সংবিধান, উচ্চ আদালতের নির্দেশনা ও সংশ্লিষ্ট আইনে শাস্তির বিধান থাকলেও দেশে থেমে নেই হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু। সুনামগঞ্জের শান্তিগঞ্জে পুলিশের নির্যাতনে উজির মিয়া (৩৫) নামে এক আসামির মৃত্যুর অভিযোগ উঠেছে। এ অভিযোগে লাশ নিয়ে সুনামগঞ্জ-সিলেট সড়ক অবরোধ করেছেন এলাকাবাসী। আজ সোমবার বেলা দুইটা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত জেলার শান্তিগঞ্জ উপজেলার সুনামগঞ্জ-সিলেট সড়কের পাগলাবাজার এলাকায় স্থানীয় লোকজন সড়কে লাশ রেখে বিক্ষোভ করেন।
উজির মিয়াকে ৯ ফেব্রুয়ারি গ্রেপ্তার করেছিল শান্তিগঞ্জ থানা-পুলিশ। তার বাড়ি উপজেলার শত্রুমর্দন গ্রামে। তার ছোট ভাই ডালিম মিয়া বলেন, তার ভাইকে পুলিশ ধরে নিয়ে থানায় নির্যাতন করে। পরদিন তাকে একটি চুরির মামলায় আদালতে পাঠালে জামিনে মুক্ত হন। এরপর থেকে উজির মিয়া গুরুতর অসুস্থ হন। এ অবস্থায় আজ দুপুরে তিনি মারা যান।
এরপর বিক্ষুব্ধ স্বজন ও এলাকাবাসী উজির মিয়াকে নির্যাতনে জড়িত পুলিশ সদস্যদের বিচারের দাবিতে লাশ নিয়ে সড়ক অবরোধ করেন। এ সময় সড়কের দুই পাশে শত শত যানবাহন আটকা পড়ে। ঘটনাস্থল থেকে শান্তিগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ফারুক আহমদ দুপুরে জানান, তারা ঘটনাস্থলে আছেন। তখনো সড়কে অবরোধ চলছিল।
অবরোধকারীদের শান্ত করতে দক্ষিণ সুনামগঞ্জের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ঘটনাস্থলে গিয়ে তোপের মুখে পড়েন। পরে দ্রুত স্থান ত্যাগ করেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আনোয়ারুজ্জামান। এ সময় তার গাড়ি মরদেহের ওপর দিয়ে এসেছে, এমন কথা ঘটনাস্থলে প্রচার হয়ে পড়লে আরও বিক্ষুব্ধ হয় সাধারণ মানুষ।
বিক্ষোভকারীদের নেতা উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ইমরান হোসেন তালুকদার জানান, গত ৯ ফেব্রুয়ারি শান্তিগঞ্জ উপজেলার পশ্চিম পাগলা ইউনিয়নের শত্রুমর্দন গ্রামের উজির মিয়া নামের এক ব্যক্তিকে গরু চোর সন্দেহে আটক করে পুলিশ। ১১ ফেব্রুয়ারি জামিন লাভ পান তিনি। এ সময় পুলিশের নির্যাতনে অসুস্থ ছিলেন উজির মিয়া। এই অবস্থায় তাকে সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে সেখান থেকে সিলেট ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হলে সোমবার তার মৃত্যু হয়।
তার ছোট ভাই ডালিম মিয়া বলেন, তার ভাইকে পুলিশ ধরে নিয়ে থানায় নির্যাতন করে। পরদিন তাকে একটি চুরির মামলায় আদালতে পাঠালে জামিনে মুক্ত হন। এরপর থেকে উজির মিয়া গুরুতর অসুস্থ হন। এ অবস্থায় আজ দুপুরে তিনি মারা যান।
এ ঘটনায় শান্তিগঞ্জ থানার এস আই আলাউদ্দিন, এসআই দেবাশীষ, এসআই পার্ডন কুমার সিংহ-এর বিচারের দাবিতে উজির মিয়ার মরদেহ নিয়ে পথ অবরোধ করেছেন সাধারণ জনতা।
সুনামগঞ্জের পুলিশ সুপার (এসপি) মিজানুর রহমান জানান, ওই ব্যক্তিকে আটক করা হয়েছিল গত ৯ ফেব্রুয়ারি। একদিন হাজতে রেখে পরে কোর্টের মাধ্যমে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। গত ১১ তারিখে তিনি জামিনে মুক্ত হয়ে বাড়ি চলে যান। এরপর একদিন হয়তো তিনি অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। কিন্তু সোমবার সকালে নাকি তার মৃত্যু হয়েছে বলে জানতে পেরেছি। তবে এ বিষয়ে এখনও বিস্তারিত কিছু বলতে পারছি না। আমরা খোঁজ নিচ্ছি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘কারাগারগুলোতে নির্যাতন একটি প্র্যাকটিসে (অভ্যাস) পরিণত হয়েছে। এখন থেকেই যদি এগুলো শক্ত হাতে মোকাবিলা করা না যায়, তাহলে এসব বন্ধ করা খুব কঠিন হবে।
তারা বলেন, ‘অপরাধীরা অপরাধ করবেই। কিন্তু আইনের লোক তো অপরাধীর মতো আচরণ করতে পারে না। তাদের চাকরিতে প্রবেশের আগে যে প্রশিক্ষণ তা আরও যুগোপযোগী, মানবতা উপযোগী এবং কর্তব্যনিষ্ঠ উপযোগী হওয়া উচিত।’
তারা বলেন, ‘আসলে আমাদের দেশে কারগারগুলো প্রযুক্তিনির্ভর নয়। এর কারণ হচ্ছে, কর্তৃপক্ষের ধারণা যে, মারধর-নির্যাতন না করলে কেউ তথ্য দেয় না, দোষ স্বীকার করে না। ক্ষমতা জাহির করার জন্য, এক ধরনের ভয়ার্ত পরিবেশ সৃষ্টি করতে এই চর্চা ও মানসিকতা দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে।’
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্যক্তিগত রেশ মেটানোর হাতিয়ার হয়ে উঠেছে দেশের আইন। আইনের সাথে জড়িত কর্তাব্যক্তিরা এর অপব্যবহারের পাশাপাশি ব্যক্তিগত উদ্দেশ্য হাসিলের রেওয়াজ প্রচলিত। কেন নির্যাতন করা হয়েছে এবিষয়ে আসামিদের তদন্ত করলে অনেক কিছুই বেরিয়ে আসবে। কদিন আগে বন্দীকে নারীসঙ্গের ব্যবস্থা করে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল কেন্দ্রীয় কারাগারের কর্তাব্যক্তিদের বিরুদ্ধে। এখন অমানবিকভাবে বন্দীকে নির্যাতনের অভিযোগ এলো। এ থেকে দেশের কারাগারগুলোর এক ভয়ানকতম চিত্র উঠে আসে বলে জানান বিশেষজ্ঞরা। তারা এর সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করে আসামিদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানান।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগের পাল্লা ক্রমশ বেড়েই চলছে। আর এসবের সবকটাই ক্ষমতার অপব্যবহারকে কেন্দ্র করেই হয়ে থাকে বলে মনে করেন তারা।
তারা বলেন, পুলিশে ঢোকার পর স্বাভাবিক একজনের ভেতরেও আশ্চর্য এক পরিবর্তন আসে। স্থানীয় পর্যায়ে ক্ষমতার চূড়ান্ত ভেবে তারা যা ইচ্ছা তা করার মানসিকতা নিয়ে দাপটের সাথে চলতে থাকেন। ফলে ঘর থেকে বাহির কেউ তাদের কুৎসিত হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না। আইনের প্রতি যথাযথ শ্রদ্ধাশীল না হলে পুলিশের বিরুদ্ধে এমন আরও অসংখ্য অভিযোগ আসতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেন তারা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯১৩
আপনার মতামত জানানঃ