পূর্ব ইউরোপের দেশ ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভের জনজীবন স্বাভাবিক হলেও দোটানায় আছেন বাংলাদেশিরা। হয়তো রাশিয়া হামলা করতে পারে আবার কিছুই হবে না; এমন চিন্তায় আছেন বেশিরভাগ মানুষ। তবে কেউ কেউ দুই-একদিনের মধ্যে হামলা হবে এই আশঙ্কায় রাজধানী ছেড়ে রওনা হয়েছেন পোল্যান্ডের সীমান্তঘেঁষা লেভিভ অঞ্চলে। এখন বাংলাদেশিদের মনে প্রশ্ন হামলা হলে যাবে কোথায়, পোল্যান্ড কি বাংলাদেশিদের আশ্রয় দেবে? আর এই প্রশ্নকে উস্কে দিচ্ছে ইউক্রেনের সেনা ও রুশপন্থীরা পাল্টাপাল্টি হামলা।
ইউক্রেনের বর্তমান অবস্থা
ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে টানা দুই দিন ধরে ইউক্রেনের সরকারি বাহিনী ও রুশপন্থী বিদ্রোহীরা পরস্পরের ওপর গোলাবর্ষণ চালিয়ে যাচ্ছে। বিচ্ছিন্নতাবাদীদের পক্ষ থেকে বৃহস্পতিবার বলা হয়েছে, ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে রুশপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ওপর হামলা চালিয়েছে সরকারি বাহিনী।
তারা জানিয়েছে, তাদের এলাকায় ২৪ ঘণ্টায় অন্তত চার দফা ফাঁকা গুলি ছোড়া হয়েছে। পালটা একই অভিযোগ করেছে ইউক্রেনীয় কর্তৃপক্ষ। তবে সরকারি বাহিনীর এই হামলায় হতাহতের বিষয়টি এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এএফপি ও আল জাজিরা।
স্বঘোষিত লুহানস্ক পিপলস রিপাবলিকের প্রতিনিধিদের পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে হামলার দাবি করা হয়েছে। তারা বলছে, কামানের গোলা, গ্রেনেড এবং মেশিনগান ব্যবহার করে চার দফা হামলা চালানো হয়েছে। রুশ সেনা প্রত্যাহারের খবরের মধ্যে এ ঘটনায় নতুন করে আতঙ্ক ছড়িয়েছে।
এদিকে, রাশিয়ায় সেনা প্রত্যাহারের দাবি পুরোপুরি মিথ্যা বলে অভিহিত করেছেন পশ্চিমা নেতারা। তাদের দাবি, সেনা প্রত্যাহারের বদলে আরও কয়েক হাজার সেনা মোতায়েন করা হয়েছে।
ইউক্রেনের সরকারি বাহিনী ও বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মধ্যে এ ধরনের ঘটনা গত ৮ বছরে বেশ কয়েকবার ঘটছে। তবে এবারের হামলার বিষয়টা কিছুটা আলাদা।
কারণ সাম্প্রতিক সময়ে ইউক্রেন সীমান্তে রাশিয়ার লাখ খানেক সেনা মোতায়েনকে কেন্দ্র করে বেশ উত্তেজনা বিরাজ করছে। তার মধ্যেই পূর্ব ইউক্রেনে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ওপর সরকারি বাহিনীর হামলা হয়তো ভিন্ন কোনো বার্তাই দিচ্ছে। তবে সেটা কী তা সময়ই বলে দেবে।
ইউক্রেন সীমান্তে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে প্রায় দুই লক্ষ সেনা মোতায়েন করে রেখেছে রাশিয়া। যেকোনো সময় আগ্রাসন চালানো হতে পারে বলে দাবি পশ্চিমা নেতাদের। তবে হামলার কোনো পরিকল্পনা নেই বলে দাবি করে আসছেন রুশ নেতারা।
চলতি সপ্তাহে মস্কো ঘোষণা দিয়ে জানায়, সীমান্ত থেকে কিছু সেনা প্রত্যাহার করা হচ্ছে। সর্বশেষ বৃহস্পতিবারও রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, মহড়া শেষ করে সীমান্ত থেকে ট্যাংক ও সামরিক যানগুলো ঘাঁটিতে ফিরে আসছে। পুরোপুরি সেনা প্রত্যাহারে সময় লাগবে বলেও বিবৃতিতে জানানো হয়েছে।
এদিকে, ইউক্রেনের সরকারি বাহিনী ও রুশপন্থী বিদ্রোহীদের সংঘর্ষে উত্তেজনা বেড়ে যাওয়ায় ওয়াশিংটন এবং তার পশ্চিমা মিত্ররা আশঙ্কা করছে, রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের অজুহাত হতে পারে এটি। তবে রাশিয়া পশ্চিমাদের এমন অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছে, তারা ইউক্রেন আক্রমণের সর্বাত্মক পরিকল্পনা করছে না।
বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে একটি কূটনৈতিক সূত্র জানিয়েছে, ২০১৫ সালে পূর্ব ইউরোপে সরকারি বাহিনী ও বিদ্রোহীদের মধ্যে যুদ্ধবিরতি হয়েছিল। এরপর থেকে গত দুই দিনের তীব্র গোলাবর্ষণ সবচেয়ে বড় লড়াইয়ের ঘটনা।
ইউক্রেন ত্যাগ করার পরামর্শ
ইউক্রেনে সাম্প্রতিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সেখানে অবস্থানরত বাংলাদেশিদের ওই দেশ ত্যাগ করার পরামর্শ দিয়েছে পোল্যান্ডে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাস। মঙ্গলবার (১৫ ফেব্রুয়ারি) এক বিজ্ঞপ্তিতে এই তথ্য জানায় দূতাবাস।
দূতাবাসের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সাম্প্রতিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে ইউক্রেনে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশিদের অবিলম্বে ইউক্রেন ত্যাগ করার পরামর্শ দেওয়া যাচ্ছে। অন্য কোনও দেশে যেতে না পারলে তারা বাংলাদেশে যেতে পারেন। ঘটনাবলী পর্যবেক্ষণ করে পরে দূতাবাসের পক্ষ থেকে পরামর্শ হালনাগাদ করা হবে।
এতে আরও বলা হয়, একইসঙ্গে সব বাংলাদেশিকে অত্যাবশ্যকীয় না হলে ইউক্রেনে সব ধরনের ভ্রমণ পরিহার করার পরামর্শও দেওয়া হলো। এছাড়া ইউক্রেনে অবস্থানরত সব বাংলাদেশিকে তাদের অবস্থানের তথ্য দূতাবাসকে অবহিত রাখার অনুরোধও করা হয়। যাতে জরুরি প্রয়োজনে দূতাবাস তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে
রাশিয়ার সঙ্গে তৈরি হওয়া উত্তেজনাকর পরিস্থিতে ইউক্রেনে বাংলাদেশিরা এখনও নিরাপদে আছেন বলে জানিয়েছেন পোল্যান্ডে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সুলতানা লায়লা। সুলতানা লায়লা বলেন, “ইউক্রেনে অবস্থিত বাংলাদেশিরা নিরাপদে এবং ভালো আছেন। তাদের খোঁজখবর নেওয়ার জন্য আলাদা সেল গঠন করা হয়েছে।”
ইউক্রেনে বাংলাদেশের দূতাবাস না থাকায় পোল্যান্ডের ওয়ারশ’তে থাকা দূতাবাস থেকেই ইউক্রেনের সঙ্গে বিষয়গুলো দেখভাল করা হয়।
ইউক্রেনে বাংলাদেশিদের সিঙ্গেল ভিসা দেয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে জানিয়ে রাষ্ট্রদূত সুলতানা লায়লা বলেন, “বাংলাদেশিদের পাসপোর্টের সমস্যাগুলো দ্রুত সমাধান করা হচ্ছে। সিঙ্গেল ভিসার ব্যাপারে ইউক্রেন সরকারের সাথে আলোচনা হয়েছে।”
কেমন আছে দেশটির বাংলাদেশিরা?
ইউক্রেনে অবস্থানরত বাংলাদেশিরা জানায়, কেউ কেউ এখনই হামলার আশঙ্কা না করলেও অনেকেরই ধারণা হয়তো আগামীকালই হামলা হতে পারে। আর এই আশঙ্কায় অনেকেই ট্রেনে রওনা হয়েছেন পোল্যান্ডের সীমান্ত ঘেঁষা লেভিভে। বর্তমানে কী পরিমাণ বাংলাদেশি সেদেশে অবস্থান করছেন তার ধারণা কারও কাছে নেই। তবে বৈধ অবৈধ মিলে দুই থেকে আড়াই হাজার হতে পারে বলে জানান তারা।
এদের একটি বড় অংশই সেখানে উচ্চশিক্ষার জন্য গিয়েছেন। অবৈধরা বেশিরভাগই রাশিয়া বিশ্বকাপের পর সেদেশে প্রবেশ করেছেন।
ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভে অবস্থানরত বাংলাদেশি শিক্ষার্থী ফাত্তা খান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ১৬ ফেব্রুয়ার রাশিয়া আক্রমণ করতে পারে এমন ধারণা অনেকের। বিভিন্ন শহরে বন্ধুবান্ধব আছে, সবাই পরিস্থিতি স্বাভাবিক বলছে। রাশিয়ার সীমান্ত ঘেঁষা শহরের একজনের সঙ্গে কথা বললাম। সেও বললো সমস্যা নেই। তবে টিভি চ্যানেলে যেভাবে সংবাদ প্রচার হচ্ছে তাতে আমরা ভয় পাচ্ছি।
তিনি আরও বলেন, আমাদেরকে বলা হচ্ছে পোল্যান্ডের সীমান্তের দিকে যেতে। আমরা এই আবহাওয়ায় সেখানে গিয়ে কী করবো। দূতাবাস যদি সীমান্তে ক্যাম্প তৈরি করে বাংলাদেশিদের জন্য সেইফ জোন বানিয়ে রাখতো তাহলে যাওয়া যেতো। এখান থেকে তো গিয়ে থাকা লাগবে হোটেলে, এখানে এক মাসে যে ভাড়া দেই হোটেলের ভাড়া সেটা দুই দিনে চলে যাবে। সবার পক্ষে তো সেটা সম্ভব নয়।
দূতাবাস বলছে অন্য দেশে যেতে, কিন্তু আমাদের তো অন্য দেশ ভিসা দেবে না। ইউক্রেনের পাসপোর্ট যাদের আছে তাদের যেতে দেবে হয়তো। আমাদেরকে তো ভিসা প্রসেস করে যেতে হবে। আর ইউরোপ তো কোনোদিন আমাদের প্রবেশ করতে দেবে না। এখানে স্টুডেন্টদের কাছে টেম্পোরারি কার্ড আছে। সেটার মেয়াদ যতদিন আছে ততদিন আমরা এখানে বৈধ। আমরা এখনও সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না।
অপর এক বাংলাদেশি নাগরিক জানান, বাংলাদেশ যদি যেতে চাই কীভাবে পাঠাবে জানি না। আজ শুনলাম ফ্লাইট বন্ধ করে দিচ্ছে। রাজধানী থেকে পোল্যান্ডের সীমান্ত প্রায় দেড় হাজার কিলোমিটার দূরে। এখানে মানুষদের মধ্যে কোনও উদ্বেগ উৎকণ্ঠা নেই। চারপাশে যে যুদ্ধাবস্থা তৈরি হয়েছে সেটা গায়ে লাগায় না কেউ।
দূতাবাস যদি সেইফ জোনে নিতে চায় নির্দিষ্ট একটা জায়গা বলুক। শুধু সেইফ জোন বলা হলে আমরা কোন দিকে যাবো? এই তাপমাত্রার মধ্যে আমরা তো জঙ্গলে গিয়ে মরতে পারবো না।
এসডব্লিউ/এসএস/১৫১০
আপনার মতামত জানানঃ