জাতীয় বাজেট, সরকারের নীতি ও পরিকল্পনায় স্বাস্থ্য খাতের উপেক্ষিত হবার ঘটনা নতুন নয়। এছাড়া বাজেট স্বল্পতা, অব্যবস্থাপনা, দুর্বল অবকাঠামো, জনবলের ঘাটতি, অদক্ষতা, দুর্নীতির কারণে আমাদের স্বাস্থ্যসেবা একপ্রকার বিধ্বস্ত। রোগীদের থেকেও জীর্ণ।
নাগরিক সংগঠন বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচ তাদের ২০২০–২১ সালের প্রতিবেদনে বলেছে, মহামারির শুরুতে ভুল তথ্য, গুজব, অতিরঞ্জিত ও মিথ্যা সংবাদ মানুষের মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি করেছিল। চিকিৎসাসামগ্রী সংগ্রহ ও রোগনির্ণয়ে সরকারের নেওয়া পদক্ষেপগুলো ছিল বিতর্কিত। রোগীর জন্য জিনিসপত্র সংগ্রহ, নমুনা পরীক্ষার কিট কেনা, কোভিড–১৯ হাসপাতাল স্থাপন থেকে শুরু করে সাধারণ ওষুধ কেনা পর্যন্ত নানা ক্ষেত্রে ছিল দুর্নীতি।
‘বাংলাদেশে কোভিড–১৯: প্রথম দুই বছর ও সামনের দিনগুলো’ শিরোনামের প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টারে প্রতিবেদনটি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয়।
অনুষ্ঠানে বলা হয়, মহামারি মোকাবিলায় বাংলাদেশ সরকার ও অন্যান্য অংশীজনের গ্রহণকেরা ব্যবস্থা প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে। গৃহীত ব্যবস্থার ভুলগুলো তুলে ধরা হয়েছে এবং ভুল থেকে কী শিক্ষা পাওয়া গেল, সে কথাও প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। ভবিষ্যৎ মহামারি মোকাবিলায় স্বাস্থ্য খাত সংস্কারে করণীয় বিষয়ে প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়েছে। মহামারির সময় দেশে–বিদেশে প্রকাশিত বিভিন্ন গবেষণার তথ্য সমন্বিত করে এই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কোভিড–১৯ বিষয়ে মানুষের ধারণা কম থাকায় ভুল তথ্য ও ধারণা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। বয়স্ক, নারী, শিক্ষায় পিছিয়ে থাকা মানুষ এবং নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে কোভিড–১৯–এর ধারণা তুলনামূলকভাবে কম ছিল। সঠিক তথ্য বা জ্ঞান না থাকার কারণে অনেকের মধ্যে সচেতনতা কম ছিল। বস্তিবাসী ও যৌনকর্মীদের মধ্যে এমন দেখা গেছে। নিয়মনীতি মানার ক্ষেত্রে শহরের দরিদ্ররা কম গুরুত্ব দিয়েছেন। তবে তথ্য দিলেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম গুজব ছড়ানোর প্রধান উৎস ছিল।
স্বাস্থ্য বিভাগের হাতে নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ তুলে ধরে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কোভিড–১৯ মোকাবিলায় ৪০টির বেশি কমিটি করা হয় বিভিন্ন পর্যায়ে। কিন্তু এসব কমিটির কাজে সমন্বয় ও সহযোগিতার ঘাটতি ছিল। শুরুতে শুধু আইইডিসিআরে করোনা পরীক্ষা ও তিনটি সরকারি হাসপাতালে করোনার রোগীর চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। হাসপাতালে সাধারণ ও আইসিউই শয্যা, জনবল, আইসোলেশন ইউনিট, পিপিই—এসবের সংকট ছিল তীব্র। মাত্র ৫০ শতাংশ হাসপাতালে কিছু আইসিইউ সুবিধা এবং ৬২ শতাংশ হাসপাতালে আইসোলেশন ইউনিট ছিল। অপার্যপ্ত প্রশিক্ষণ, কাজের চাপ, বিশ্রামের ঘাটতি, পরিবার থেকে দূরে থাকা—এসব বিষয় সম্মুখসারির স্বাস্থ্যকর্মীদের আশঙ্কাজনক পরিস্থিতির মুখে দাঁড় করায়।
৬৬ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে দুর্নীতি ও সুশাসনের বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়েছে। স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি ছিল দৃশ্যমান। মহামারি স্বাস্থ্য খাতের দুর্বলতাগুলোর মুখোশ খুলে দেয়, পাশাপাশি নতুন দুর্নীতির সুযোগ সৃষ্টি করে। পিপিই ও অন্যান্য সামগ্রী কেনাতে দুর্নীতি হয়েছে। কোভিড–১৯ পরীক্ষায় অনিয়ম হয়েছে ও পরীক্ষার জাল সনদ দেওয়া হয়েছে। দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিতদের জন্য দেওয়া ত্রাণের ক্ষেত্রেএ দুর্নীতি হয়েছে।
রোগীর জন্য জিনিসপত্র সংগ্রহ, নমুনা পরীক্ষার কিট কেনা, কোভিড–১৯ হাসপাতাল স্থাপন থেকে শুরু করে সাধারণ ওষুধ কেনা পর্যন্ত নানা ক্ষেত্রে ছিল দুর্নীতি।
স্বাগত বক্তব্যে বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচের আহ্বায়ক ড. আহমেদ মোশতাক রাজা চৌধুরী বলেন, ‘স্বাস্থ্য খাতে মনোযোগ অনেক কম। তাই প্রতিবছর বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ কম দেখা যায়।’
আলোচনায় অংশ নিয়ে সরকারের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক বে–নজির আহমেদ বলেন, বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচের এই প্রতিবেদন ভালো তথ্যের উৎস হিসেবে কাজ করবে। জনস্বাস্থ্য নিয়ে যাঁরা কাজ করেন, তাদের উপকারে আসবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, করোনা মহামারির মতো এত বড় যুদ্ধে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের আরও সম্পৃক্ত করার দরকার ছিল। স্বাস্থ্যে ভালো কিছু করতে হলে সঠিক ব্যবস্থাপনা জরুরি। শুরু থেকে আমাদের পরিকল্পনায় ঘাটতি ছিল। এ কারণে মানুষের কাছে ভুল বার্তা গেছে। করোনা রোগীর কথা শুনলেই বাড়িতে লাল পতাকা টাঙানো হয়েছে। এর দায় আমাদেরও আছে। এটাকে এক ধরনের ফ্লুয়েঞ্জা বলে ধরে নেওয়া হয়েছে।
বে-নজির আহমদ বলেন, স্থানীয় পর্যায়ে ব্যবস্থাগুলো নিয়ন্ত্রণে স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের না দিয়ে পুলিশ ও প্রশাসনের হাতে দেওয়া হয়েছে।এতে করে কোভিডে আক্রান্তরা সমাজ থেকে বৈষম্যের শিকার হয়েছেন। জেলা প্রশাসকদের এখানে সকল কাজের কাজী বানাতে গিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ছিল না। ফলে পরিকল্পনা হয়েছে এক, মাঠ পর্যায়ে বাস্তবে হয়েছে আরেক। হাসপাতালগুলোতে ইনফেকশন প্রতিরোধী ব্যবস্থা ছিল না। ফলে ডেল্টার সময়ে অক্সিজেনের ঘাটতি দেখা দেয়। এ জন্য জনস্বাস্থ্যে আমাদের সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। প্রতিটি জেলায় ৩০ লাখ মানুষের বসবাস হলেও এপিডেমিওলজি নেই।
তবে লকডাউন নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে এটি অনেক বড় প্রভাব ফেলেছে বলেও জানান এই রোগ নিয়ন্ত্রণ বিশেষজ্ঞ।
সরকারের রোগতত্ত্ব ও রোগ নিয়ন্ত্রণ গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ড. মোশতাক হোসেন বলেন, দেশের মানুষ সবকিছু মানেন কিন্তু পালন করতে পারেন না। যেটা আমরা করোনায় সরকার ঘোষিত নির্দেশনা বাস্তবায়নের দিকে তাকালেই দেখতে পাই। যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল ও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীরা যখন করোনাকে উড়িয়ে দিয়েছেন, তখন বাংলাদেশের সরকার প্রধান মানুষকে মাস্ক পড়তে বলেছেন। হ্যাঁ, আমাদের কিছু সীমাবদ্ধতা ছিল। কারণ, তখন এটি জানা ছিল না।
তিনি বলেন, আমাদের প্রধান সংকট প্রাতিষ্ঠানিক হেলথ কাভারেজ নেই। একই সঙ্গে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদেরও ঠিকভাবে সম্পৃক্ত করা যায়নি। ফলে করোনায় এক কোটি মানুষকে খাদ্য বিতরণকালে অনিয়মের খবর এসেছে। কী পরিমাণে হয়েছে সেটি বের করা দরকার। অনেক দেশের আগেই লকডাউন দেওয়া হলেও এর ইতিবাচক ফল এসেছে। আমাদের প্রস্তুতি ও অর্জন মাঝামাঝি। যে দেশের হেলথ কাভারেজ যত ভাল, তারা ততটাই উন্নত। গ্রামে কমিউনিটি ক্লিনিক থাকলেও শহরাঞ্চলে নেই। ফলে গ্রামে সংক্রমণ কম ছড়ালেও শহরে বেশি ছড়িয়েছে।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ বলেন, করোনা যখন বিশ্বব্যাপী ব্যাপক তাণ্ডব চালায় তখন ইতালির প্রধানমন্ত্রী কোনো উপায় না দেখে আকাশের পানে চেয়েছিলেন, সেখানে আমাদের সরকার প্রধান প্রতিদিনই মাস্ক পড়তে বলেছিলেন। এক কোটি মানুষকে প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে। করোনার ঊর্ধ্বমুখী অবস্থায় কেউ বাইরে চিকিৎসা নিতে যায়নি। প্রথমদিকে সামনে থেকে চিকিৎসা দিতে গিয়ে অনেকে মারা গেছেন। ব্যবস্থাপনায় দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ সব থেকে এগিয়ে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫০০
আপনার মতামত জানানঃ