কক্সবাজারে সরকারের তিন লাখ কোটি টাকার ৭২টি মেগা প্রকল্পের কাজ চলছে। এর মধ্যে তিনটি প্রকল্পের শুরুতেই ভূমি অধিগ্রহণে বড় ধরনের দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। কক্সবাজার পৌরসভার মেয়র মুজিবুর রহমান ও আওয়ামী লীগের স্থানীয় কয়েকজন নেতার সহায়তায় দুর্নীতির এ জাল বিস্তারের তথ্য পাওয়া গেছে। কক্সবাজারের সাবেক জেলা প্রশাসকসহ স্থানীয় প্রশাসনের শীর্ষস্থানীয় কিছু কর্মকর্তার নামও এ চক্রে আছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
প্রসঙ্গত, চাকরিচ্যুত দুদক কর্মকর্তা শরীফ উদ্দিন তিনটি প্রকল্পে দুর্নীতি নিয়ে তদন্ত করেন। এতে আমলা, রাজনীতিকসহ ১৫৫ জনের সম্পৃক্ততার তথ্য। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তিনটি তদন্ত প্রতিবেদনে তিনটি প্রকল্পে ভূমি অধিগ্রহণে মোট ৭৮ কোটি টাকার দুর্নীতি হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে তছরুপ হয়েছে প্রায় ৫৯ কোটি টাকা।
এদিকে, শুধু কক্সবাজারে নয়, দেশের যেখানেই সরকারি প্রকল্প হচ্ছে, তার আগাম খবর কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি আগেভাগে জেনে যাচ্ছে। তারা ওই জমি কম দামে কিনে সরকারের কাছে বেশি দামে বিক্রির মধ্য দিয়ে লাভবান হচ্ছে।
দুদক কি জড়িত দুর্নীতিতে?
তিনটি প্রকল্পের ওই দুর্নীতির প্রতিবেদন গত ৩০ জুন দুদকের চট্টগ্রাম জেলা কার্যালয়ে জমা দেওয়া হলেও দুদক থেকে ওই তদন্তের পর অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি এত দিনেও। উল্টো ওই তিনটি তদন্ত বাতিল করে পুনঃ তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এ দুর্নীতির তদন্তে নেতৃত্ব দেওয়া কর্মকর্তা দুদকের উপসহকারী পরিচালক মো. শরীফ উদ্দিনকে প্রথমে বদলি এবং পরে গত বুধবার চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। এর আগে গত ৩০ জানুয়ারি তাকে জীবননাশের হুমকি দেওয়া হয়। দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা উল্টো তার বিরুদ্ধে দুদক চেয়ারম্যানের কাছে ১৯টি অভিযোগ দিয়েছেন।
এদিকে, শরীফ উদ্দিনকে দুদক থেকে চাকরিচ্যুতির প্রতিবাদে রাজধানীর সেগুনবাগিচায় দুদকের প্রধান কার্যালয়ের সামনে মানববন্ধন করেন তার সহকর্মীরা। পরে দুদকের সচিব মো. মাহবুব হোসেনের কাছে সারা দেশের ৩০০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী স্বাক্ষরিত একটি স্মারকলিপিও দেন তারা।
যদিও গত বৃহস্পতিবার বেলা দুইটায় দুদকের প্রধান কার্যালয়ের ফটকে ব্রিফিং করতে এসে শরীফ উদ্দিনকে চাকরিচ্যুত করার বিষয়ে সাংবাদিকদের একের পর এক প্রশ্নের সম্মুখীন হন সচিব মো. মাহবুব হোসেন। জবাবে তিনি বলেন, একটি প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করার জন্য যত রকমের কাজ করা যায়, একটাও বাকি রাখেননি শরীফ উদ্দিন।
দুদকের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনুদ্দিন আবদুল্লাহ সাংবাদিকদের বলেছেন, শরীফ উদ্দিন যে কাজ কারবার করেছেন, যাতে ওই সিদ্ধান্ত নিতে তাঁরা বাধ্য হয়েছেন।
তবে শরীফ উদ্দিন ঠিক কী করেছেন বা তার বিরুদ্ধে কী সেই গুরুতর অভিযোগ, যার ফলে তাঁকে অপসারণ করা ছাড়া দুদকের উপায় ছিল না—এসব বিষয়ে এত প্রশ্নের পরেও সেটা পরিষ্কার করে বলেননি দুদকের চেয়ারম্যান ও সচিব।
জড়িত আ’লীগ ও সরকারি কর্মকর্তারা
দুর্নীতির সঙ্গে ১৫৫ জনের সম্পৃক্ততার তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে, যাদের একটি বড় অংশ আওয়ামী লীগের কক্সবাজারের স্থানীয় নেতা-কর্মী। এতে বলা হয়েছে, কক্সবাজারের সাবেক জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন ওই দুর্নীতির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন।
শরীফ উদ্দিন গতকাল বলেন, ‘কক্সবাজারের কয়েকটি মেগা প্রকল্পের দুর্নীতি অনুসন্ধানে আমি সরকারি কর্মকর্তা, প্রভাবশালী রাজনৈতিক দলের নেতা ও একটি দালাল চক্রের রোষানলে পড়ি। তারা আমাকে তাদের নাম তদন্তে না দেওয়ার জন্য চাপ দেয়। কিন্তু দুর্নীতির প্রমাণ থাকায় আমি তাতে সম্মত হইনি। তাদের হত্যার হুমকিতে আমি জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত আছি। ’
তদন্ত-সংশ্লিষ্ট ও স্থানীয় কয়েকটি সূত্র জানিয়েছে, মূলত ভূমি অধিগ্রহণ নিয়ে তদন্তে প্রাথমিকভাবে সরকারের একজন প্রভাবশালী সচিবের নাম আসে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে তার নাম বাদ দেওয়া হয়। রাখা হয় কক্সবাজারের সাবেক ডিসি কামাল হোসেন, পৌর মেয়র মুজিবুর রহমানসহ ১৫৫ জনের নাম।
দুদকের সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান
বলেন, তিনটি প্রকল্পেই জমির ক্ষতিপূরণের টাকা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য একটি দালাল চক্র সক্রিয় ছিল। তারা ক্ষতিপূরণের টাকা থেকে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ অর্থ কমিশন হিসেবে নিত, যা দালাল চক্রের হাত দিয়ে স্থানীয় রাজনীতিবিদ ও সরকারি সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তাদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হতো।
২০২০ সালে সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থার খবরের ভিত্তিতে কক্সবাজার শহরের একটি বাড়িতে অভিযান চালায় র্যাব। সেখানে জেলা প্রশাসন কার্যালয়ের সার্ভেয়ার মোহাম্মদ ওয়াসিম খানকে গ্রেপ্তার করে তারা। বাসায় পাওয়া যায় ৯৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা। পরে আরও দুই দালালকে গ্রেপ্তার করা হয়। শুধু নগদ টাকা নয়, ওই বাসায় পাওয়া যায় এ তিন প্রকল্পের সরকারি ভূমিসংক্রান্ত সাত বস্তা নথি।
এতে ছিল জমি অধিগ্রহণের জন্য দেওয়া ক্ষতিপূরণের চেক, জমির মালিকদের করা আবেদন ও ভূমিসংক্রান্ত অন্যান্য নথি। ওই নথির সূত্র ধরেই দুদকের তদন্ত কর্মকর্তা মো. শরীফ উদ্দিনের নেতৃত্বে তিনটি আলাদা প্রকল্প নিয়ে তদন্ত হয়। ওই তিন তদন্ত প্রতিবেদনে ভূমি অধিগ্রহণ নিয়ে দুর্নীতির জাল বিস্তারের তথ্য উঠে আসে। গ্রেপ্তার হওয়া ওই তিনজনের দেওয়া জবানবন্দিতে বেরিয়ে আসে ওই চক্রের সঙ্গে থাকা অন্যদের নাম।
দুদকের তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, এর আগে কক্সবাজার থেকে দোহাজারী রেললাইন প্রকল্প, মাতারবাড়ী ১ হাজার ২১২ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, মগনামা পেকুয়া নৌবাহিনী ঘাঁটি প্রকল্প এবং কক্সবাজার বিমানবন্দর প্রকল্পেও ভূমি অধিগ্রহণে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে।
তিনটি প্রকল্পে দুর্নীতির জন্য পৃথক তিনটি মামলা করে দুদক। তদন্তকারী কর্মকর্তার ৭৫০ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদনে ২৩ পদস্থ কর্মকর্তাসহ মোট ৪৪ জন সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আনা হয়। এতে কক্সবাজার পৌরসভার মেয়র মুজিবুর রহমান, সাবেক জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মো. আশরাফুল আফসারসহ ভূমি অফিসের কয়েকজন কর্মকর্তাকে আসামি করার সুপারিশ করা হয়।
এ ছাড়া দুদকের তালিকায় দুর্নীতির সহযোগী হিসেবে সাতজন রাজনৈতিক নেতার নাম রয়েছে, যাদের মধ্যে আছেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ধর্মবিষয়ক সম্পাদক ও কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সিরাজুল মোস্তফা, কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও কক্সবাজার পৌরসভার মেয়র মুজিবুর রহমান এবং তাঁর ছেলে হাসান মেহেদি রহমান, কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মাসেদুল হক (রাশেদ), মহেশখালী উপজেলার কালামারছড়া ইউপি চেয়ারম্যান তারেক বিন ওসমান (শরীফ) এবং কক্সবাজার যুবদলের সভাপতি শরীফুল ইসলাম।
এ ছাড়া প্রতিবেদনে কক্সবাজারের পাঁচজন সাংবাদিক, আটজন আইনজীবী, দুজন ব্যাংকারের নাম উঠে আসে, যারা কোনো না কোনোভাবে ওই দুর্নীতি ও দালাল চক্রের অংশ হিসেবে কাজ করেছেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়, তাঁরা সবাই সরকারি অর্থ প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের না দিয়ে আত্মসাৎ করতে ভূমিকা রেখেছেন।
গুম হওয়ার আশঙ্কা
শরীফ উদ্দিন এক ভিডিও বার্তায় গুমের আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। ভিডিওতে শরীফ বলেন, যেখানে প্রভাবশালী পলিটিশিয়ানরা, পাবলিক সার্ভেন্টরা এবং জনপ্রতিনিধিরা কিভাবে রোহিঙ্গাদের কিছু টাকার বিনিময়ে সার্টিফিকেট দিচ্ছে, নাগরিকত্ব করার বিপরীতে। এবং দুঃখজনকভাবে সত্য সেই রোহিঙ্গাদের সংখ্যাটা অপ্রত্যাশিতভাবে আমি ধারণা করেছিলাম এক লাখ।
কিন্তু তার সংখ্যা আরও বেশি। তো ইতোমধ্যে আমার কাছে মামলা এসেছে। এবং আরেকটি বিষয় এখানে স্পষ্ট, ওই চক্রটা তাদের মিডলইস্ট কেন্দ্রীক একটা বড় চক্র আছে, তারা আবার ফান্ডিং করতো।
এই জিনিসগুলো আমি আমার কমিশন বরাবর লিখেছি, ডকুমেন্টও দিয়েছি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের অপপ্রচারগুলো আমি ডকুমেন্টেড কমিশনকে দাখিল করেছি।
তিনি বলেন, চট্টগ্রামের স্বাস্থ্যখাত নিয়ে আমি কাজ করেছি। স্বাস্থ্য খাতে সরকারি-বেসরকারিতে কীভাবে মানুষদেরকে এবং ডাক্তারদেরকে জিম্মি করে, একটি চক্র, সিন্ডিকেট করে, বছরের পর বছর টেন্ডারবাজি এবং চাঁদাবাজি করে আসছে।
এবং সেটার জন্য আমি পাঁচটা মামলার সুপারিশও করেছি। এবং আরেকটি বিষয় আমি চট্টগ্রামে রেলওয়ে খালাশির নিয়োগ থেকে বেশ কিছু স্পষ্ট নথির তদন্ত আমি করেছিলাম। এবং ঊর্ধ্ব মহল এগুলো জানত। এমনকি তারা বাহবাও দিত এবং এগুলোর আমার নামের নিউজ ছিল।’
‘তো সর্বশেষ ৩০ জানুয়ারি ২০২২ আমার বাসায় এসে পেট্রোবাংলার ডাইরেক্টর প্ল্যানিং। উনি তার এক সহকর্মীকে নিয়ে এসে যেভাবে হুমকি দিয়েছিল যে, আমার এক সপ্তাহের মধ্যে চাকরি খেয়ে ফেলবে। এবং এই যাদের নাম আমি বলছি, তাদের কথা সেখানে উচ্চারণ করেছে। এবং দুঃখজনক সত্য ১৬ দিনের মাথায়, কোনো রকম কারণ দর্শানো নোটিশ ছাড়াই আমার বিরুদ্ধে কর্তৃপক্ষ অপসারণ নোটিশ জারি করেছে।’
শরীফ বলেন, ‘আমি মজলুম, আমি সাংবিধানিকভাবে বঞ্চিত, আমি চাকরি থাকাকালীন আমি হুমকির সম্মুখীন হয়েছি। এবং তার আইনানুগ কার্যক্রমও গ্রহণ করেছি। এখন আমি চাকরিতে বহাল নাই। এখন আমি আমার পরিবার নিয়া চরম নিরাপত্তাহীনতা অনুভব করতেছি।’
‘আমি মাননীয় কমিশন এবং সর্বশেষ আমার রাষ্ট্রের কাছে দাবি জানাচ্ছি, আমার জিনিসটা পুনর্বিবেচনা করে, আমার সরল বিশ্বাসে কৃতকর্ম যদি কোনো ভুলভ্রান্তি হয়ে থাকে আমাকে আমার দেশপ্রেমের স্বাক্ষর রাখার জন্য আমি আকূল আবেদন জানাচ্ছি।’
‘সর্বশেষ আমি একটি কথা বলতে চাচ্ছি, এই এতগুলো স্পর্শকাতর ও চাঞ্চল্যকর বিভিন্ন অনুসন্ধান করার কারণে যে প্রভাবশালীরা আমার বাসায় এসে, বিভিন্ন মাধ্যমে আমাকে হুমকি দিয়ে আসছে এবং গতকালকের ঘটনায় আমাকে অপসারণ করা হয়েছে। আমি আমার পরিবার নিয়ে শঙ্কিত এবং আমি গুমের আশঙ্কা করছি। আমি আমার পরিবারের নিরাপত্তা দাবি করছি।’
মাননীয় কমিশন এবং রাষ্ট্রের কাছে আকূল আবেদন আমার এই জিনিসটা আমলে নিয়ে, আমাকে দেশের স্বার্থে, রাষ্ট্রের স্বার্থে আমাকে কাজ করার সুযোগ দেন। আমি ভুলত্রুটি শুধরে নেব।
এসডব্লিউ/এসএস/১৪৫০
আপনার মতামত জানানঃ