জাপানের স্কুলগুলোতে নিষিদ্ধ করা হয়েছে মেয়েদের চুল বাঁধার স্টাইল ‘পনিটেইল’ বা ঝুঁটি করা। যুক্তি হিসেবে দেখানো হয়েছে, ঝুঁটি করে বাঁধা চুল যৌন উত্তেজনা তৈরি করতে পারে। শনিবার যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ডেইলি স্টার এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে।
জাপানের একটি স্কুলের এক শিক্ষকের বরাত দিয়ে ডেইলি স্টার জানিয়েছে, শিক্ষকদের ভয় এই ধরনের চুল বাঁধার ফলে মেয়েদের ঘাড়ের একটি অংশ উন্মুক্ত হয়ে থাকে যা যৌন উত্তেজক।
জাপানের একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক মটোকি সুগিয়ামা বলেছেন, ‘স্কুল কর্তৃপক্ষ তাকে বলেছে—মেয়েরা ঝুঁটি করতে পরে না কারণ এতে তাদের ঘাড়ের একটি অংশ উন্মুক্ত হয়ে থাকে যা বিপরীত লিঙ্গকে উত্তেজিত করতে পারে।’
সুগিয়ামা ১১ বছরের শিক্ষকতা জীবনে জাপনের শিজুওকা এলাকার পাঁচটি ভিন্ন স্কুলে পড়িয়েছে। তিনি জানিয়েছেন, এই পাঁচটি স্কুলের প্রত্যেকটিই মেয়েদের ঝুঁটি করা নিষিদ্ধ করেছে। সুগিয়ামা নিয়মটিকে এর আগের—মেয়েরা সাদা অন্তর্বাস পরতে পারবে না যাতে তা তাদের ইউনিফর্মের ওপর দিয়ে দেখা না যায়—একটি উদ্ভট নিয়মের সঙ্গে তুলনা করেছেন।
সুগিয়ামা বলেন, ‘আমি সর্বদা এ ধরনের নিয়মের সমালোচনা করেছি কিন্তু এই বিষয়ে কঠোর সমালোচনা অভাব থাকায় এটি এখন এতটাই স্বাভাবিক হয়ে গেছে যে—শিক্ষার্থীদের সেগুলো গ্রহণ করা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।’
যদিও এমন কোনো নির্দিষ্ট পরিসংখ্যান নেই যা থেকে জানা যাবে জাপানে ঠিক কতটি স্কুলে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এছাড়া জাপানের স্কুলগুলোতে শিক্ষার্থীদের চুল রং করা নিষিদ্ধ। তারা তাদের চুল সোজা এবং কালো রাখতে বাধ্য।
২০২০ সালে একটি জরিপে দেখা যায়, ফুকুওকা শহরে প্রতি ১০টি স্কুলের মধ্যে একটিতে ঝুঁটি নিষিদ্ধ করা হয়েছিল।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়ে, কোনো স্কুলে মেয়েদের ‘বব হেয়ারকাট’-এ অনুমতি আছে। সে ক্ষেত্রে ঘাড় দেখা গেলেও নিষিদ্ধ করা হয়নি। আবার কখনও ‘আন্ডারকাট’ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
মেইজি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের সহকারী অধ্যাপক আসাও নাইতো ভাইস নিউজকে বলেন, ‘স্কুল থেকে স্কুলে নিয়মগুলোর পরিবর্তন হয়। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এগুলো চলতে থাকে। অনেকটা উত্তর কোরিয়ার মতো।’
গত বছর উত্তর কোরিয়ায় আঁটসাঁট জিন্স পরার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন দেশটির শাসক কিম জং উন। চুল কাটার ধরনের ওপরও নানা বিধিনিষেধ আরোপ করেন কিম।
‘আমি সর্বদা এ ধরনের নিয়মের সমালোচনা করেছি কিন্তু এই বিষয়ে কঠোর সমালোচনা অভাব থাকায় এটি এখন এতটাই স্বাভাবিক হয়ে গেছে যে—শিক্ষার্থীদের সেগুলো গ্রহণ করা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।’
এদিকে সম্প্রতি জাপানের জাতীয় পুলিশ এজেন্সি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বছর দেশে শিশু নির্যাতনের ২ হাজার ১৭০টি ঘটনা তদন্ত করে পুলিশ। আগের বছরের তুলনায় শিশু নির্যাতনের হার ১ দশমিক ৭ শতাংশ বেড়েছে।
তবে শিশুদের অধিকার ও বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা নিয়ে কাজ করা বেসরকারি কয়েকটি সংগঠনের দাবি, পুলিশ এজেন্সির প্রতিবেদনে প্রকৃত সত্য উঠে আসেনি। সংগঠনগুলো বলছে, শিশু নির্যাতনের প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়ে অনেক বেশি।
পুলিশের তদন্ত করা ঘটনার বাইরেও দেশের শিশুকল্যাণ কেন্দ্রগুলোতে নির্যাতিত শিশুদের বহু অভিযোগ পাওয়া গেছে। এই সংখ্যা ২০২১ সালে রেকর্ডসংখ্যক বেড়ে ১ লাখ ৮ হাজার ৫০টিতে দাঁড়িয়েছে। আগের বছরের চেয়ে অভিযোগ ১ শতাংশ বেশি। এ ছাড়া টানা দুই বছর ধরেই শিশু নির্যাতনের অভিযোগ এক লাখ ছাড়িয়েছে।
কেন এমন হচ্ছে, তার কারণ খুঁজে দেখার চেষ্টা করেছেন দেশটির সমাজবিজ্ঞানীরা। তারা বলছেন, শারীরিক অসুস্থতা ছাড়াও করোনা মহামারির নেতিবাচক দিকগুলো মানুষের জীবনযাত্রায় প্রভাব ফেলেছে। এর মধ্যে রয়েছে আয় কমে যাওয়া, চাকরি নিয়ে দুশ্চিন্তার কারণে নাগরিকদের ওপর মানসিক চাপ বৃদ্ধি। এসব কারণে শিশুদের ওপর নিপীড়নের পাশাপাশি বেড়েছে পারিবারিক সহিংসতাও। জাতীয় পুলিশ এজেন্সির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বছরে ৮৩ হাজার ৩৫টি পারিবারিক সহিসংতার ঘটনা ঘটেছে।
এদিকে মহামারি করোনা ভাইরাসের ভয়াল তাণ্ডবের মাঝেই পূর্ব এশিয়ার দেশ জাপানে শিশুদের মধ্যে আত্মহত্যার সংখ্যা রেকর্ড পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে শিশুদের আত্মহত্যার সংখ্যা এতোটাই বেড়েছে যে— গেল চার দশকের মধ্যে এটি সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। দেশটির শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বরাতে জাপানি গণমাধ্যম তথ্যটি জানিয়েছে।
জাপানে আত্মহত্যার হার এমনিতেই বেশি। করোনার কারণে শিশুদের মাঝেও বেড়েছে এই হার। দেশটির শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জরিপে দেখা যায়, করোনা মহামারির কারণে ২০২০ সালে স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর থেকে শিশু শ্রেণি থেকে মাধ্যমিক পর্যায়ের ৪১৫ জন শিশু শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে।
জাপানের সংবাদমাধ্যম আশাহি এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করে, করোনা মহামারির মধ্যে আত্মহত্যা করা শিশু শিক্ষার্থীদের এই সংখ্যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় ১০০ জন বেশি। ১৯৭৪ সাল থেকেও সর্বোচ্চ। ১৯৭৪ সাল থেকে জাপানে শিশু শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার রেকর্ড রাখা হয় দেশটিতে।
জাপানে আত্মহত্যার কারণগুলো বেশ জটিল। সেখানে মানসিক চাপ বাড়ার কিছু কারণ রয়েছে। এর মধ্যে দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করা এবং সামাজিক বিচ্ছিন্নতা অন্যতম। জাপানের মতো উন্নত পুঁজিবাদী দেশে যখন মানুষকে বেশি সময় ধরে কাজ করতে হয়, তখন বুঝতে হবে হয় সেখানে কাজ করার মানুষের ঘাটতি আছে, অথবা পুঁজিপতিরা দীর্ঘ সময় কাজ করাতে বাধ্য করে যাতে মুনাফা বেশি হয়।
বিশ্লেষকরা বলেন, লোকজন কোভিড-১৯ নিয়ে উদ্বিগ্ন। কিন্তু অনেক মানুষ তাদের কাজ হারিয়ে, আয়ের পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কোনো আশা দেখছেন না, তারা আত্মহত্যা করছেন। জাপানে আত্মহত্যার উচ্চহারের নানা জটিল কারণ রয়েছে। এর মধ্যে দীর্ঘ কর্মঘণ্টা, স্কুলের চাপ, সামাজিক বিচ্ছিন্নতার মতো নানা বিষয় রয়েছে। করোনার নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা ও অর্থনীতির মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে বলে মনে করেন তারা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮৪৯
আপনার মতামত জানানঃ