দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এবারই প্রথম ইউরোপের প্রথম দেশ হিসাবে রাশিয়ার সশস্ত্র বাহিনী স্থল, আকাশ এবং সমুদ্রপথে ইউক্রেনে সবচেয়ে বড় হামলা শুরু করেছে। একসঙ্গে তিন দিক দিয়ে হওয়া এই হামলায় ইউক্রেনের বিভিন্ন শহরে রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র বৃষ্টির মতো পড়েছে। এছাড়া ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলের চেরনিহিভ, খারকিভ এবং লুহানস্ক সীমান্ত পেরিয়ে হাজার হাজার রুশ সৈন্য স্থলপথে দেশটিতে ঢুকে পড়েছে।
রাশিয়ার আক্রমণ ঠেকাতে ইউক্রেনে সেনা পাঠাবে না ন্যাটো, পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন জোটের মহাসচিব জেনস স্টলটেনবার্গ। রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণ প্রসঙ্গে গত বৃহস্পতিবার (২৪ ফেব্রুয়ারি) এক সংবাদ সম্মেলনে এ কথা জানিয়েছেন তিনি।
রাশিয়ার সর্বাত্মক হামলার মুখে ইউক্রেনকে একা ছেড়ে দেওয়া হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। টানা কয়েক সপ্তাহের উত্তেজনাকর পরিস্থিতির মধ্যে স্থল, আকাশ এবং সমুদ্রপথে ইউক্রেনে বড় ধরনের হামলা শুরুর পর শুক্রবার (২৫ ফেব্রুয়ারি) একথা বলেন তিনি।
এদিকে হামলা শুরুর প্রথম দিনেই ইউক্রেনে ১৩৭ জন নিহত হয়েছেন বলেও জানিয়েছেন প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি। শুক্রবার এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে বার্তাসংস্থা এএফপি।
তিনি বলেন, ‘(ইউক্রেনকে রক্ষায়) আমাদের পাশে থেকে কারা লড়াই করতে প্রস্তুত? আমি কাউকেই দেখতে পাই না। ন্যাটোর সদস্যপদ পাওয়ার ব্যাপারে কে ইউক্রেনকে নিশ্চয়তা দেবে? সবাই ভীত।’
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট আরও বলেন, ‘ইউক্রেনকে সামরিক জোট ন্যাটোর সদস্য করতে আমি ২৭ জন ইউরোপীয় নেতাকে অনুরোধ করেছি। কিন্তু কেউই কোনো উত্তর দেয়নি। সবাই ভীত।’
এদিকে, এর আগে ন্যাটো জানিয়েছিল, পূর্ব ইউরোপে ন্যাটো যুদ্ধজাহাজ এবং যুদ্ধবিমান মোতায়েন করে রেখেছে। অ্যামেরিকা জানিয়েছিল, পূর্ব ইউরোপে সাড়ে আটহাজার সেনা স্ট্যান্ডবাই অবস্থানে রেখেছে অ্যামেরিকা। প্রয়োজনে তার সংখ্যা আরো বাড়ানো হবে।
গত জানুয়ারি মাসে ইউক্রেনে সম্ভাব্য রুশ সামরিক হামলার আঁচ পেয়ে পূর্ব ইউরোপে সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করে পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটো। ওই অঞ্চলে যুদ্ধবিমান ও যুদ্ধজাহাজ প্রস্তুত রেখেছে জোটটি।
তবে এখন ন্যাটো প্রধান বলেছে, ইউক্রেনের ভেতরে কোনো ন্যাটো সেনা নেই। আমরা পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছি যে, ইউক্রেনে ন্যাটো সেনা মোতায়েনের কোনো পরিকল্পনাই আমাদের নেই। অনেকটা যুদ্ধের মুখে ঠেলে দিয়ে ইউক্রেনের মাথার উপর থেকে ছাদ কেড়ে নিল ন্যাটো।
তবে তিনি জানান, এরই মধ্যে ন্যাটো এলাকার পূর্বাংশে সেনা উপস্থিতি বাড়ানো হয়েছে এবং তা আরও বাড়ানো হবে।
এর আগে ন্যাটোর মহাসচিব জেনারেল জেনস স্টলটেনবার্গ এক বিবৃতিতে বলেন, ‘ন্যাটো তার মিত্রদের রক্ষায় সব ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ অব্যাহত রাখবে। ইউরোপের পূর্বাঞ্চলের মিত্রদের রক্ষায় সামরিক শক্তি বৃদ্ধির বিষয়টিও এসব পদক্ষেপের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। আমাদের নিরাপত্তা পরিবেশে যেকোনো ধরনের হুমকি মোকাবিলায় আমরা জবাব দিতে সর্বদা প্রস্তুত।’
গতকালও স্টলটেনবার্গ অভিযোগ করেন, রাাশিয়া ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরু করে ইউরোপ মহাদেশের শান্তি নষ্ট করেছে। তিনি বলেন, রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করেছে। এটি নৃশংস যুদ্ধকর্ম। ইউক্রেনের সাহসী জনগণের জন্য আমাদের সমবেদনা।
ন্যাটো প্রধান বলেন, আমাদের মহাদেশের শান্তি ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। এটি ইচ্ছাকৃত, ঠান্ডা মাথার দীর্ঘ-পরিকল্পিত আক্রমণ। রাশিয়া শক্তি খাটিয়ে ইতিহাস নতুন করে লিখতে চায়।
ইউক্রেন পশ্চিমা প্রতিরক্ষা জোটের অংশীদার হলেও ন্যাটোর সদস্য নয়। তবে তারা দীর্ঘদিন থেকে পশ্চিমা এই সামরিক জোটে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার চেষ্টা করছে। ন্যাটোর পক্ষ থেকেও ইউক্রেনকে বহুবার আশ্বাস্ত করা হয়েছে।
কিন্তু সাবেক সোভিয়েত দেশটির ন্যাটো সদস্য হওয়াকে নিজেদের নিরাপত্তার জন্য হুমকি বলে মনে করছে রাশিয়া। আর তা ঠেকাতেই মূলত কিয়েভ প্রশাসনের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান শুরু করেছে মস্কো।
রুশ-আমেরিকা নিরাপত্তা আলোচনার সর্বশেষ পর্বটি প্রমাণ করে যে রাশিয়ার প্রতি আগ্রাসী কূটনৈতিক কার্যকলাপ পরিচালনার জন্য আমেরিকা প্রস্তুত নয় বা সক্ষম নয়।
বাইডেন প্রশাসন ইউরোপের নিরাপত্তা সুরক্ষা দেওয়ার বার্তা দিয়ে রেখেছিল। একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্র ন্যাটো ও ইউক্রেনকে পরস্পরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতে উৎসাহ দিয়ে গেছে, বিশেষ করে কৃষ্ণসাগর ঘিরে, যাতে রাশিয়ার বিরুদ্ধে কৌশলগত আক্রমণ শক্তিশালী করা যায়। কিন্তু শেষ মুহূর্তে মাথার উপর থেকে ছাদ কেড়ে নিল ন্যাটো।
যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো রাশিয়ার সঙ্গে তাদের খেলায় তারা ইউক্রেন ইস্যুতে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে চায়। তারা ইউক্রেনকে সামরিক সহযোগিতা দিয়ে শুধু আঞ্চলিক পরিস্থিতিকে আলোড়িতই করেনি, বরং রাশিয়ার সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংঘাত এড়াতে তারা ন্যাটো সদস্যের বাইরে থাকা ইউক্রেনকে ব্যবহারও করতে চায়।
তবে এই কৌশলটি রাশিয়ার জানা। তাই মস্কো কৌশলগত ক্ষতি এড়াতে সামরিক সংঘাত বৃদ্ধি পাওয়ার মধ্যেই ন্যাটোকে তার ইউক্রেনের সঙ্গে সম্পর্ক স্পষ্ট করতে বাধ্য করেছে।
রাশিয়ার বক্তব্য, সোভিয়েত এবং বার্লিনের দেওয়াল ভাঙার আগে স্পষ্ট ভাগ ছিল। ঠান্ডা যুদ্ধের সময় ভূরাজনৈতিক অবস্থান স্পষ্ট ছিল। রাশিয়া চায় ইউরোপে ফের রাজনীতি এবং কূটনীতির পরিসর স্পষ্ট হোক। ইউক্রেন নিয়ে অ্যামেরিকা এবং ন্যাটো যে রাজনীতি করছে, তাতে ভূরাজনৈতিক ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে বলে রাশিয়ার বক্তব্য।
বিভিন্ন দিক বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ইউক্রেন প্রসঙ্গে রাশিয়া ও পশ্চিমের শক্তিদের মাঝে চলমান অচলাবস্থার কেন্দ্রে রয়েছে নিরাপত্তা জোট ন্যাটো।
রাশিয়া নিশ্চয়তা চেয়েছিল, তাদের প্রতিবেশী ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্যতম শরীক ইউক্রেন কখনোই ন্যাটোতে যোগ দিতে পারবে না। অর্থাৎ, ইউক্রেনের এই জোটে যোগদানের ওপর চিরস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে হবে, এমনটাই চাইছিল ক্রেমলিন।
এছাড়াও তারা ন্যাটোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছিল, পূর্ব ইউরোপের সব ধরনের সামরিক সম্প্রসারণ কার্যক্রম বন্ধ রাখতে। বস্তুত, ন্যাটো পুরো অঞ্চলের নিরাপত্তাকে ঝুঁকির মুখে ফেলেছে বলে দাবি করছে রাশিয়া।
তবে পশ্চিমা পরাশক্তিরা রাশিয়ার এসব দাবি মেনে নিতে প্রস্তুত নয়। তারা যুক্তি দেন, রাশিয়া, ইউক্রেনের পররাষ্ট্র নীতির সিদ্ধান্তে নাক গলাতে পারে না। তারা ন্যাটোর ‘খোলা দরজা নীতির’ কথা উল্লেখ করে জানান, যেকোনো ইউরোপীয় রাষ্ট্র ন্যাটোর সদস্যপদ চাইতে পারে।
রাশিয়া আর ন্যাটোর এই সাংঘর্ষিক অবস্থানই আজকের ইউক্রেনের পরিস্থিতির জন্য দায়ী। পুতিনের মতে, পশ্চিমের শক্তিরা মস্কোর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। তার মতে, স্নায়ু যুদ্ধের শেষের দিকে রাশিয়ার সঙ্গে ন্যাটোর মৌখিক চুক্তি হয়েছিল যে তারা ইউরোপের পূর্বদিকে তাদের প্রভাব আর বিস্তার করবে না। তবে ন্যাটো এ ধরনের কোনো প্রতিশ্রুতির কথা মেনে নেয়নি।
মূলত ওয়াশিংটন ও ন্যাটো ক্রেমলিনের মূল দাবিগুলো মেনে নেয়নি আর রাশিয়াও তাদের দাবিতে অনমনীয় থেকেছে। ফলে পূর্ব ইউরোপের উত্তেজনা কমেনি, বরং বেড়েছে। ন্যাটো বাহিনীও ইউরোপের পূর্ব প্রান্তে অতিরিক্ত সেনা ও সামরিক সরঞ্জামের কলেবর বাড়িয়েছে।
ইউক্রেন সংকট ও রুশ-মার্কিন মিথস্ক্রিয়া ইউরোপকে অসুখী ও উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। তাই নিজেদের ভাগ্য নিজেদের হাতে তুলে নেওয়ার জন্য ইউরোপের উচিত কৌশলগত স্বায়ত্তশাসনকে প্রকৃত অর্থে বাস্তবে প্রতিফলিত করা। তাকে ‘ইউরোপীয় সমস্যার ইউরোপীয় সমাধানের অগ্রাধিকার’ দেওয়ার জন্য মন স্থির করতে হবে। অন্যদের ওপর নির্ভর করার মূল্য হলো অন্যদের প্রভাবের প্রতি দুর্বলতা।
এসডব্লিউ/এসএস/১২১৫
আপনার মতামত জানানঃ