দুই দেশের যৌথ সীমানা বরাবর নেপালের দিকে অগ্রসর হচ্ছে চীন। এমনকি নেপালের জমি দখলের অভিযোগও আনা হয়েছে চীনের বিরুদ্ধে। ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসি’র কাছে ফাঁস হওয়া নেপাল সরকারের এক প্রতিবেদনে এমনটাই দাবি করা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, নেপাল চীনের সাথে বাণিজ্য ও যোগাযোগ বৃদ্ধি করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে এবং একইসঙ্গে ভারতে তার নির্ভরতা হ্রাস করার চেষ্টা করছে। তবে নেপালে এই চেষ্টার পরিণতি বা ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত সংশ্লিষ্টরা। যদিও নেপাল ও চীনের উভয় সরকারই ৫ই অক্টোবর, ১৯৬১ তারিখে সীমান্ত চুক্তির চুক্তি অনুমোদন করে।
১৯৭৫ সাল থেকে নেপালে চীন ও নেপালের দক্ষিণাঞ্চলীয় প্রতিবেশী ভারতের প্রতিদ্বন্দ্বী সাম্রাজ্যকে ভারসাম্য বজায় রাখার নীতি অব্যাহত রেখেছে। ১৯৭৫ সালে ভারতের দ্বারা সিকিম রাজ্যের অধিগ্রহণের পর হিমালয়ের একমাত্র দুই প্রতিবেশী ভারত। সেই ১৯৭৫ সাল থেকেই মূলত চীন-নেপাল সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছে।
তবে এই প্রথমবারের মতো নেপাল সরকারের পক্ষ থেকে দেশটির ভূখণ্ডে চীনা হস্তক্ষেপের আনুষ্ঠানিক অভিযোগ করা হল। নেপালের পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলা হুমলায় চীন অনুপ্রবেশ করছে, এমন দাবির পর গত সেপ্টেম্বরে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়।
তবে, কাঠমান্ডুতে চীনের দূতাবাস নেপালের এমন অভিযোগকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছে। অন্যদিকে, কেনো প্রতিবেদনটি এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয়নি তা স্পষ্ট নয়।
নেপাল সরকার ভারতের সঙ্গে দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্কের ভারসাম্য বজায় রাখতে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীনের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নয়ন করেছে। কিন্তু নেপাল সরকারের ওই প্রতিবেদন চীনের সঙ্গে দেশটির সুসম্পর্কের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে বলে ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
এদিকে, প্রতিবেদনটির ব্যাপারে নেপাল সরকার এখনও বিবিসি’র প্রশ্নের জবাবও দেয়নি বলেও জানা গেছে।
হিমালয় পর্বতমালা বরাবর ১ হাজার ৪০০ কিলোমিটার (৮৭০ মাইল) সীমান্ত রয়েছে নেপাল ও চীনের মধ্যে। ১৯৬০-এর দশকের গোড়ার দিকে দুই দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তির মাধ্যমে এই সীমান্ত নির্ধারণ করা হয়েছিল।
দুই দেশের মধ্যকার এই সীমান্তের বেশিরভাগই প্রত্যন্ত ও দুর্গম এলাকায়। স্থল সীমানায় কয়েকটি পিলারের মাধ্যমে দুই দেশকে আলাদা করা করা হয়েছে। তবে সেখানে পৌঁছানো বেশ কষ্টসাধ্য। এমনকি সীমান্ত রেখাটি ঠিক কোন জায়গায় তা নির্ধারণ করাও অনেক সময় কঠিন হয়ে পড়ে।
তবে সম্ভাব্য চীনা দখলের আভাসে নেপাল সরকার সম্প্রতি হুমলায় একটি টাস্কফোর্স পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়।
অনেকেই দাবি করছেন, সীমান্তের নেপালি অংশে চীন কয়েকটি ভবন নির্মাণ করেছে। এমন দাবি যারা করেছেন তাদের দলে নেপালের পুলিশ সদস্য ও সরকারের প্রতিনিধিরাও রয়েছেন।
বিবিসিকে দেওয়া তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সীমান্তবর্তী লালুংজং নামক জায়গার নেপালি অংশে ধর্মীয় কার্যকলাপকে সীমাবদ্ধ করেছে চীনা নিরাপত্তা বাহিনীর নজরদারি কার্যক্রম।
প্রসঙ্গত, চীন সীমান্তের কাছাকাছি কৈলাস পর্বত ঐতিহ্যগতভাবে তীর্থযাত্রীদের (হিন্দু ও বৌদ্ধ) কাছে পবিত্র জায়গা। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, নেপালের কৃষকদের কৃষি জমিও দখল করে নিচ্ছে চীন।
একই এলাকায় সীমান্তের কোল ঘেঁষে চীন বেড়া নির্মাণ করেছে এবং সীমান্তের নেপালি অংশে একটি খাল ও একটি রাস্তা নির্মাণেরও চেষ্টা করছে।
কিন্তু নেপাল সরকারের টাস্কফোর্স জানিয়েছে, চীনা ভবনগুলো নেপালের ভিতরে নির্মিত বলে মনে হলেও আসলে সেগুলো সীমান্তের কোল ঘেঁষে চীনের অংশেই নির্মিত হয়েছে।
তদন্তকারীরা আরও জানিয়েছেন, স্থানীয় নেপালিরা সীমান্ত সমস্যা নিয়ে কথা বলতে অনিচ্ছা দেখিয়েছে। কারণ তারা অনেকেই সীমান্তবর্তী চীনের বাজারে ব্যবসা করেন।
এ ব্যাপারে কথা বললে ওই বাজারে তাদের প্রবেশাধিকার বন্ধ হয়ে যেতে পারে, এই ভয়ে অনেকেই চুপ থেকেছেন বলে মনে করছেন তারা।
নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নেপালের নিরাপত্তা বাহিনীকে ওই এলাকায় মোতায়েনের সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। পাশাপাশি দুই দেশের মধ্যে এ ধরনের সীমান্ত সমস্যা সমাধানে সুপ্ত ব্যবস্থাটিকে পুনরায় সক্রিয় করারও পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
চীন যেহেতু দখলের অভিযোগ অস্বীকার করছে, তাই নেপালের সঙ্গে সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ জোরদার করার পেছনে দেশটির উদ্দেশ্য কী হতে পারে তা এখনও পুরোপুরি স্পষ্ট নয়। তবে অনেকেই মনে করেছেন, এক্ষেত্রে নিরাপত্তা একটি কারণ হতে পারে।
ঐতিহাসিকভাবে ওই অঞ্চলে তীর্থযাত্রী এবং ব্যবসায়ীসহ অনানুষ্ঠানিক আন্তঃসীমান্ত যাতায়াত ছিল, কিন্তু চীন ধীরে ধীরে এই চলাচলকে সীমিত করছে।
সাবেক নেপালি কূটনীতিক বিজয় কান্ত কর্ণ মনে করেন, সীমান্তবর্তী ভারতকে নিয়ে চিন্তিত বেইজিং। আর এ কারণেই চারপাশ থেকে সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে তারা।
তিনি বলেন, “মনে হচ্ছে তারা (চীন) বাইরের বাহিনীর অনুপ্রবেশ নিয়ে উদ্বিগ্ন, তাই তারা সীমানাকে কেন্দ্র করে সব ধরনের সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করতে চায়।”
এছাড়া তিব্বতকে নিয়েও চীন বেশ চিন্তিত বলে মনে করছেন অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক। বেইজিংয়ের দমন-পীড়ন থেকে বাঁচতে হাজার হাজার মানুষ তিব্বত ছেড়ে পালিয়েছে।
সেখান পালিয়ে যাওয়া প্রায় ২০ হাজার উদ্বাস্তু এখন নেপালে বসবাস করছেন। আরও অনেকেই পালিয়েছেন ভারতে ও এর আশেপাশের দেশগুলোতে। সম্প্রতি চীন এই পালানোর পথটি বন্ধ করার চেষ্টা করছে বলে অভিমত দিয়েছেন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা।
গত দুই বছর ধরে সীমান্তে নেপালি অংশে চীনা দখলের খবর আসছে গণ্যমাধ্যমে। আর এরই পরিপ্রেক্ষিতে নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুতে মাঝেমধ্যেই বিক্ষোভ হতে দেখা গেছে। এমনকি গত মাসেও এই ইস্যুতে বিক্ষোভ হয়েছে দেশটিতে।
এর প্রতিক্রিয়ায় নেপালস্থ চীনা দূতাবাস চলতি বছরের জানুয়ারিতে দেওয়া এক বিবৃতিতে বলেছে, “এখানে বিতর্কের কোনো কারণ নেই। আমরা আশা করছি, নেপালের জনগণকে মিথ্যা প্রতিবেদন দিয়ে বিভ্রান্ত করা হবে না।”
দূতাবাস অবশ্য অপ্রকাশিত প্রতিবেদনে উল্লেখিত সুনির্দিষ্ট অভিযোগের বিষয়ে তেমন প্রতিক্রিয়া জানায়নি। ধারণা করা হচ্ছে, নেপাল সরকার বেইজিংয়ের সঙ্গে সীমান্ত ইস্যুটি নিয়ে ইতোমধ্যে আলাপ করেছে; তবে প্রতিক্রিয়ায় চীন কী বলেছে তা জানা যায়নি।
তবে চীন নেপালের সীমান্ত নিয়ে সমস্যা বেশ পুরনো। গত বছরও চীন তার প্রতিবেশী দেশ নেপালের সীমানায় উত্তাপ ছড়িয়েছে। ওই সময় হিমালয় জাতির দৌলখা জেলায় সীমান্ত স্তম্ভগুলি অদৃশ্য হয়ে যায়।
এটি চীনের আন্তর্জাতিক সীমান্তের প্রতি সম্পূর্ণ অবহেলার আরেকটি উদাহরণ বলে মনে করা হয়েছিল। তখন লাল পতাকা উত্তোলন করে নেপালের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই ঘটনার কথা দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানায়।
ইইউ রিপোর্টারের মতে, চীন-নেপাল সীমান্ত ঐতিহাসিকভাবে একটি নিয়ন্ত্রিত সীমান্ত ব্যবস্থা, যা ১৯৬০ সালে দুই দেশের মধ্যে পারস্পরিক চুক্তির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত। যার ফলে পরবর্তীতে ১৯৬১ সালের সীমান্ত চুক্তি গঠন করা হয়, সীমানা নির্ধারণের স্তম্ভ নির্মাণ করা হয়।
১৯৬১ সালের চুক্তির পর নেপাল ও চীনের মধ্যে সীমানা রেখায় প্রধানত ৭৬টি স্থায়ী সীমান্ত স্তম্ভের উত্থানসহ বেশ কয়েকটি পরিবর্তন দেখা গেছে। চীন এখন তার পক্ষে স্থিতাবস্থা পরিবর্তন করার চেষ্টা করছে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৮২০
আপনার মতামত জানানঃ