক সরকার গঠনের কথা, সেটিতে নিজেদের পছন্দের লোকজনকে অন্তর্ভুক্ত করার দৃশ্যমান চেষ্টায় লিপ্ত হয় তারা। তাদের সরকারের রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিন আহমেদ নিজেই তত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হয়েছিলেন। তখন উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সেনা সমর্থিত তত্বাবধায়ক সরকার এসেছিল।
এরপর সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী বিল পাশ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বিলোপ করা হয়। ১৯৯৬ সালে তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগের আন্দোলনের মুখে নিরপেক্ষ নির্বাচনের যুক্তিতে সংবিধান সংশোধন করে তত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি প্রবর্তিত হয়েছিল। এই ব্যবস্থায় তিনটি নির্বাচনের পর, আওয়ামী লীগ সংসদে তাদের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার সুবিধে নিয়ে ব্যবস্থাটি বাতিল করে।
১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি সংবিধানে যোগ হওয়ার পর ওই বছরই সপ্তম, ২০০১ সালে অষ্টম ও ২০০৮ সালে নবম সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হয়। আওয়ামী লীগের দাবিতে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক এলেও তাদের উদ্যোগেই বিলুপ্ত হলো তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি।
আর্ন্তজাতিক অঙ্গনে ভাবমূর্তি
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নিয়ে এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় সংকট হলো গণতন্ত্রের প্রশ্নে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রওনক জাহান বলেন, “বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরে কয়েক বছর গণতন্ত্র আমাদের ছিল। আমরা একটা সংবিধান রচনা করে ফেললাম এবং ‘৭৩ এ একটা নির্বাচন হল। অর্থাৎ গণতন্ত্রই আমাদের অন্যতম ফাউন্ডিং প্রিন্সিপাল ছিল।”
“কিন্তু জানতে হবে যে ৭৫ এর পর থেকেই আমরা আর গণতন্ত্রের পথে হাটছি না। ৯০ সাল পর্যন্ত সামরিক শাসনের মধ্যে ছিলাম। ৯১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত আমাদের নির্বাচন করে ক্ষমতার পালাবদল হচ্ছিল। কিন্তু আবার দুই বছরের জন্য পড়ে গেলাম মিলিটারি ব্যাক গর্ভমেন্টের আন্ডারে।”
মিজ জাহান, বলছেন, “তারপরে যদিও আমরা গণতান্ত্রিক নির্বাচন ফেরত আনলাম। কিন্তু ২০১৪ এর পর থেকে আমাদের সব দলের অংশগ্রহণে সেরকম নির্বাচন হচ্ছে না। অর্থাৎ প্রথম থেকে আমাদের যে গণতন্ত্রের একটা স্টেবল সিস্টেম, গণতন্ত্র বলতে যে বোঝায় যে ক্ষমতার পালাবদল কীভাবে হবে সেটা সম্বন্ধে সবার ঐক্য থাকবে। সেটাতো আমরা করতে পারছি না।”
রওনক জাহানের ভাষায়, “গণতন্ত্রের ইমেজ কিছুদিন ভাল ছিল, কিছুদিন খারাপ ছিল। অন্য সূচকে যেমন অর্থনীতি এবং সামাজিক উন্নয়নে ক্রমাগত একটা উন্নয়ন হচ্ছে কিন্তু গণতন্ত্র আমরা দেখছি উঠছে আবার নামছে।”
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ইমেজ সংকট নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর ড. আলী রীয়াজ বলেন, “বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক যাত্রাটা গত এক দশকে ক্রমাগতভাবে এই যাত্রাটা পেছন দিকেই গেছে। বিশেষ করে ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচন কোনো অবস্থাতেই গ্রহণযোগ্যতা বলে বিবেচিত হচ্ছে না।”
“বাংলাদেশে নাগরিক অধিকারগুলো সংকুচিত হয়েছে। মানবাধিকার পরিস্থিতি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফলে বাংলাদেশের এখনকার যে পরিস্থিতি সেটাকে গণতন্ত্র থেকে কেবল পশ্চাতযাত্রাই হচ্ছে না কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান এটাকে স্বৈরতন্ত্রও বলছে।”
যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠিত গণতন্ত্র সম্মেলনে নিমন্ত্রণ না পাওয়া গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের ইমেজ সংকটের একটা বড় দৃষ্টান্ত হিসেবে দেখা হয়। অধ্যাপক আলী রিয়াজ বলছিলেন বাংলাদেশকে কেন সম্মেলনের বাইরে রাখা হল।
“যে তিনটি ক্রাইটেরিয়ার ভিত্তিতে এই আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে এগুলো হচ্ছে কতৃত্ববাদের বিরোধিতা করা, দুর্নীতির মোকাবেলা করা এবং তৃতীয় হচ্ছে মৌলিক মানবাধিকার রক্ষা করা। এই তিনটার কোনটাতেই বাংলাদেশের এখনকার অবস্থা ইতিবাচক নয়। সেই প্রেক্ষাপটেই যুক্তরাষ্ট্রে পররাষ্ট্র দপ্তর মনে করেছে যে বাংলাদেশ এই সম্মেলনে অংশগ্রহণ করতে পারবে না।”
বাংলাদেশ তার নানা অর্জন তুলে ধরে বহির্বিশ্বে উজ্জল ভাবমূর্তী গড়ে তোলার চেষ্টা করেছে সব সময়। ৫১ বছরে এসে দেখা যায় বাংলাদেশ অনেক নেতিবাচক ইমেজ কাটিয়েও উঠেছে।
কিন্তু গণতন্ত্র আর রাজনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে বাংলাদেশের যে ইমেজ সংকট এখনো আছে সেটি থেকে বেরিয়ে আসাই আগামী দিনের বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করা হচ্ছে।
গুম আর বিচারবহির্ভূত হত্যা
স্বাধীনতার ৫১ বছরে ক্রসফায়ার বা কথিত বন্দুকযুদ্ধ এক নৃশংস গণতন্ত্রের রূপ। রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন বাহিনীর হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে বিভিন্ন সময়ে। বর্তমান সরকার পুনরায় ক্ষমতায় আসার পর ২০১৯ সাল থেকে পরবর্তী তিন বছরে ৭১টি গুমের ঘটনা ঘটেছে বলে জানিয়েছে সেন্টার ফর গভর্নেন্স স্টাডিজ (সিজিএস)। এক গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৯ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ৭১টি গুমের ঘটনা ঘটে। সেগুলোতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জড়িত থাকার অভিযোগ পাওয়া গেছে। ৭১ জনের মধ্যে ১৬ জন এখনো নিখোঁজ এবং ৫ জন হত্যার শিকার হয়েছেন।
এ ছাড়া ২২ জনকে পরবর্তীতে আটক কিংবা গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠানো হয়েছে। ২৩ জন গুম হওয়ার পর ফেরত এসেছে এবং ৫ জন সম্পর্কে কোন তথ্য জানাতে পারেনি সিজিএস।
তবে যে ৫১ জনের পেশা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গেছে তাতে দেখা গেছে রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা গুমের শিকার হয়েছে সবচেয়ে বেশি। এই দুই পেশার ১১ জন করে গুমের শিকার হয়েছেন।
সিজিএসের গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত এক দশক বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ গুমের শিকার হয়েছেন। বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার হিসাব অনুযায়ী ২০০৯ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত সর্বমোট ৫২২ ব্যক্তি গুমের শিকার হন। সে হিসাবে আওয়ামী শাসনে মোট ৫৯৩ জন গুমের শিকার হন।
বিএনপির ৩০ নেতাকর্মী আহত
মহান স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে ফুল দিয়ে শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে যাওয়ার পথে বিএনপি নেতাকর্মীদের ওপর যুবলীগ নেতাকর্মীরা হামলা করেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। আহতরা বর্তমানে কলমাকান্দা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি রয়েছেন।
এ ঘটনায় বিএনপির অন্তত ৩০ জন নেতাকর্মী আহত হয়েছেন। শনিবার (২৬ মার্চ) সকালে জেলার কলমাকান্দা উপজেলার ধানমহাল এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।
এ ঘটনায় বিএনপির আহত নেতাকর্মীদের কলমাকান্দা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে। দুপুরে কলমাকান্দা থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুল আহাদ খান ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেন।
ওসি জানান, ধানমহালে একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটেছে। তবে ঘটনাটি কী কারণে ঘটেছে- তা বলতে পারছি না। এ বিষয়ে খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
বিএনপি নেতা ও উপজেলার লেঙ্গুড়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মো. সাইদুর রহমান বলেন, সকাল সাড়ে ৭টার দিকে বিএনপির নেতাকর্মীরা স্মৃতিসৌধে ফুল দিতে যাওয়ার পথে ধানমহাল এলাকায় যুবলীগের নেতাকর্মীরা দেশীয় অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে বিএনপি নেতাকর্মীদের ওপর অতর্কিত হামলা চালায়।
এসডব্লিউ/এসএস/১৪১০
আপনার মতামত জানানঃ