গাছের প্রাণ আছে আমরা জানি। কিন্তু তাই বলে গাছের গায়ে রক্ত? ডালে আঘাত পড়লেই ঝরঝর করে ফেটে বেরোচ্ছে রক্তের ধারা। এও কি সম্ভব? অবিশ্বাস্য শোনালেও, এই পৃথিবীর বুকে আছে এমনই এক আশ্চর্য গাছ, যে নিজের শরীরে ধরে রেখেছে টকটকে লাল গাঢ় এক তরল। সে রক্তও আবার যেমন তেমন রক্ত নয়, প্রাগৈতিহাসিক এক হিংস্র ড্রাগনের শরীরের রক্ত।
ইয়েমেনের সুকাত্রা দ্বীপ আর আফ্রিকার অল্প কিছু এলাকায় জন্মায় এক বিচিত্রদর্শন গাছ। দেখতে অনেকটা সবুজ রঙের খোলা ছাতার মতো। একটাই লম্বা কাণ্ড, সেটা ওপরের দিকে বাড়তে বাড়তে অসংখ্য ডালপালায় ভাগ হয়ে যায়। সুকাত্রা দ্বীপের শুকনো মাটিতে জন্মানো এ গাছটি প্রায় ৩২ ফুট লম্বা হয়। শুকনো বাতাস থেকে জলীয় বাষ্প সংগ্রহ করার জন্যই না কি এমন ছাতার মতো চেহারা হয় গাছগুলোর।
আজ থেকে প্রায় সাড়ে তিন কোটি বছর আগে মূল আরব ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় সুকাত্রা দ্বীপপুঞ্জ। প্রকৃতির খেয়ালে তাই এখানে সভ্যতার বিবর্তনের ছাপ পড়েনি সেভাবে। সময় যেন থমকে আছে এই দ্বীপে। সভ্য মানুষ এই দ্বীপের নাম দিয়েছে ‘এলিয়েন আইল্যান্ড’ বা ভিনগ্রহীদের দ্বীপ।
প্রাগৈতিহাসিক এই আইল্যান্ডে এখনও টিকে রয়েছে একেবারে অন্যরকম প্রজাতির হরেক প্রাচীন গাছপালা, যা পৃথিবীর আর কোথাও দেখা যায় না। সেইসব অদ্ভুতুড়ে গাছের অন্যতম এই ড্রাগন ব্লাড ট্রি।
বিজ্ঞানীরা বলেন, এই ড্রাগন ব্লাড ট্রি পৃথিবীর আদিমতম গাছগুলোর একটা। প্রাণ সৃষ্টির পর থেকে আজ পর্যন্ত নানা প্রাকৃতিক ও মহাজাগতিক পরিবর্তনের সাক্ষী থেকেছে এই গ্রহ। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বদলে গেছে উদ্ভিদ ও প্রাণীদের জীবন।
ডাইনোসরের মতো প্রজাতি একেবারে বিলুপ্ত হয়ে গেছে৷ কেউ কেউ পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে বদলে নিয়েছে নিজেদের শারীরিক গঠন। কিন্তু এই ড্রাগন ব্লাড ট্রি না কি যুগ যুগ ধরে অপরিবর্তিত রেখেছে নিজেদের।
এ গাছে কোনো বর্ষবলয় তৈরি হয় না। গাছের কাণ্ডের সংখ্যা দেখে এর বয়স নির্ধারণ করা হয়। গাছটি বছরে মাত্র একবারই মার্চ মাস নাগাদ ফুল দেয়। ফলও হয়, প্রায় আমাদের কুলের মতো দেখতে ছোট্ট ছোট্ট ফল। কাঁচায় সবুজ আর পাকলে কালো রঙের এই ফলগুলো বেশ মজা করেই খায় দ্বীপের পশুপাখিরা।
আপাত স্বাভাবিক এই গাছগুলো সত্যিই কি বংশ পরম্পরায় নিজেদের শরীরের ভেতরে বয়ে চলেছে ভয়ংকর এক হাজার মাথা ড্রাগনের অস্তিত্ব? এর উত্তরে বোটানিস্টরা বলছেন, রক্তের মতো দেখতে এই ঘন লাল আঠালো তরল আসলে রেজিন। এক ধরনের উপক্ষার। এই রেজিনের ঔষধিগুণ প্রবল। প্রাচীনকাল থেকেই গ্রিস, রোম, আরবের ডাক্তারেরা জ্বর, আলসার আমাশা ও পেটের নানা রোগের ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করত গাছের এই ‘ড্রাগন-ব্লাড’।
১৮ শতকের দিকে এই আঠা ভায়োলিন বার্নিশের কাজেও ব্যবহার হতো। তা ছাড়া রঞ্জক হিসাবে, টুথপেস্ট তৈরি করতেও কাজে লাগানো হতো এই রক্তরং রেজিন। সেই প্রাচীনকাল থেকে এখনও বহু মানুষ বিশ্বাস করেন এই আশ্চর্য গাছের ধমনিতে বইছে শতমুণ্ড ড্রাগনের রক্ত।
আর তাই প্রেম, নির্বাসন এবং যৌনতার জন্য মন্ত্রের শক্তি বাড়াতে সেই প্রাচীনকাল থেকেই জাদুটোনা, তুকতাক আর অ্যাডলকেমির কাজেও ব্যবহৃত হয়ে আসছে এই উপক্ষার।
এসডব্লিউ/এসএস/১৮৩৫
আপনার মতামত জানানঃ