জালিয়াতি মামলায় বরিশালের বাকেরগঞ্জের দাড়িয়াল ইউনিয়র পরিষদের চেয়ারম্যান শহিদুল ইসলামকে জেলহাজতে পাঠানোর সংবাদ ও ছবি সংগ্রহ করতে গেলে সাংবাদিকদের ওপর হামলা করেছেন চেয়ারম্যানের স্বজন ও আইনজীবী সহকারীরা। এতে অন্তত ২৫ সাংবাদিক আহত হয়েছেন। আহতদের মধ্যে ২১ জনকে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
বুধবার (২ ফেব্রুয়ারি) বিকেলে বরিশাল আদালত প্রাঙ্গণ ও এর সামনের সড়কে হামলার এই ঘটনা ঘটে। কারাগারে যাওয়া ওই চেয়ারম্যানের নাম শহিদুল ইসলাম। তিনি বরিশালের বাকেরগঞ্জের দাড়িয়াল ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান।
হামলায় আহতরা হলেন— আঞ্চলিক দৈনিক আমাদের বরিশালের ফটো সাংবাদিক মো. নাঈম, আহসান আকিব; দৈনিক মতবাদ পত্রিকার এন আমিন রাসেল; দৈনিক বাংলার বনে পত্রিকার শাফিন আহমেদ রাতুল, জিয়াদ, জুয়েল; দৈনিক আজকের বরিশাল পত্রিকার সাইফুল ইসলাম, সুজন হাওলাদার, আবু কালাম আজাদ (সোহাগ), সাজ্জাদ হোসেন হৃদয়; বাংলাভিশন চ্যানেলের কামাল হোসেন; মোহনা টেলিভিশনের অপূর্ব বাড়ৈ; যমুনা টিভির শুভ হাওলাদার; মাই টিভির শফিক হোসেন, লিটন মোল্লা; দৈনিক প্রথম সকাল পত্রিকার বার্তা সম্পাদক সুমাইয়া জিসান ও দৈনিক সুন্দরবন পত্রিকার বার্তা সম্পাদক মিজান পলাশ।
আহতরা জানান, দাড়িয়াল ইউপি চেয়ারম্যান ও তার চার ভাই-বোনকে জালিয়াতির মামলায় কারাগারে পাঠানোর সংবাদের প্রয়োজনে ছবি তুলতে আদালত প্রাঙ্গণে যান ফটো সাংবাদিকরা। এরপর চেয়ারম্যানের ভাইয়ের ছেলে সুজন হাওলাদার, সাইফুল ও আইনজীবী সহকারী কামরুজ্জামান, বাপ্পিসহ বেশ কয়েকজন সাংবাদিকদের ‘ম্যানেজ’ করার চেষ্টা করেন। ম্যানেজ করতে না পেরে ইউপি চেয়ারম্যানের ছবি ধারণের সময় ফটো সাংবাদিকদের ওপর হামলা চালানো হয়।
প্রথম দফার হামলায় বেশ কয়েকজন ফটো সাংবাদিক আহত হন। পরে প্রতিবাদ করতে গেলে ফটো সাংবাদিকদের ওপর ফের হামলা চালানো হয়। একপর্যায়ে আদালতের সামনে রাস্তায় ফেলে পেটানো হয় সাংবাদিকদের। ভাঙচুর করা হয় সাংবাদিকদের ছয়-সাতটি মোটরসাইকেল।
বাংলার বনে পত্রিকার সাংবাদিক শাফিন আহম্মেদ রাতুল জানান, বুধবার জালিয়াতি মামলায় দাড়িয়ালের ইউপি চেয়ারম্যান শহিদুল ইসলাম হাওলাদারসহ ৫ জনকে জেলহাজতে পাঠায় আদালত।
আদালত থেকে তাদের হাজতে নেয়ার সময় ছবি তুলতে গেলে চেয়ারম্যানের ভাইয়ের ছেলে সুজন হাওলাদার এবং আইনজীবী সহকারী নুরুজ্জামান ও সজলসহ কয়েকজন তাদের ছবি তুলতে বাধা দেন।
বাধা উপেক্ষা করে ছবি তুলতে গেলে ফটো সাংবাদিকদের ওপর তাদের হামলায় ২৫ জন আহত হন। বর্তমানে হাসপাতালে ভর্তি আছেন ২১ জন।
প্রথম দফার হামলায় বেশ কয়েকজন ফটো সাংবাদিক আহত হন। পরে প্রতিবাদ করতে গেলে ফটো সাংবাদিকদের ওপর ফের হামলা চালানো হয়। একপর্যায়ে আদালতের সামনে রাস্তায় ফেলে পেটানো হয় সাংবাদিকদের। ভাঙচুর করা হয় সাংবাদিকদের ছয়-সাতটি মোটরসাইকেল।
বরিশাল কাগজের সাংবাদিক আহসান আকিব বলেন, ‘আমাকে রাস্তায় ফেলে পেটানো হয়েছে। সাড়া শরীর ব্যথায় নড়তে পারছি না।’
আজকের বরিশালের সাইফুল ইসলাম জানান, ১ লাখ টাকার বিনিময়ে চেয়ারম্যান শহিদুল, নুরুজ্জামান, সজলসহ বেশ কয়েকজনের সঙ্গে চুক্তিতে যান যেন কেউ তার ছবি তুলতে না পারে।
সুজন হাওলাদার প্রথমে টাকা দিয়ে সাংবাদিকদের ম্যানেজ করার চেষ্টা করেন। ব্যর্থ হয়ে তিন দফায় সাংবাদিকদের ওপর হামলা করেন তারা।
তিনি বলেন, ‘হামলায় আহত হয়ে আমরা হাসপাতালে কাতরাচ্ছি। আমাদের মোবাইল ও নগদ টাকা লুট করা হয়েছে। দুজনের মোটরসাইকেল ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে এবং ভাঙচুরও করা হয়েছে আরও ৭টি মোটরসাইকেল।’
এরপর অন্যান্য সাংবাদিকরা আদালত প্রাঙ্গণে গেলে তাদের ক্যামেরাও ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন আইনজীবী সহকারীরা। পরে বরিশাল চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট কবির উদ্দিন প্রামানিক ও বরিশাল জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলমে খোকন ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন।
বরিশাল আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট রফিকুল ইসলাম খোকন বলেন, খবর শুনে আমি ঘটনাস্থলে গিয়ে সবাইকে শান্ত থাকার জন্য বলেছি। বরিশাল চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিজ্ঞ বিচারক কবীর উদ্দিন প্রামাণিক নিজে ঘটনাস্থলে আসেন। আমরা সাংবাদিক নেতারা আইনজীবী সহকারীদের নিয়ে বসে ঘটনার সুষ্ঠু সমাধান করব।
বরিশাল রিপোর্টার্স ইউনিটির সভাপতি নজরুল বিশ্বাস বলেন, ‘আদালত প্রাঙ্গণে সাংবাদিকদের ওপর ন্যক্কারজনক হামলা চালিয়েছে কিছু মাদকসেবী আইনজীবী সহকারী। আমরা দেখেছি হামলায় নেতৃত্ব দেয়া কয়েকজনের বিরুদ্ধে মাদক ও নারী নির্যাতন মামলাও রয়েছে। নেশায় বুঁদ হয়ে এমন ঘটনা ঘটিয়েছে তারা।’
বরিশাল প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক এস এম জাকির হোসেন বলেন, ‘আহতদের বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে এসেছি। আপাতত আহতদের মধ্যে ২১ জনকে ভর্তি করেছি। আমাদের পরবর্তী সিদ্ধান্ত পরে জানাব।’
বরিশাল কোতোয়ালি মডেল থানার ওসি আজিমুল করিম বলেন, ‘ঘটনাস্থলে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়ন করা হয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।’
এর আগেও গত ১৫ জানুয়ারি একটি ধর্ষণ মামলার এক আসামির ছবি তুলতে গেলে ফটো সাংবাদিকদের হেনেস্তা করা হয় আদালত চত্বরে।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলেন, দেশের সংবিধানে বাকস্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে, বিশেষ করে সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে। পরবর্তী সময়ে ডিজিটাল অ্যাক্টসহ যেসব আইন হয়েছে, সেগুলো রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে যে বাকস্বাধীনতা ও গণতন্ত্র অর্জন করেছি, তার সঙ্গে সুস্পষ্টভাবে বিপরীতমুখী ও সাংঘর্ষিক। এগুলো স্বাধীন সাংবাদিকতার পথকে সংকুচিত করেছে।’
তারা বলেন, সারা বিশ্ব দেখছে, এই দেশটি সাংবাদিক নিপীড়নকারী দেশ এবং গণমাধ্যমের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন করে এমন একটি দেশ। সাংবাদিকদের স্বাধীনতা চাই, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা চাই। সাংবাদিকতার স্বাধীনতা রাষ্ট্রের জন্য, সরকারের জন্য এবং সুশাসনের জন্য দরকার।’
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, মফস্বলের প্রত্যেকটা সাংবাদিক পরিচিত। সবাই সবাইকে চেনে। ওখানে কোন সংবাদ হলে তাকে টার্গেট করা সহজ। ঢাকায় সেটা সম্ভব না। মফস্বলের সাংবাদিক প্রতি মুহুর্তে, প্রতিদিনই ঝুঁকির মধ্যে থাকে।মফস্বল সাংবাদিকদের কোনো ধরনেরই নিরাপত্তা নেই৷ আর্থিক বা শারীরিক কেনোটাই না৷ অধিকাংশ সাংবাদিক বেতন পান না আবার প্রশাসনিক, রাজনৈতিক ও দুর্বৃত্তদের চাপের মুখে থাকতে হয়। শীঘ্রই পরিস্থিতির কোন পরিবর্তন হবে—এমন আশাও করেছন না বিশেষজ্ঞরা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪০০
আপনার মতামত জানানঃ