আখ মাড়াইয়ের ভরা মওসুমের মাঝখানে আকস্মিক ছয়টি চিনিকল বন্ধের সরকারী সিদ্ধান্তে বিক্ষুব্ধ আখ চাষি ও চিনিকল শ্রমিকরা সরকারকে এ আত্মঘাতি সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার আলটিমেটাম দিয়ে বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তোলার হুমকি দিয়েছে। ছয়টি চিনিকল বন্ধের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে সরকারকে সময় বেঁধে দিয়েছে আখ চাষি ও চিনিকল শ্রমিকরা।
ধারাবাহিক লোকসান কমাতে চলতি মওসুম থেকেই পাবনা সুগার মিল, শ্যামপুর সুগারমিল, পঞ্চগড় সুগার মিল, সেতাবগঞ্জ সুগারমিল, রংপুর সুগার মিল এবং কুষ্টিয়া সুগার মিলে আখ মাড়াই ও উৎপাদন বন্ধ রাখার ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন। এসব মিলের জন্য চাষ হওয়া আখগুলো কাছাকাছি মিলগুলোতে নিয়ে মাড়াই করার কথা বলা হয়েছে।
বাংলাদেশ চিনিকল আখচাষী ফেডারেশন এবং বাংলাদেশ চিনি শিল্প কর্পোরেশন শ্রমিক কর্মচারী ফেডারেশন শনিবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছেন, আগামী ৭ ডিসেম্বর থেকে প্রতিদিন দেশের সব চিনিকলের মিল গেইট এলাকায় দুই ঘণ্টা কর্মবিরতি ও বিক্ষোভ কর্মসূচির পালন করা হবে। এর মধ্যে দাবি আদায় না হলে ১৫ ডিসেম্বর নতুন কর্মসূচি দেওয়া হবে বলে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়।
প্রতিবছর ১৫ অক্টোবর থেকে আখ মাড়াই শুরু হলেও এবার নানা কারণে এখনও চালু হয়নি দেশের ১৫টি চিনিকল। আগামী ১৫ ডিসেম্বর থেকে চিনিকলগুলোতে মাড়াই শুরু হওয়ার কথা। এরমধ্যে ছয়টি চিনিকল বন্ধের ঘোষণা এসেছে।
বাংলাদেশ চিনিকল আখচাষী ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান আলী বাদশা বলেন, “চিনি শিল্প খাতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির জন্য মওসুমের মাঝপথে এসে কিছু দায়িত্বশীল ব্যক্তি এ ধরনের একটি বাজে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতে করে লাভ তো হবেই না, বরং আখ চাষী ও বন্ধ মিলগুলোর শ্রমিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। ঐহিত্যবাহী শিল্পগুলো বন্ধ করে দিয়ে এই খাতে বেসরকারি শিল্পের একক আধিপত্য ফিরিয়ে আনার পরিকল্পনার অংশ হিসাবেই ছয়টি চিনিকল বন্ধের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
পঞ্চগড়-১ আসনের সংদস সদস্য এবং বাংলাদেশ চিনিকল আখচাষি ফেডারেশনের সভাপতি মজাহারুল হক প্রধান বলেন, “ছয়টি চিনিকলে আখ মাড়াই বন্ধ করলে কৃষকরা আখ চাষ করবে না। আর আখ না থাকলে এমনিতেই এ মিলগুলো বন্ধ হয়ে যাবে। বেকার হয়ে পড়বে হাজার হাজার শ্রমিক। আমরা এটা হতে দিতে পারি না। একবার কোনো মিল বন্ধ হলে আর চালু হয় না।” একটি মহল চিনিকলের লোকসানের বিষয় সরকারকে ‘ভুল বোঝাচ্ছে’ অভিযোগ করে তিনি বলেন, “তারা এ থেকে সুবিধা নিতে চাচ্ছে।”
চিনিকলগুলোর কয়েকজন ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অধিক লোকবল, মেশিনের দক্ষতা নষ্ট হওয়া, কাচামালের ঘাটতি, দীর্ঘদিন জমতে থাকা ব্যাংক ঋণের সুদ ও বছরের প্রায় ১০ মাস ধরে উৎপাদন বন্ধ থাকাসহ নানা কারণে প্রতি বছরই প্রায় হাজার কোটি টাকা লোকসন গুনছে রাষ্ট্রায়ত্ত ১৫টি চিনিকল। এসব কারণে বাজারে বেসরকারি রিফাইনারিতে উৎপাদিত প্রতি কেজি সাদা চিনি ৬০ টাকা থেকে ৭০ টাকার মধ্যে পাওয়া গেলেও সরকারি চিনিকলগুলোতে উৎপাদিত চিনির দাম পড়ে যাচ্ছে প্রতি কেজি ২৫০ টাকা থেকে ৩০০ টাকার মধ্যে। ঋণজালে জর্জরিত কারখানাগুলো সময় মতো আখচাষীদের পাওনা পরিশোধ করার সক্ষমতাও হারাতে বসেছে।
চিনি শিল্প করপোরেশন শ্রমিক কর্মচারী ফেডারেশনের সভাপতি মাসুদুর রহমান বলেন, “আধুনিকায়নের নামে চিনিকল বন্ধ হতে দেওয়া যাবে না। চিনিকল চালু রেখেই এর আধুনিকায়ন করতে হবে। পুরনো যন্ত্রপাতি মেরামত ও আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হলে এসব কারখানার উৎপাদন ব্যয় কমবে। আখে চিনি আহরণের মাত্রাও বাড়বে।”
ছয়টি চিনিকল বন্ধের সিদ্ধান্ত জানিয়ে বাংলাদেশে চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন-বিএসএফআইসির চেয়ারম্যান সনৎ কুমার সাহা বলেছেন, “চিনিকলগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা কমে যাওয়াসহ বিভিন্ন কারণে দীর্ঘদিন ধরে লোকসান গুনতে হচ্ছে। তাই সংস্কার ও আধুনিকায়নের উদ্দেশ্যেই কারখানাগুলো আপাতত বন্ধ করা হয়েছে।
বিগত কয়েক বছরে মন্ত্রণালয় থেকে পাওয়া ভর্তুকির টাকা দিয়ে মাড়াই মওসুমের নানা সঙ্কট উৎরাতে পারলেও গত অর্থবছরে সেই ভর্তুকিও কমিয়ে দিয়েছে সরকার। বিএসএফআইসির তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৯৭০ কোটি টাকা লোকসান গুনেছে চিনিকলগুলো। বিগত পাঁচ বছরে জমতে থাকা লোকসানের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩৯৭৬ কোটি টাকা।
এসডব্লিউ/নসদ/১৭৩০
আপনার মতামত জানানঃ