রাজধানী ঢাকার বায়ুদূষণের মাত্রা বিপজ্জনক পর্যায়ে অবস্থান করছে। বিশ্বে শীর্ষ দূষিত কয়েকটি শহরের অন্যতম ঢাকার মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর সর্বাধিক নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। মানুষের গড় আয়ু কমছে দীর্ঘমেয়াদী বায়ুদূষণের কারণে।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বায়ুদূষণের কারণে বাংলাদেশে মানুষের গড় আয়ু সবচেয়ে বেশি কমেছে। চীন, ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, মিয়ানমার ও ভুটানের চেয়ে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ুষ্কাল বায়ুদূষণের কারণে বেশি কমছে।
বায়ুদূষণের কারণে বাংলাদেশে মানুষের আয়ু গড়ে তিন বছর কমছে। বায়ুদূষণ নিয়ে এক বৈশ্বিক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। ‘বৈশ্বিক বায়ু পরিস্থিতি-২০২০: বায়ুদূষণ কীভাবে সারা বিশ্বে আয়ুষ্কালকে প্রভাবিত করে’ শিরোনামের প্রতিবেদনটি গতকাল বুধবার প্রকাশিত হয়।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক হেলথ ইফেক্টস ইনস্টিটিউট ও ইনস্টিটিউট ফর হেলথ মেট্রিকস অ্যান্ড ইভাল্যুশনের যৌথভাবে তৈরি বিশেষ প্রতিবেদনটি ২০১৯ সালে বিশ্বের বায়ুর মানের তথ্যের ওপর ভিত্তি করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্তমানে বিশ্বে মানুষের মৃত্যুর চতুর্থ প্রধান কারণ বায়ুদূষণ। বায়ুদূষণে বিশ্বে প্রতিবছর ৭০ লাখ মানুষের অকালমৃত্যু হয়। বায়ুদূষণের বর্তমান (২০১৯ সালের তথ্য অনুযায়ী) মাত্রা বিশ্বে মানুষের গড় আয়ুষ্কাল ১ বছর ৮ মাস কমিয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বের স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মানুষের আয়ুষ্কালের ওপর বায়ুদূষণের প্রভাব সবচেয়ে বেশি। এসব দেশে অনেকে উচ্চমাত্রার বাহ্যিক (আউটডোর) ও অভ্যন্তরীণ (ইনডোর) বায়ুদূষণের দ্বিগুণ ভোগান্তির শিকার হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ওশেনিয়া, দক্ষিণ এশিয়া ও সাবসাহারান আফ্রিকা অঞ্চলে বায়ুদূষণের জন্য মানুষের আয়ুষ্কাল সবচেয়ে বেশি কমছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, বায়ুদূষণের কারণে বাংলাদেশের মানুষের আয়ুষ্কাল গড়ে কমছে ২ দশমিক ৯ বছর। এর মধ্যে ১ দশমিক ১৬ বছর কমে বাইরের (আউটডোর) বায়ুদূষণে। আর ১ দশমিক ৫৩ বছর কমে ঘরের (ইনডোর) বায়ুদূষণে।
২০২০ সালের জরিপের ওপর ভিত্তি করে ২০২১ সালের জুনে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) জানায়, দেশের মানুষের গড় আয়ু ৭২ দশমিক ৮ বছর। এর মধ্যে পুরুষের গড় আয়ু ৭১ দশমিক ২ বছর। নারীর গড় আয়ু ৭৪ দশমিক ৫ বছর।
চীন, ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, মিয়ানমার ও ভুটানের চেয়ে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ুষ্কাল বায়ুদূষণের কারণে বেশি কমছে। অর্থাৎ, আয়ুষ্কালের ওপর বায়ুদূষণের প্রভাব এই দেশগুলোর চেয়ে বাংলাদেশের ওপর বেশি।
বায়ুদূষণের কারণে চীনে মানুষের আয়ুষ্কাল গড়ে কমে ১ দশমিক ৮৫ বছর। ভারতে ২ দশমিক ৬৯ বছর। পাকিস্তানে ২ দশমিক ৮৩ বছর। আফগানিস্তানে ২ দশমিক ৬৬ বছর। মিয়ানমারে ২ দশমিক ৬১ বছর। ভুটানে ২ দশমিক শূন্য ৯ বছর।
বায়ুদূষণের কারণে এ অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আয়ুষ্কাল কমে নেপালে। দেশটির মানুষের আয়ুষ্কাল গড়ে কমে ৩ দশমিক শূন্য ৫ বছর।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, বায়ুদূষণের কারণে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি আয়ুষ্কাল কমা দেশ পাপুয়া নিউগিনি। দেশটির মানুষের আয়ুষ্কাল গড়ে কমে ৩ দশমিক ২ বছর। তারপর রয়েছে নাইজার (৩ দশমিক ১ বছর) ও সোমালিয়া (৩ দশমিক শূন্য ৪ বছর)। প্রতিবেদনে বলা হয়, তামাক ব্যবহারের কারণে মানুষের গড় আয়ুষ্কাল যতটা কমে, বায়ুদূষণের কারণেও প্রায় ততটাই কমে।
বিশ্বের স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মানুষের আয়ুষ্কালের ওপর বায়ুদূষণের প্রভাব সবচেয়ে বেশি। এসব দেশে অনেকে উচ্চমাত্রার বাহ্যিক (আউটডোর) ও অভ্যন্তরীণ (ইনডোর) বায়ুদূষণের দ্বিগুণ ভোগান্তির শিকার হয়।
এদিকে সাম্প্রতিক একটি গবেষণা জানিয়েছে, বায়ুদূষণের ফলে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আমাদের হৃৎপিণ্ড, বেড়ে যাচ্ছে উচ্চ রক্তচাপের মতো রোগ। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে কিডনির নানা জটিল অসুখও।
গবেষকরা দেখেছেন, দীর্ঘদিন ধরে কিডনির অসুখে ভুগছেন এমন প্রাপ্তবয়স্কদের উচ্চ রক্তচাপের সঙ্গে সঙ্গে গ্যালেক্টিন প্রোটিনের পরিমাণও বেড়ে যাচ্ছে বায়ুদূষণের মাত্রাবৃদ্ধির কারণে। এই গ্যালেক্টিন প্রোটিনের পরিমাণ দেহে বাড়লেই হৃৎপিণ্ডে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি হয়। আর সেই ক্ষত কিছুতেই সারিয়ে তোলা সম্ভব হয় না। চিকিৎসাবিজ্ঞানের পরিভাষায় যার নাম ‘মায়োকার্ডিয়াল ফাইব্রোসিস’।
মূল গবেষক যুক্তরাষ্ট্রের কেস ওয়েস্টার্ন রিজার্ভ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক হাফসা তারিক বলেছেন, ‘যখনই আমাদের হৃদযন্ত্রে ফাইব্রোব্লাস্ট নামে একটি বিশেষ ধরনের কোষ কোলাজেন তৈরি করতে শুরু করে, তখনই হয় মায়োকার্ডিয়াল ফাইব্রোসিস। তার ফলে নানা ধরনের হৃদরোগ হয়। ডেকে আনে মৃত্যু।’
গবেষকরা দেখেছেন, বাতাসে বিশেষ ধরনের দূষণ কণার (পার্টিকুলেট ম্যাটার ২.৫) পরিমাণ বাড়লেই এটা হচ্ছে। সেই কণা বাতাসে কম থাকলে বা একেবারে না থাকলে কিডনি, হৃৎপিণ্ডের ততটা ক্ষতি হচ্ছে না। খুব ক্ষতি হচ্ছে কিডনিরও। গবেষকরা দুবছর ধরে প্রায় দেড় হাজার রোগীর উপর ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চালিয়ে এই ঘটনা ঘটতে দেখেছেন।
নগর সভ্যতার ডামাডোলে গোটা বিশ্ব এমন এক অবস্থায় এসে পৌঁছেছে যেখানে প্রাণ ধারণের জন্য ন্যূনতম বিশুদ্ধ আলো, বাতাস ও পানির মতো প্রকৃতির অফুরান দানগুলো অবশিষ্ট থাকার সুযোগ নেই। বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে নানা বিরূপ প্রভাবসহ মানবসৃষ্ট পরিবেশ দূষণের কবলে পড়ে ক্রমেই হুমকির মুখে এগিয়ে চলছে জনজীবন। অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও দ্রুত শিল্পায়নের এই অশুভ প্রতিযোগিতার করাল গ্রাসে পড়ে প্রাকৃতিক পরিবেশ বিনষ্ট হচ্ছে, লাগামহীনভাবে বেড়ে চলছে দূষণ। প্রতি বছর বিশ্বে বায়ুদূষণের কারণে অন্তত ৭০ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়৷
বায়ুদূষণ সব দেশের জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি। তবে এটি নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোয় চরম ঝুঁকি তৈরি করেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নতুন এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য দেয়া হয়েছে৷
ডব্লিউএইচও’র মহাপরিচালক তেদ্রোস আধানম বলেন, অর্থনৈতিক উন্নয়নে জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরশীলতার কারণে তৈরি হচ্ছে মারত্মক বায়ুদূষণ। এর ফলে ফুসফুস হৃদযন্ত্র ও শ্বাসপ্রশ্বাসজনিত নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। বস্তুকণা, নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইডসহ অন্যান্য দূষণ তৈরিকারী উপাদানের উপস্থিতি কমাতে হবে।
সংস্থাটির মতে, বিশ্বজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তনের পাশাপাশি বায়ুদূষণ জনস্বাস্থ্যের জন্য অন্যতম পরিবেশগত হুমকি হিসেবে দেখা দিয়েছে। এ বিষয়ে ডব্লিউএইচওর প্রধান তেদ্রোস আধানম গেব্রেয়াসুস বলেন, ‘বায়ুদূষণ সব দেশের জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি। তবে এটি নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোয় চরম ঝুঁকি তৈরি করেছে।’
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি নগরায়ন ও শিল্পায়নের হার বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। অনুষঙ্গ হিসেবে পরিবেশ দূষণ বিশেষ করে বায়ুদূষণের মাত্রাও বেড়েছে বহুগুণে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, পৃথিবীর শতকরা প্রায় ৯১ ভাগ মানুষ সংস্থাটির নির্ধারিত মান মাত্রার নির্মল বায়ু সেবন থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
এছাড়া প্রতি বছর বায়ুদূষণের জন্য বিশ্ব অর্থনীতির প্রায় ৫ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় হচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও বায়ুদূষণ প্রকট আকার ধারণ করছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নগরবাসীর কাছে যানজটের পাশাপাশি আরেক যন্ত্রণার নাম বায়ুদূষণ। মাত্রাতিরিক্ত দূষণের কবলে নগরজীবন বিভীষিকাময় হয়ে উঠেছে। বাড়িয়ে তুলছে স্বাস্থ্যঝুঁকি। সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে শিশু, বৃদ্ধ ও শ্বাসতন্ত্রের রোগীরা।
প্রতিনিয়ত বায়ুদূষণে ফুসফুসের অক্সিজেন গ্রহণক্ষমতা কমে শ্বাসকষ্ট ক্রমাগত বাড়ে বলে জানান সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, প্রথমে শ্বাসনালি ও চোখে সমস্যা তৈরি করে। ফলে অ্যাজমা ও নিউমোনিয়ার রোগীর সংখ্যা বেড়ে চলেছে বলে উল্লেখ করেন। এছাড়া দীর্ঘমেয়াদে এ দূষিত বায়ু গ্রহণ ব্রঙ্কাইটিস থেকে ফুসফুস ক্যান্সারের কারণ হতে পারে বলে উল্লেখ করেন। এদিকে বায়ুদূষণের কারণে ক্রনিক অবস্ট্রাক্টিভ পালমোনারি ডিজিজ (সিওপিডি) বেশি দেখা দেয় বলে জানান বিশেষজ্ঞরা।
এ জন্য বায়ুদূষণের সঙ্গে মানুষের গড় আয়ুর বিষয়টি জড়িত। আমাদের গড় আয়ু বেড়েছে কিন্তু সেটা কতটা মানসম্মত সেটাও খতিয়ে দেখা উচিত। আমাদের জীবদ্দশায় কতটা সময় হাসপাতালে কাটাতে হয়, সেটাও হিসাব করা উচিত বলে জানান তারা।
নির্মল বায়ুর জন্য স্থায়ী কোনো নীতি যেটি জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমাতে পারে, সেটা গড় আয়ু বাড়ানোর পাশাপাশি জলবায়ুর ইতিবাচক পরিবর্তনে ভূমিকা রাখতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। তারা এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে চীনকে উল্লেখ করে বলেছেন, ২০১১ সালের তারা যে নীতি গ্রহণ করেছে, তাতে তাদের গড় আয়ু বেড়েছে ২.৬ বছর।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২০৫৯
আপনার মতামত জানানঃ