ডিসেম্বর থেকেই উত্তেজনার পারদ উঠতে শুরু করেছিল৷ পশ্চিমা দেশগুলো বলে আসছিল, ইউক্রেনে আগ্রাসন চালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে রাশিয়া৷ তখন থেকেই উদ্বেগের শুরু দেশটিতে অবস্থানরত বাংলাদেশিদের।
ইউক্রেন-রাশিয়া পরিস্থিতি নিয়ে কয়েক সপ্তাহ ধরেই নানা আলোচনা, পর্যালোচনার মধ্যে বৃহস্পতিবার স্থানীয় সময় সকাল সাড়ে ১০টার দিকে ইউক্রেনে হামলা শুরু করে রাশিয়া।
এর আগে সোমবার ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের নিয়ন্ত্রণে থাকা দুটি অঞ্চলকে ‘স্বাধীন’ রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দিয়ে ‘শান্তি রক্ষার’ নামে সেখানে সেনা পাঠিয়েছে রাশিয়া৷ আর এ ঘটনাকে আগ্রাসনের সূচনা হিসেবে দেখছে পশ্চিমা দেশগুলো, রাশিয়ার ওপর জারি করা হচ্ছে একের পর এক অবরোধ৷
যুদ্ধ বাঁধার শঙ্কায় বিভিন্ন দেশ ইতোমধ্যে ইউক্রেন থেকে তাদের নাগরিকদের সরিয়ে নিতে শুরু করেছে, বাংলাদেশের প্রতিবেশী ভারতও সেখানে উড়োজাহাজ পাঠিয়েছে নাগরিকদের ফিরিয়ে আনার জন্য৷
সোয়া ৪ কোটি জনসংখ্যার দেশ ইউক্রেনে দেড় হাজারের মতো বাংলাদেশি রয়েছেন৷ কেউ কেউ ব্যবসা করেন, অনেকে পড়তে গেছেন৷
ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযানের মধ্যে সে দেশে অবস্থানকারী বাংলাদেশিদের মধ্যেও ছড়িয়েছে আতঙ্ক। তারা দেশ ছাড়তে মরিয়া। কিন্তু কোনো উপায় খুঁজে না পেয়ে অসহায় বোধ করছেন।
দেশটিতে বাংলাদেশের একটি বহুজাতিক কোম্পানির একটি প্রকল্পে কাজ করছেন তৌহিদুল ইসলাম। থাকেন মাইকোলাইভ শহরে। তিনি জানিয়েছেন সেখানকার অবস্থা।
নিউজবাংলাকে তৌহিদুল বলেন, ‘আমি এবং আমার স্ত্রী এখানে থাকি। সঙ্গে আমাদের একটি ছেলেসন্তানও আছে। সবার মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে।’
ইউক্রেনে বাংলাদেশের কোনো দূতাবাস নেই। দেশটিতে অবস্থানকারী বাংলাদেশিদের পোল্যান্ডে বাংলাদেশ দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে। সেখানকার কর্মকর্তারা বাংলাদেশিদের সতর্ক ও তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে বলেছেন, পোল্যান্ডে যাওয়ার পরামর্শও দিয়েছেন।
তবে পোল্যান্ডে যাওয়া এখন সম্ভব নয়- বলছিলেন তৌহিদুল। বলেন, ‘এমন পরিস্থিতিতে পোল্যান্ডে ভিসা পাওয়া কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এগুলোর ফরমালিটি সময়সাপেক্ষ ব্যাপার।’
তৌহিদুল জানান, ইউক্রেন সীমান্তে রাশিয়ান ফেডারেশন এবং বেলারুশপন্থি রুশ সৈন্যরা হামলা চালায়। বাংলাদেশ সময় ভোর সাড়ে ৫টার দিকে ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চল এবং উত্তরাঞ্চলীয় লুহানস্ক, সামি, খারকিভ, ছেরনিহিভ এবং ঝিতোমির অঞ্চলে হামলা চালানো হয়।
এরপর সকাল সাড়ে ১০টার দিকে ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভ বিমানবন্দরে হামলা হয়। ইউক্রেন সরকার তাদের মতো করে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে প্রতিরোধের। তবে তারা যুদ্ধ চায় না।
তিনি বলেন, ‘অনেক প্রবাসী বাংলাদেশি ইউক্রেন ছাড়তে চাইলেও তা সম্ভব হচ্ছে না। বিমানবন্দরে হামলা চালানো হয়েছে। আবার ইউক্রেনকে তিন-চার দিক থেকে ঘিরে রাখা হয়েছে।’
মাইকোলাইভ শহরের আরেক বাসিন্দা আমিনা খাতুন বলেন, ‘দূতাবাস থেকে গতকাল (বুধবার রাতে) একটি জুম মিটিং করা হয়েছিল। সে সময় আমাদের সতর্ক থাকার পরামর্শ দেয়া হয়। তারা সার্বিক বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছে। বাংলাদেশিদের সুরক্ষা এবং যারা ইউক্রেন ছাড়তে চায়, তাদের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নেয়া হবে।
‘তবে বর্তমানে ইউক্রেনে যে পরিস্থিতি বিরাজ করেছে তাতে করে খুব বেশি আশা করতে পারছি না। আমি যে শহরে বসবাস করছি এখানে অনেক বাংলাদেশি আছেন, অনেকে পরিবার নিয়েও বসবাস করছেন। সবার মাঝেই একটা আতঙ্ক বিরাজ করছে। শুধু প্রবাসী নয়, ইউক্রেনের জনগণের মধ্যেও ভয়াবহ যুদ্ধের আতঙ্ক বিরাজ করছে।’
ইউক্রেনে অবস্থানরত বাংলাদেশিদের সুরক্ষার অনুরোধও জানিয়েছেন আমিনা। বলেন, ‘যেসব প্রবাসী দেশে ফিরে যেতে চান, তাদের যেন দ্রুত সময়ের মধ্যে ফিরিয়ে নেয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।’
কিয়েভে পোল্যান্ডের দূতাবাসও বিদেশিদের নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে বলে জানান দেশটিতে অবস্থানরত মাহবুব আলম। পোলিশ দূতাবাসের বরাত দিয়ে তিনি জানান, ‘পোলিশ অথরিটি আমাদের জানিয়েছে যদি সে রকম জরুরি পরিস্থিতি তৈরি হয়, তাহলে ইউক্রেনে যারা বিদেশি আছেন, তাদের জন্য হয়ত সহজে পোল্যান্ড চলে যাওয়ার একটা ব্যবস্থা করা হবে। এমন সিদ্ধান্ত তারা নিচ্ছেন বলে আমাদের জানানো হয়েছে।’
এ বিষয়ে পোল্যান্ডে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সুলতানা লায়লা হোসেন বিবিসি বাংলাকে বলেন, ইউক্রেনে বসবাসরত প্রায় পাঁচশ বাংলাদেশি তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন এবং তারা চলে যেতে চাইলে তাদের কী ধরনের সহায়তা দেওয়া যাবে, তা নিয়ে তারা ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন।
পোল্যান্ড সরকার ইউক্রেনের সঙ্গে সীমান্ত খুলে দিয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘পোল্যান্ড সরকার এক ব্রিফিংয়ে আমাদের জানিয়েছে, ইউক্রেনে থাকা তৃতীয় দেশের নাগরিকরা সেদেশ ছাড়তে চাইলে, পোল্যান্ড ১৫ দিনের জন্য তাদের ট্রানজিটে থাকার অনুমতি দেবে।’
বর্তমান পরিস্থিতিকে ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, যুদ্ধের উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ার পর বাংলাদেশিসহ সকল অভিবাসী কমিউনিটিই আতঙ্কিত। আমি কিয়েভে বসবাসরত প্রায় ১০০ বাংলাদেশিকে চিনি যারা ছোটখাটো ব্যবসা কিংবা চাকরি করেন। সবাই আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন।
এদিকে ইউক্রেনের এই উত্তপ্ত পরিস্থিতি নিয়ে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম সম্প্রতি সাংবাদিকদের বলেন, ইউক্রেনে বসবাসকারী ব্যক্তিরা বাংলাদেশে ফিরতে চান কি না সেটি তাদের ব্যাপার।
তবে ইউক্রেনে অবস্থানরত বাংলাদেশিরা যদি নিজ দেশে ফেরার পরিকল্পনা করেন তাহলে ইউক্রেনের প্রতিবেশি দেশগুলোর কাছে সহায়তা চাওয়াসহ বাংলাদেশ সব ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করবে বলে তিনি নিশ্চয়তা দেন।
তিনি বলেন,যখনই কোনো দেশ বা অঞ্চলে রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দেয়, আমরা নাগরিকদের সতর্ক করি ও সাবধানে থাকার পরামর্শ দিই।
মাইকোলাইভ সিটির স্থানীয় বাসিন্দা আলেনা গ্রিগোরিয়েভা বলেন, ‘রাশিয়া আমাদের ওপর অন্যায্যভাবে হামলা চালাচ্ছে। ইতোমধ্যে কয়েকজনের হতাহতের ঘটনা জানতে পেরেছি। প্রেসিডেন্ট ভেলাদিমির জেলেনস্কি আমাদের আতঙ্কিত না হয়ে ধৈর্য ধারণ করতে বলেছেন, মনে সাহস রাখতে বলছেন।’
গ্রিগোরিয়েভা বলেন, ‘আমাদের দেশের জনগণ বা প্রেসিডেন্ট কখনও যুদ্ধের পক্ষে নন, আমরা শান্তিতে বিশ্বাসী। তবে আমরা আমাদের সর্বশক্তি দিয়ে লড়ে যাব। ইউক্রেন আবার ঘুরে দাঁড়াবে ।
জাতিসংঘ কোনো পদক্ষেপ না নেয়ায় হতাশার কথাও জানান এই ইউক্রেনিয়ান। তিনি বলেন, ‘আমরা হতাশা অনুভব করছি যে জাতিসংঘ এখনও কেন সঠিক উদ্যোগ নিচ্ছে না রাশিয়ার বিরুদ্ধে।’
ইউক্রেন সীমান্তে কয়েক সপ্তাহ ধরেই লক্ষাধিক সেনা মোতায়েন করে রেখেছে রাশিয়া। ট্যাংক ও কামানসহ যুদ্ধবিমানের বহরও ইউক্রেন সীমান্তে নিয়মিত টহলে রাখা হয়।
এসডব্লিউ/এসএস/২১১০
আপনার মতামত জানানঃ