পশ্চিম ইউরোপের দেশ নেদারল্যান্ডসে প্রাণঘাতী ভাইরাস এইচআইভির অতি বিধ্বংসী একটি ধরনের সন্ধান পাওয়া গেছে। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে দেশটিতে ভাইরাসটির এই অতি সংক্রামক ও ভয়ঙ্কর ধরন ছড়াচ্ছে বলে শুক্রবার এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক বিজ্ঞান সাময়িকী নেচার।
বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাসের নতুন নতুন ধরন যখন ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলছে, তখন এইইচআইভির নতুন ধরনও এক শঙ্কার জন্ম দিয়েছে। তবে গবেষকদের দাবি, আধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থার কারণে এই ধরনে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই।
প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে ‘ভিবি ভ্যারিয়েন্ট’ নামে পরিচিত এই রূপান্তরিত ধরনটির আগমন ঘটেছে গত শতকের আশির দশকের শেষ থেকে নব্বইয়ের দশকের শুরু পর্যন্ত মধ্যবর্তী কোনো সময়ে; অর্থাৎ গত কয়েক দশক ধরে নেদারল্যান্ডসে টিকে আছে ভিবি ভ্যারিয়েন্ট।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, মূল ভাইরাস এইচআইভি ও তার অন্যান্য রূপান্তরিত ধরনগুলোর চেয়ে ভিবি ভ্যারিয়েন্টের বংশবিস্তারের হার ৩ দশমিক ৫ থেকে ৫ দশমিক ৫ গুণ পর্যন্ত বেশি হয়। পাশাপাশি, মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকেও অপেক্ষাকৃত দ্রুত ধ্বংস করতে সক্ষম এই ভাইরাসটি।
এএফপির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নেদারল্যান্ডসের ৬ হাজার ৭০০ এইডস রোগীর তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, তাদের মধ্যে ১০৯ জন আক্রান্ত ভিবি ভ্যারিয়েন্টে।
তবে নতুন এই ধরনটি অতি মারাত্মক বা বিধ্বংসী হলেও বর্তমানে এইডস রোগের চিকিৎসা যে পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে, তাতে ভিবি ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা সম্ভব বলে গবেষণা প্রতিবেদনে জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা।
এই বিজ্ঞানীদলের অন্যতম সদস্য ক্রিস উইমান্ট এএফপিকে এই সম্পর্কে বলেন, ‘আজ থেকে দেড়-দু’ দশক আগে এইডস রোগের যে চিকিৎসা ছিল— সেই পরিস্থিতি বিবেচনায় তখন এটি অনেক বেশি বিধ্বংসী একটি ভাইরাস ছিল।’
‘কিন্তু প্রতিবছরই এইডসের চিকিৎসা উন্নততর হয়েছে। এখনকার সময়ে এইডস চিকিৎসার যে বৈশ্বিক মান তাতে এই ধরনটিতে আক্রান্ত কেউ যদি দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন— তাহলে শঙ্কা অনেক কমে যাবে; অর্থাৎ বর্তমান চিকিৎসা ব্যবস্থায় এই ভাইরাসটি আর মানুষের জন্য বাড়তি হুমকি নয়।’
নেদারল্যান্ডসের ৬ হাজার ৭০০ এইডস রোগীর তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, তাদের মধ্যে ১০৯ জন আক্রান্ত ভিবি ভ্যারিয়েন্টে।
ক্রিস উইমান্ট আরও বলেন, খুবই দ্রুত ও ঘন ঘন অভিযোজন বা রূপান্তরের মধ্যে দিয়ে যাওয়া ভাইরাসগুলোর মধ্যে একটি হলো এইচআইভি। বিশ্বজুড়ে এই ভাইরাসটির অসংখ্য রূপান্তরিত ধরন শনাক্ত হয়েছে। ভিবি ভ্যারিয়েন্ট সেগুলোর মধ্যে একটি।
এমনকি উদ্ভবের পর থেকে বহুবার অভিযোজনের মধ্য দিয়ে গেছে ভিবি ভ্যারিয়েন্টও। এ পর্যন্ত ৫০০ বার এই ধরনটির রূপান্তর হয়েছে বলে এএফপিকে জানিয়েছেন ক্রিস।
অ্যাকোয়ার্ড ইমিউনো ডেফিসিয়েন্সি সিনড্রোম (এইডস) আসলে একই সঙ্গে রোগ এবং রোগলক্ষণসমষ্টি। হিউম্যান ইমিউনো ভাইরাসের (এইচআইভি) সংক্রমণই এইডসের জন্য দায়ী।
এই ভাইরাসটি মানবদেহে প্রবেশের পার মানুষের স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ও প্রতিরক্ষাকে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। ফলে, একজন এইডস রোগী খুব সহজেই যে কোনো সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হতে পারেন, যা শেষ পর্যন্ত তার মৃত্যু ঘটাতে পারে।
গবেষকরা বলছেন, এইচআইভি ভাইরাসের রূপান্তরের পর এই রূপটি শরীরে প্রবেশ করে ভাইরাল কণা হিসেবে নিজের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে থাকে। সিডিফোরটি কোষ নামক রোগ প্রতিরোধক কোষের সংখ্যাও কমিয়ে দেয়। তাই সংক্রমিত ব্যক্তিদের উচ্চহারে ও দ্রুত এইডস হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
ইউরোপের দেশ বিশেষ করে নেদারল্যান্ডে ছড়িয়ে পড়া ভাইরাসটির নতুন এই ধরন নিয়ে এরই মধ্যে সতর্কতা জারি হয়েছে।
ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটি অফ সান দিয়েগোর জীববিজ্ঞানী এবং মহামারি বিশেষজ্ঞ জোয়েল ওয়ারথেইম বলেছেন, নতুন রূপটি বিশ্বে থাকা এইচআইভি ওষুধে কাজ করে না। তাই এটি নিয়ে এখন নতুন করে ফের গবেষণা করছে। এইচআইভি সবচেয়ে দ্রুত পরিবর্তনকারী ভাইরাসগুলোর মধ্যে একটি।
গবেষণায় দেখা গেছে, সংক্রমিত ব্যক্তিদের রক্তে ৫ দশমিক ৫ গুণ বেশি ভাইরাস ছিল এবং তাদের দেহে সিডিফোরটি কোষগুলি প্রায় দ্বিগুণ দ্রুততার সঙ্গে হ্রাস পেয়েছে। এইচআইভির শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
জিনোম সিকোয়েন্স ব্যবহার করে গবেষকরা ভাইরাসটি কত দ্রুত ছড়িয়েছে তা নির্ধারণ করছেন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গ্লোবাল এইচআইভি, হেপাটাইটিস এবং সেক্সুয়ালি ট্রান্সমিটেড ইনফেকশন প্রোগ্রামের মেগ ডোহার্টি বলেছেন, আমরা এই নতুন রূপটি নিয়ে খুব বেশি চিন্তিত নই। তবে নজরদারির প্রয়োজনীয়তার ওপরও জোর দিয়েছেন তিনি।
ডারবানভিত্তিক সেন্টার ফর দ্য এইডস প্রোগ্রাম অফ রিসার্চ ইন সাউথ আফ্রিকার ডিরেক্টর সেলিম আব্দুল করিম বলেছেন, সংক্রমিত ব্যক্তিদের দ্রুত শনাক্ত করা এবং তাড়াতাড়ি চিকিৎসা শুরু করা গুরুত্বপূর্ণ।
গত শতকের ১৯৮১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম এইডসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়। ওই বছরই দেশটির রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল (সিডিসি) এই রোগের জন্য দায়ী ভাইরাস এইচআইভিও শনাক্ত করে।
অনিরাপদ যৌনতা, সিরিঞ্জের সূঁচের মাধ্যমে মানবদেহে প্রবেশ করে এইচআইভি ভাইরাস। এছাড়া, মায়ের মাধ্যমেও এইডসে আক্রান্ত হয় শিশুরা। কোনো গর্ভবতী নারীর দেহে এইডসের জীবাণু থাকলে তা অনাগত সন্তানকেও সংক্রমিত করে।
সাহারা ও নিম্ন আফ্রিকার অঞ্চলগুলোতে এইডসের প্রকোপ সবচেয়ে বেশি। প্রতি বছর বিশ্বজুড়ে লাখ লাখ মানুষ মারা যান এইডসে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেব অনুযায়ী, ২০১৮ সালে বিশ্বে এইডসে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছিলেন ১০ লাখ মানুষ।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩১৩
আপনার মতামত জানানঃ