দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ইউরোপে এবার সবচেয়ে বড় সেনা সমাবেশ ঘটেছে। প্রায় দুই লাখ। তার সাথে আছে পরমাণু অস্ত্রের হুঙ্কার। এদিকে, ইউরোপীয় কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের (ইসিএফআর) চালানো প্যান-ইউরোপিয়ান জরিপে দেখা গেছে, সংখ্যাগরিষ্ঠ উত্তরদাতা মনে করছেন, এই একুশ শতকেই একটি যুদ্ধ বেঁধে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। আশঙ্কাটিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে আগেভাগেই ইউরোপের যথাযথ প্রস্তুতি নেওয়া উচিত। যদিও একবিংশ শতাব্দীতে ইউরোপে যুদ্ধ বাধবে, অল্প কিছুদিন আগেও এ ধারণা কল্পনায় আনা যেত না।
ইউক্রেনের সেনা ও রুশপন্থীরা পাল্টাপাল্টি হামলা
ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে টানা দুই দিন ধরে ইউক্রেনের সরকারি বাহিনী ও রুশপন্থী বিদ্রোহীরা পরস্পরের ওপর গোলাবর্ষণ চালিয়ে যাচ্ছে। বিচ্ছিন্নতাবাদীদের পক্ষ থেকে বৃহস্পতিবার বলা হয়েছে, ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে রুশপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ওপর হামলা চালিয়েছে সরকারি বাহিনী।
তারা জানিয়েছে, তাদের এলাকায় ২৪ ঘণ্টায় অন্তত চার দফা ফাঁকা গুলি ছোড়া হয়েছে। পালটা একই অভিযোগ করেছে ইউক্রেনীয় কর্তৃপক্ষ। তবে সরকারি বাহিনীর এই হামলায় হতাহতের বিষয়টি এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এএফপি ও আল জাজিরা।
স্বঘোষিত লুহানস্ক পিপলস রিপাবলিকের প্রতিনিধিদের পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে হামলার দাবি করা হয়েছে। তারা বলছে, কামানের গোলা, গ্রেনেড এবং মেশিনগান ব্যবহার করে চার দফা হামলা চালানো হয়েছে। রুশ সেনা প্রত্যাহারের খবরের মধ্যে এ ঘটনায় নতুন করে আতঙ্ক ছড়িয়েছে।
এদিকে, রাশিয়ায় সেনা প্রত্যাহারের দাবি পুরোপুরি মিথ্যা বলে অভিহিত করেছেন পশ্চিমা নেতারা। তাদের দাবি, সেনা প্রত্যাহারের বদলে আরও কয়েক হাজার সেনা মোতায়েন করা হয়েছে।
ইউক্রেনের সরকারি বাহিনী ও বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মধ্যে এ ধরনের ঘটনা গত ৮ বছরে বেশ কয়েকবার ঘটছে। তবে এবারের হামলার বিষয়টা কিছুটা আলাদা।
কারণ সাম্প্রতিক সময়ে ইউক্রেন সীমান্তে রাশিয়ার লাখ খানেক সেনা মোতায়েনকে কেন্দ্র করে বেশ উত্তেজনা বিরাজ করছে। তার মধ্যেই পূর্ব ইউক্রেনে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ওপর সরকারি বাহিনীর হামলা হয়তো ভিন্ন কোনো বার্তাই দিচ্ছে। তবে সেটা কী তা সময়ই বলে দেবে।
ইউক্রেন সীমান্তে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে প্রায় লক্ষাধিক সেনা মোতায়েন করে রেখেছে রাশিয়া। যেকোনো সময় আগ্রাসন চালানো হতে পারে বলে দাবি পশ্চিমা নেতাদের। তবে হামলার কোনো পরিকল্পনা নেই বলে দাবি করে আসছেন রুশ নেতারা।
চলতি সপ্তাহে মস্কো ঘোষণা দিয়ে জানায়, সীমান্ত থেকে কিছু সেনা প্রত্যাহার করা হচ্ছে। সর্বশেষ বৃহস্পতিবারও রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, মহড়া শেষ করে সীমান্ত থেকে ট্যাংক ও সামরিক যানগুলো ঘাঁটিতে ফিরে আসছে। পুরোপুরি সেনা প্রত্যাহারে সময় লাগবে বলেও বিবৃতিতে জানানো হয়েছে।
এদিকে, ইউক্রেনের সরকারি বাহিনী ও রুশপন্থী বিদ্রোহীদের সংঘর্ষে উত্তেজনা বেড়ে যাওয়ায় ওয়াশিংটন এবং তার পশ্চিমা মিত্ররা আশঙ্কা করছে, রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের অজুহাত হতে পারে এটি। তবে রাশিয়া পশ্চিমাদের এমন অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছে, তারা ইউক্রেন আক্রমণের সর্বাত্মক পরিকল্পনা করছে না।
বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে একটি কূটনৈতিক সূত্র জানিয়েছে, ২০১৫ সালে পূর্ব ইউরোপে সরকারি বাহিনী ও বিদ্রোহীদের মধ্যে যুদ্ধবিরতি হয়েছিল। এরপর থেকে গত দুই দিনের তীব্র গোলাবর্ষণ সবচেয়ে বড় লড়াইয়ের ঘটনা।
পরমাণু অস্ত্র মোতায়েন
ইউক্রেনের উত্তর সীমান্তে বেলারুশে প্রায় ৩০ হাজার রুশ সেনা অবস্থান করছে। দেশটির কর্মকর্তারা বলছেন, মস্কোর সঙ্গে যৌথ সামরিক মহড়া শেষ হওয়ার পর একজন রুশ সেনাও বেলারুশে অবস্থান করবে না।
তবে প্রেসিডেন্ট আলেক্সান্ডার লুকাশেঙ্কো বৃহস্পতিবার পশ্চিমা নেতাদের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। বলেছেন, প্রয়োজন হলে এবার পরমাণু অস্ত্র মোতায়েন করা হবে। বেলারুশের পরমাণু অস্ত্র নেই। এই হুমকির মধ্য দিয়ে রুশ পরমাণু অস্ত্র মোতায়েনের দিকে ইঙ্গিত করেছেন দেশটির নেতা।
তবে রাশিয়ার নেতাদের সেনা প্রত্যাহার ঘোষণার বাস্তব প্রতিফলন নেই বলে অভিযোগ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এক মার্কিন কর্মকর্তা সতর্ক করে বলেছেন, মস্কোর দাবি পুরোপুরি মিথ্যা। ইউক্রেন সীমান্তের কাছে নতুন করে সাত হাজার সেনা পাঠিয়েছে মস্কো। সেনা সরিয়ে নেওয়ার ঘোষণা দিয়ে রাশিয়া বিশ্বকে বিভ্রান্ত করেছে বলে অভিযোগ করেছে ন্যাটো জোট।
জোটের প্রধান জেন্স স্টলটেনবার্গ বলছেন, রুশ সেনা প্রত্যাহারের কোনো চিহ্নই পাওয়া যাচ্ছে না। প্রায় একই কথা বলেছেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনও।
বৃহস্পতিবার জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তনিও গুতেরেসের সঙ্গে এক ফোনালাপকালে তিনি বলেন, সেনা প্রত্যাহারের প্রমাণ যৎসামান্যই। ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী লিজ স্ট্রাস বলেছেন, ইউক্রেন সংকট এখনই মেটাতে চায় না রাশিয়া। সমস্যা আরও কয়েক মাস জিইয়ে রাখতে পারে তারা।
পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে শিগগিরই পূর্ব-ইউরোপ সফরে যাচ্ছেন তিনি। আগামী শনিবার জার্মানির মিউনিখে জি-৭ জরুরি বৈঠকে যোগ দেওয়ার কথা রয়েছে তার।
বড় লড়াইয়ের আশঙ্কা কতটা?
বৃহস্পতিবার থেকে রুশপন্থী বিদ্রোহীদের সঙ্গে ইউক্রেনের সরকারি বাহিনীর লড়াই শুরু হলে বিশ্বব্যাপী যুদ্ধের শঙ্কা সৃষ্টি হয়। এখন পর্যন্ত এ লড়াইয়ে কোনো প্রাণহানির খবর পাওয়া না গেলেও দুই পক্ষের গোলাগুলি বেড়ে যাওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে।
কূটনৈতিক সূত্র বলছে, শুক্রবার সকালে ৬০০টির বেশি বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে, যা বৃহস্পতিবারের চেয়ে ১০০টি বেশি। সূত্র বলছে, তারা সবার ওপর এমনকি সবকিছুর ওপর গুলি চালাচ্ছে। ২০১৪-২০১৫ সালেও এ রকম দেখা যায়নি। ক্রেমলিনের পক্ষ থেকে এ পরিস্থিতিকে অত্যন্ত ‘বিপজ্জনক’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে।
জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ব্লিঙ্কেন বলেছেন, ওয়াশিংটনের ধারণা, রাশিয়া সর্বাত্মক আক্রমণের পরিকল্পনা করছে। অজুহাত তৈরির মাধ্যমে এ আক্রমণ শুরু করতে পারে। সম্ভবত বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সংঘর্ষের অভিযোগে তারা আক্রমণ চালাবে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন মিত্রদের একত্র করে গতকাল একটি বৈঠক করেছেন। বৈঠকে যুক্তরাজ্য, কানাডা, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, পোল্যান্ড ও রোমানিয়ার সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং ন্যাটোর প্রতিনিধিরা যুক্ত হন।
ক্রেমলিনের পক্ষ থেকে অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে একে ‘পশ্চিমা বিলাপ’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। মস্কো শুক্রবার বলেছে, ইউক্রেনের সীমান্তের কাছ থেকে একটি ট্যাংক ইউনিটসহ আরও দুটি যান্ত্রিক পদাতিক ইউনিটকে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। মস্কোর পক্ষ থেকে তাদের নিরাপত্তা দাবির পাশাপাশি ইউক্রেনে ন্যাটোর সদস্য না করার দাবি জানানো হয়েছে।
এদিকে কূটনীতিক বহিষ্কার নিয়ে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। রাশিয়ার একজন কূটনীতিককে বহিষ্কারের জবাবে রাশিয়া দুজন মার্কিন কূটনীতিককে বহিষ্কার করেছে।
তবে ইউক্রেনের পক্ষ থেকে রাশিয়ার শিগগিরই আক্রমণের আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ওলেক্সি রেজনিকভ শুক্রবার পার্লামেন্টে বলেছেন, ‘আমাদের গোয়েন্দারা সম্ভাব্য হুমকির প্রতিটি পদক্ষেপ খেয়াল রাখছে। আমাদের ধারণা, বড় ধরনের লড়াইয়ের আশঙ্কা কম।’
দ্য গার্ডিয়ান-এর প্রতিবেদনে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্র দাবি করেছে, ইউক্রেনের সীমান্তে রুশ সৈন্যের সংখ্যা আগের ধারণার তুলনায় অনেক বেশি। ইউরোপে নিরাপত্তা ও সহযোগিতা সংস্থার মার্কিন রাষ্ট্রদূত মাইকেল কার্পেন্টার ওএসসিইর এক বৈঠকে বলেছেন, ‘আমাদের মূল্যায়ন অনুযায়ী ইউক্রেন সীমান্তে ১ লাখ ৬৯ হাজার থেকে ১ লাখ ৯০ হাজার সেনা জড়ো করেছে রাশিয়া। জানুয়ারির ৩০ তারিখ পর্যন্ত তা ছিল ১ লাখের মতো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ইউরোপে এটাই সবচেয়ে বড় সেনা সমাবেশ।’
যুক্তরাষ্ট্র অবশ্য ইউক্রেন সীমান্তবর্তী ন্যাটো দেশগুলো শক্তিশালী করার জন্য অতিরিক্ত সেনা পাঠিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন পোল্যান্ড সফরকালে গতকাল বলেছেন, ওয়ারশর কাছে ২৫০টি অ্যাব্রাম ট্যাংক বিক্রি করবে তারা।
এসডব্লিউ/এসএস/১৩১৫
আপনার মতামত জানানঃ