করোনা মহামারির প্রকোপ কমে যাওয়ার পর বিশ্বে অসংক্রামক রোগের ঝুঁকি পড়তে যাচ্ছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে এখন খুব কমসংখ্যক মানুষই সংক্রামক রোগে মারা যায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মৃত্যুর কারণ অসংক্রামক ব্যাধি। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, ক্যান্সার, কিডনি জটিলতা ও দীর্ঘমেয়াদি শ্বাসতন্ত্রের রোগ।
দেশে ২০৪০ সালের মধ্যে অসংক্রামক রোগে মৃত্যুর হার অন্তত ১০ শতাংশ বাড়ার আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন গবেষকরা। এখন দেশের মোট মৃত্যুর অন্তত ৭০ শতাংশ অসংক্রামক রোগে হচ্ছে।
এখনই এসব রোগের বিরুদ্ধে সচেতনতা তৈরি ও ব্যবস্থা না নিলে ২০৪০ সালের মধ্যে অসংক্রামক রোগে মৃত্যুর হার বেড়ে ৮০ শতাংশে দাঁড়াবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
বৃহস্পতিবার প্রথম জাতীয় সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনের প্রথম পর্বে এমন তথ্য উঠে আসে।
ঢাকার একটি পাঁচ তারকা হোটেলে তিন দিনের এ সম্মেলন শুরু হয়েছে। সম্মেলন শেষ হবে ২৮ জানুয়ারি।
বাংলাদেশ হেলথ রিপোর্টার্স ফোরামসহ ৩০টি দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠান এ সম্মেলনের আয়োজন করেছে।
সম্মেলনের প্রথম পর্বে স্বাস্থ্য অর্থ ইউনিটের মহাপরিচালক মোহাম্মদ শাহাদাত হোসাইন মাহমুদ বলেন, ‘কোভিডে সারাবিশ্ব এই মুহূর্তে ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। আমাদের দেশে কোভিডে যে মৃত্য, অসংক্রামক কোনো কোনো রোগে মৃত্যু তার চেয়ে ১০ থেকে ২০ গুণেরও বেশি।
‘শুধু ধুমপানজনিত কারণে দেশে প্রতিদিন গড়ে মৃত্যু হচ্ছে সাড়ে তিন শ মানুষের। ক্যানসার, টিবি, হার্ট ডিজিজ সবই অসংক্রামক রোগ। সব রোগের কারণে যে মৃত্যুহার, প্রত্যেকটির মৃত্যুর হার কোভিডের মৃত্যুর থেকে ৫ গুণ। কিন্তু কেন যেন আমরা শুধু সংক্রামক রোগের প্রতি বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকি।’
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে দুই বছরে ২৮ হাজারের বেশি মানুষ মারা গেছে। তবে অসংক্রামক রোগে কত মানুষ মারা গেছে এই সময়ে তার কোনো হিসাব দেননি এ বিশেষজ্ঞ।
বিভিন্ন গবেষণা তথ্যের বরাতে শাহাদাত হোসাইন জানান, দেশে এখন ৮৪ লাখ মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। সবাইকে পরীক্ষা করলে সংখ্যা বাড়তে পারে। তাদের শুধু ইনসুলিনের জন্য বছরে খরচ করতে হচ্ছে ১৬ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। শুধু ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে অন্য বিভিন্ন অসংক্রামক রোগ থেকেও রক্ষা পাওয়া যায় বলে জানান তিনি।
সংক্রামক রোগ প্রতিরোধে সরকার সদিচ্ছার ঘাটতি নেই জানিয়ে তিনি বলেন, করোনার টিকার জন্য এবার সরকারকে ২০ হাজার কোটি টাকা খরচ করতে হয়েছে।
একটি গবেষণার বরাত দিয়ে এই গবেষক বলেন, ‘চিকিৎসার ক্ষেত্রে ৬৭ দশমিক ৫ ভাগ অর্থ জনগণের পকেট থেকে ব্যয় করে। এটি নিঃসন্দেহে অনেক বেশি।’
দেশে ২০৪০ সালের মধ্যে অসংক্রামক রোগে মৃত্যুর হার অন্তত ১০ শতাংশ বাড়ার আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন গবেষকরা। এখন দেশের মোট মৃত্যুর অন্তত ৭০ শতাংশ অসংক্রামক রোগে হচ্ছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জরিপে দেখা গেছে, স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে করোনার বছরে (২০২০) দেশে হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যু সাড়ে ২২ ভাগ বেড়েছে। ব্রেইন ক্যান্সারে মৃত্যু বেড়েছে ৪৮ ভাগ, ব্রেইন স্ট্রোকে মৃত্যু বেড়েছে প্রায় ৮৮ শতাংশ। কিডনি রোগে মৃত্যুহার দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে আত্মহত্যাও।
বিবিএস জরিপে দেখা যায়, করোনাকালে হৃদরোগ, মস্তিস্কে রক্তক্ষরণ, ক্যান্সার, শ্বাসতন্ত্র ও কিডনিসহ অসংক্রামক রোগে মানুষের মৃত্যু বেড়েছে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, দেশে ২০১৯ সালে হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যুবরণ করেছিল ১ লাখ ৪৭ হাজার ২৫৯ জন। ২০২০ সালে এই সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ৮০ হাজার ৪০৮ জন। ব্রেইন স্ট্রোকে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ৪৫ হাজার ৫০২ জন, ২০২০ সালে এটি বেড়ে হয়েছে ৮৫ হাজার ৩৬০ জনের। ব্লাড ক্যান্সারে মৃত্যুর সংখ্যা ১৮ হাজার ৬২০ থেকে এক বছরের ব্যবধানে বেড়ে হয়েছে ২১ হাজার ৪৭১ জনে।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপে যে প্রাক্কলন তুলে ধরা হয় তাতে দেখা যায়, অসংক্রামক রোগে বেশি মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। এ তালিকায় রয়েছে হৃদরোগ, ক্যান্সার, কিডনি রোগ, ডায়বেটিস, শ্বাসতন্ত্রের রোগসহ আরও কিছু রোগ। চিকিৎসকরা বলছেন, প্রক্রিয়াজাত খাবার বেশি খাওয়া এবং কায়িক পরিশ্রম কম করায় হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ছে।
ডিসেম্বর ২০২০ পর্যন্ত এক বছরে করোনায় মারা গেছেন ৮ হাজার ২৪৮ জন। আত্মহত্যায় মারা গেছে ১১ হাজার ২৫৯ জন। সে হিসেবে করোনার চেয়ে হার্ট অ্যাটাক বা ক্যান্সারে মৃত্যু অনেক বেশি লক্ষ্য করা গেছে। কিডনি রোগে ২০১৯ সালে ১০ হাজার ৬০০ মানুষ মারা গেলেও ২০২০ সালে মারা গেছে ২৮ হাজার মানুষ। লিভার ক্যান্সারে মৃত্যু ২১ হাজার ৩০০ থেকে বেড়ে ২৯ হাজার ৮৫০ হয়েছে।
চলতি বছর ১১ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক এন্ড হেলথ সার্ভের (বিডিএইচএস) তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রতি ৪ জনে ১ জন উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন। দেশে উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ৩ কোটি। আর প্রতি ১০ জনে ১ জন ডায়াবেটিসে ভুগছেন। দেশে ডায়াবেটিসে আক্রান্তের সংখ্যা ১ কোটি ১০ লাখ।
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব প্রিভেন্টিভ এন্ড সোশ্যাল মেডিসিন (নিপসম) পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের ৯৭ ভাগ মানুষ কোনো না কোনোভাবে হৃদরোগের ঝুঁকিতে রয়েছে। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিশু কিডনি বিভাগের অধ্যাপক ডা. আফরোজা বেগম জানান, দেশে কমপক্ষে ২ কোটি মানুষ বিভিন্ন ধরনের কিডনি রোগে ভুগছে।
গবেষণায় দেখা গেছে, সম্প্রতি বহু দেশে করোনার সংক্রমণ থেকে সেরে ওঠার পর ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছেন অনেকে। কম বয়সিরাও ডায়াবেটিসের শিকার হচ্ছেন। তবে আগে থেকে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ছিলেন না এমন মানুষের মধ্যে ডায়াবেটিস ছড়ানোর জন্য করোনা দায়ী কিনা, তা নিয়ে চিকিৎসকদের মধ্যে বিতর্ক চলছে।
বাংলাদেশ ডায়াবেটিস সমিতির তথ্য বলছে, দেশে প্রাপ্ত বয়স্কদের ১০ জনের মধ্যে ১ জন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। তবে ৫৭ শতাংশ মানুষই জানে না, তার ডায়াবেটিস আছে। আর বাংলাদেশের জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ ২০১৭-১৮ তথ্য বলছে, মাত্র ১৩ শতাংশ ডায়াবেটিসে আক্রান্তরা নিয়মিত চিকিৎসা নিয়ে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রেখেছেন। ২২ শতাংশের বেশি মানুষের তা নিয়ন্ত্রণে নেই।
অসংক্রামক রোগ বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমাদের লাইফস্টাইল এবং খাদ্যাভাস এই অসংক্রামক রোগ বেড়ে যাওয়ার জন্য প্রধান দায়ী।খাদ্যাভাস আগে বাংলাদেশে যে রকম ছিল তার থেকে অনেক বদলে গিয়েছে এখন।বর্তমান সময়ে ফাস্টফুড, রিচফুডসহ রাস্তার ধারের পোড়া তেলের খাবার আমাদের শরীরের যে ক্ষতি করে সেটাই এই রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাবার প্রমাণ।
তারা বলেন, একই সঙ্গে আমাদের কায়িক পরিশ্রম কম। জীবন যাপনে নানামুখি চাপ বেড়ে গেছে এখন। আমরা পরিশ্রম করি কম। কিন্তু খুব সহজেই দিনের তিন বেলাতেই রিচ ফুড খেয়ে যাচ্ছি, কায়িক পরিশ্রম হয় না। কিন্তু শরীর তো মেশিন না, তার জন্য সঠিক খাদ্য দরকার। সেটা আমরা নিচ্ছি না। অপরদিকে শাকসবজি যতোটা খাচ্ছি সেখানেও কেমিক্যাল খাচ্ছি। এসব কারণেই মূলত অসংক্রামক রোগ বেড়ে যাচ্ছে। আর এ থেকে মুক্তি পেতে খাদ্যাভ্যাস এবং লাইফস্টাইল অবশ্যই বদলাতে হবে।নয়তো দিন দিন অসংক্রামক রোগীর সংখ্যা বেড়েই যাবে। একই সঙ্গে কায়িক পরিশ্রম করতে হবে। তা হলেই আমরা কিছুটা সুস্থ জীবন কাটাতে পারবো।
তারা বলেন, আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বয়স্কদের মধ্যে এখন অসংক্রামক রোগটাই মূল ইস্যু। তবে শিশুদেরও কম নয়। শিশুদের অসংক্রামক রোগের মধ্যে ওবেসিটি (স্থূলতা) অন্যতম।ওবেসিটির বাইরে শিশুদের এবং বয়ঃসন্ধিকালে কিছু মানসিক সমস্যাও এখন অসংক্রামক রোগের মধ্যে পড়ে।খাদ্য অভ্যাসের কারণে অনেক সমস্যা হচ্ছে শিশুদের। যেমন-ঘনঘন পেট ব্যথা।। পরিবার বিশেষ করে বাবা মায়ের মধ্যে যদি সমস্যা থাকে সেগুলোও শিশুদের অসংক্রামক রোগ হিসেবে দেখা দেয়।
আরও বলেন, বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর যত ভাগ অসংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্ত, তার চেয়েও বেশি অংশ অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন। ঝুঁকির মধ্যে থাকা এই জনগোষ্ঠীর ঝুঁকি নির্ণয় এবং ঝুঁকি কমানোর জন্য কম খরচে বাস্তবসম্মত পদ্ধতি প্রয়োগ করাই হচ্ছে অসংক্রামক রোগের ব্যাপকতা মোকাবিলার সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি। তাই গ্রাম ও শহরের শিশু, কিশোর, তরুণ, যুবকসহ সব বয়সের নারী ও পুরুষের মধ্যে স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, ওজন নিয়ন্ত্রণ, কায়িক পরিশ্রমের অভ্যাস তৈরিসহ স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপনে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। সেই সঙ্গে বায়ুদূষণ, পরিবেশদূষণ, পানিতে আর্সেনিক, খাদ্যে ভেজাল, খাদ্য সংরক্ষণের জন্য বেশি মাত্রায় কেমিক্যালের প্রয়োগসহ আরও যে বিষয়গুলো অসংক্রামক রোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়, তা নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনীয় নীতিমালার প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে হবে।
তারা বলেন, অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম এখন শুধু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সীমিত। কিন্তু শহরগুলোর প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থাপনা মূলত সিটি করপোরেশনের স্বাস্থ্য শাখার মাধ্যমে পরিচালিত হয়। শহরের সরকারি প্রাথমিক চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণের কার্যক্রম এখনো যুক্ত করা হয়নি। এ জন্য শহরাঞ্চলের মানুষকে বেসরকারি চিকিৎসাসেবার ওপর নির্ভর করতে হয়, যা অনেক ব্যয়বহুল। বাংলাদেশের জনগণ একই সঙ্গে সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগের দ্বৈত হুমকির মধ্যে রয়েছে। ফলে এর মোকাবিলার উদ্যোগটি হতে হবে সম্মিলিত।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭০৪
আপনার মতামত জানানঃ