শেষ পর্যন্ত রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হলো। বৃহস্পতিবার পার্শ্ববর্তী দেশ ইউক্রেনে আক্রমণ শুরু করে মস্কো, যা কভিডে পর্যুদস্ত বিশ্বে নতুন সংকট হিসেবে মনে করা হচ্ছে। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের কোনো দেশে এটাই সবচেয়ে বড় হামলা। বাংলাদেশও এর নেতিবাচক প্রভাব থেকে মুক্ত থাকতে পারবে না।
ইউক্রেনের সঙ্গে রাশিয়ার যুদ্ধ ঘোষণায় বিশ্বজুড়ে এর ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের আঁচে পুড়বে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো। পেট্রল-ডিজেল বা রান্নার গ্যাস-সহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম একলাফে অনেকটাই বাড়ার আশঙ্কা করছেন অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরা। ইতোমধ্যে অস্থির শেয়ার মার্কেট এবং ক্রমবর্ধমান অপরিশোধিত তেলের দাম।
ইউএস এনার্জি ইনফরমেশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের পরিসংখ্যান বলছে, ২০২০ সালে রাশিয়া ছিল তৃতীয় বৃহত্তম তেল উৎপাদনকারী দেশ। প্রতিদিন আনুমানিক ১০.৫০ মিলিয়ন ব্যারেল তেল উৎপাদন করা হতো দেশটিতে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে অপরিশোধিত তেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম দ্রুত বৃদ্ধি পাবে। বিশ্বে অপরিশোধিত তেলের দাম বর্তমানে ব্যারেল প্রতি ১০০ ডলার ছুঁয়ে ফেলেছে।
আপাত দৃষ্টিতে দক্ষিণ এশিয়ার ঘনবসতিপূর্ণ রাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক না থাকলেও রাশিয়া-ইউক্রেনের এই সংকটের আঁচ লাগতে চলেছে এই অঞ্চলের উপরও। কেননা রাশিয়া-ইউক্রেনের দ্বৈরথের জেরে বেশকিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম প্রায় অবধারিত।
সামগ্রিকভাবে খাদ্যশস্য, গ্যাস, জ্বালানি তেল, রাসায়নিক সারসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পণ্যের সরবরাহ ব্যাপকভাবে ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। দেশে কৃষি ও শিল্পপণ্যের উৎপাদন খরচ বাড়বে। বাড়বে পরিবহন খরচও। অনেক দেশের জাহাজ কৃষ্ণ সাগরে যেতে চাচ্ছে না, যা সরাসরি দাম বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে।
অপরিশোধিত তেল
রাশিয়া বিশ্বের বৃহত্তম অপরিশোধিত তেল উৎপাদক রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে অন্যতম। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম বৃদ্ধির বিষয়টি আগামী কয়েকদিনের মধ্যে গোটা বিশ্বের আর্থিক বৃদ্ধির উপরেও প্রভাব ফেলবে।
সমীক্ষক সংস্থা জে পি মরগ্যানের বিশ্লেষণে দাবি করা হয়, অপরিশোধিত তেলের মূল্য ব্যারেলপ্রতি দেড়শ ডলারে পৌঁছালে বিশ্বের জিডিপি বৃদ্ধির হার ০.৯ শতাংশে নেমে আসতে পারে।
গ্যাস, এলপিজি, কেরোসিন
বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা- রাশিয়া ও ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরু হলে সিএনজি, পিএনজির মতো বাড়িতে ব্যবহৃত জ্বালানির দামও বাড়তে পারে। শুধু তাই নয়, অপরিশোধিত তেলের মূল্য বৃদ্ধি পেলে এলপিজি এবং কেরোসিনে ভর্তুকির পরিমাণও বাড়ানোর প্রয়োজন দেখা দিবে।
গম ও ভুট্টার দাম
রাশিয়া ও ইউক্রেনের পরিস্থিতির প্রভাব নিয়ে ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে যেসব খবর প্রচারিত হয়েছে সেগুলো পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এই দুটি দেশ খাদ্যশস্য ও পেট্রোলিয়াম পণ্য উৎপাদন এবং রপ্তানিতে বিশ্বে শীর্ষস্থানীয় দেশ। দেশ দুটির মধ্যে যুদ্ধ শুরু হওয়াতে আমদানিকারকরা বিকল্প দেশ থেকে পণ্য নিতে চেষ্টা করছেন। গম, ভুট্টা ও সূর্যমুখী তেলের সরবরাহে এক ধরনের ঘাটতি দেখা দিয়েছে।
সারা বিশ্ব যত গম রপ্তানি করে তার প্রায় ৩০ শতাংশ করে রাশিয়া ও ইউক্রেন। এছাড়া ভুট্টার প্রায় ২০ শতাংশ রপ্তানি হয় এই দুই দেশ থেকে। গম, ভুট্টা দিয়ে শিশুখাদ্য থেকে শুরু করে প্রাণিজ খাদ্য উৎপাদন হয়। সূর্যমুখী তেল রপ্তানির ৮০ শতাংশই করে এ দুই দেশ।
ফলে ব্যবসায়ীরা আশঙ্কা করছেন, রাশিয়া ও ইউক্রেনের উত্তেজনা দীর্ঘস্থায়ী হলে চলতি মৌসুমে গম ও ভুট্টার সরবরাহে ঘাটতি দেখা দেবে। ফলে এসব পণ্য থেকে উৎপাদিত দ্রব্যের দাম বাড়বে। ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক বাজারে গমের দাম বাড়তে শুরু করেছে। ভুট্টার দামও বেশ চড়া।
পেট্রোল-ডিজেলের দাম বাড়ার শঙ্কা
অতীতে আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম বাড়লেই দক্ষিণ এশিয়াতে পেট্রোল, ডিজেলের দাম চড়চড়িয়ে বেড়েছে। এসবের রেশ শুরু থেকেই দক্ষিণ এশিয়ার ঘনবসতিপূর্ণ এই দেশের ওপরও পড়েছে।
বাংলাদেশে মোট জ্বালানি তেলের বর্তমানে যে চাহিদা রয়েছে, তার অধিকাংশই আমদানি করতে হয়। ফলে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি পেলে দেশের রাজকোষে ঘাটতিও বৃদ্ধি পাবে। এমনকি বাড়তে পারে অন্যান্য পণ্যের বাজারও।
খাদ্যদ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধির শঙ্কা
বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, কৃষ্ণ সাগর অঞ্চল থেকে গমের সরবরাহ ব্যাহত হলে খাদ্যদ্রব্যেরও মূল্যবৃদ্ধি ঘটতে পারে। রাশিয়া বিশ্বের বৃহত্তম গম রফতানিকারক দেশ। আর এই তালিকায় ইউক্রেন রয়েছে চার নম্বরে। গোটা বিশ্বে যে দেশগুলো গম রফতানি করে, তার চারভাগের প্রায় একভাগই করে রাশিয়া এবং ইউক্রেন।
রাষ্ট্রপুঞ্জের রিপোর্টের দাবি, মহামারি করোনা ভাইরাসের ভয়াল সংক্রমণের কারণে সরবরাহ ব্যাহত হওয়ায় এমনিতেই গত এক দশকে খাদ্যদ্রব্যের মূল্যে সর্বোচ্চ বৃদ্ধি ঘটেছে।
দাম বাড়বে ধাতুরও
এসবের পাশাপাশি খুব দ্রুত বাড়তে পারে প্যালাডিয়াম বলে গাড়ি নির্মাণ এবং মোবাইল ফোনে ব্যবহৃত একটি ধাতুর দামও। গেল কয়েক সপ্তাহে প্যালাডিয়ামের দাম অনেকটাই বৃদ্ধি পেয়েছে।
কেননা রাশিয়া প্যালাডিয়ামের বৃহত্তম রফতানিকারক দেশ। রাশিয়ার উপরে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা চাপার আশঙ্কাতেই বৃদ্ধি পেয়েছে প্যালাডিয়ামের দাম।
আমদানি-রপ্তানির উপর প্রভার
করোনা পরিস্থিতির মধ্যে গত ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে রাশিয়ায় ৬৬ কোটি ৫৩ লাখ মার্কিন ডলার মূল্যের বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি হয়েছে। একই সময়ে আমদানি হয়েছে ৪৬ কোটি ৬৭ কোটি ডলার মূল্যের পণ্য।
২০১৯-২০ অর্থবছরে রাশিয়ায় বাংলাদেশের রপ্তানি ছিল ৪৮ কোটি ৭০ লাখ ডলারের পণ্য। একই সময়ে রাশিয়া থেকে আমদানির পরিমাণ ছিল ৭৮ কোটি ২০ লাখ ডলারের পণ্য। একইভাবে ইউক্রেনে বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানি রয়েছে। যুদ্ধের ফলে এই আমদানি রপ্তানির উপর প্রভাব পড়বে বলে মনে করছে বিশ্লেষকরা।
বিশেষজ্ঞদের মতামত
বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদ ও পিআরআইয়ের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, বিশ্বের যেকোনো দেশে যুদ্ধ হলে তার প্রভাব আশপাশের দেশে অবশ্যই পড়ে। বিশ্বব্যাপীও ঘটনার প্রভাব পড়বে। প্রত্যক্ষ প্রভাবের চেয়ে পরোক্ষ প্রভাব বেশি হবে। এ ধরনের ঘটনায় মিত্র দেশগুলো প্রতিপক্ষ দেশের পণ্যের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিতে পারে। তাতে পুরো বিশ্ব মন্দায় পড়ার আশঙ্কা থাকে।
বিজিএমইএর সহসভাপতি শহীদুল্লাহ আজিম বলেন, তৈরি পোশাকের নতুন বড় বাজার রাশিয়া। ইউক্রেনেও কিছু পোশাক রপ্তানি হয়ে থাকে। সরাসরি এই দেশগুলো বাংলাদেশ থেকে পোশাক নেয়। আবার ইউরোপের বিভিন্ন দেশের মাধ্যমেও দেশ দুটিতে বাংলাদেশের পোশাক যায়। বর্তমান পরিস্থিতিতে ওই সব দেশে পণ্য পাঠানোর জন্য জাহাজ পাওয়া নিয়ে চ্যালেঞ্জ তৈরি হবে। ঝুঁকির কারণে কোনো জাহাজ এই অঞ্চলে ভিড়তে চাইবে না। ক্রেতারাও রপ্তানি আদেশের বিষয়ে সতর্ক থাকবেন। ফলে এই দুটি দেশে পোশাক রপ্তানি বিঘ্নিত হতে পারে।
সিটি গ্রুপ দেশের গম আমদানিকারকদের অন্যতম প্রতিষ্ঠান। এই গ্রুপের পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা বলেন, বাংলাদেশে গম আমদানি করা হয় রাশিয়া, ইউক্রেন, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা ও ভারত থেকে। এরমধ্যে মোট আমদানির এক-তৃতীয়াংশ আসে রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে। প্রতি বছর বাংলাদেশ প্রায় ৫০ লাখ টন গম আমদানি করে থাকে। এখন এই দুই দেশ থেকে লোড করার জন্য জাহাজ পাওয়া যাচ্ছে না। এছাড়া এই দুই দেশের কারণে অন্যান্য দেশও সতর্ক। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, জ্বালানি তেল সংকটের আশঙ্কা থেকে ইন্দোনেশিয়া পামঅয়েল রপ্তানি বন্ধ রেখেছে। কারণ, পামঅয়েল থেকে ইথানল তৈরি করে জ্বালানি চাহিদা মেটানো যায়। এক কথায় রাশিয়া ও ইউক্রেনের পরিস্থিতি বৈশ্বিক বাণিজ্যকে বড়ভাবে প্রভাবিত করছে।
ইফাদ মাল্টি প্রডাক্টসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাসকিন আহমেদ বলেন, এ বিষয়ে এখনই কিছু বলা সম্ভব হচ্ছে না। কারণ খাদ্যদ্রব্যের ওপর কোনো নিষেধাজ্ঞা হবে কিনা তা বলা মুশকিল। তবে রাশিয়া ও ইউক্রেনে যে ধরনের গম পাওয়া যায়, সে ধরনের গম অন্যান্য দেশে পাওয়া যায় না। ফলে এ দুটো দেশের পণ্য সরবরাহ ব্যাহত হলে অন্যান্য দেশে সমস্যা হবে। তিনি বলেন, ইতোমধ্যে জাহাজ ভাড়া বেড়েছে। জ্বালানি তেল ও খাদ্যদ্রব্যের দামও বেড়েছে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৬০০
আপনার মতামত জানানঃ