উত্তর-পূর্ব সিরিয়ার একটি অবরুদ্ধ কারাগারে সশস্ত্র গোষ্ঠী আইএসের হাতে বন্দি রয়েছে শত শত শিশু। তাদের ভাগ্য নিয়ে আশঙ্কা বাড়ছে। হাসাকার ঘারোয়ান নামে ওই কারাগারে প্রায় ৮৫০ শিশু রয়েছে। কারাগারে সশস্ত্র জঙ্গীগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট’র (আইএস) হাতে বন্দি শত শত শিশুর ভাগ্য নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে ইউনিসেফ। বন্দি শিশুদের ভবিষ্যত নিয়েও শঙ্কা প্রকাশ করেছে সংস্থাটি। খবর রয়টার্স।
খবরে বলা হয়, আইএস যোদ্ধাদের সঙ্গে কুর্দি নেতৃত্বাধীন যোদ্ধাদের সংঘর্ষের ছয়দিন পর বন্দীদের নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করে শিশুদের জন্য জাতিসংঘের বিশেষায়িত সংস্থা ইউনিসেফ।
সংস্থাটির মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার আঞ্চলিক অ্যাডভোকেসি এবং যোগাযোগ বিভাগের প্রধান জুলিয়েট টৌমা বলেন, প্রতিটি দিনই গুরুত্বপূর্ণ। ভাবতেও কষ্ট লাগে, কী নিদারুণ নৃশংসতা দেখতে হচ্ছে শিশুগুলোকে! তাদের জীবন মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।
বেশ কয়েক বছর আগে সিরিয়ার একটা বড় অংশ দখল করে মার্কিন জোট বাহিনী সমর্থিত কুর্দি নেতৃত্বাধীন সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্সেস বা এসডিএফ জোট। তখন থেকেই আইএস গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে তীব্র লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন তারা। ইতিমধ্যে হাজার হাজার আইএস সন্দেহভাজনকে কারাগারে বন্দি করেছে কুর্দি কর্তৃপক্ষ।
এর মধ্যেই গত বৃহস্পতিবার জেলে বন্দি থাকা যোদ্ধাদের মুক্ত করতে এবং সিরিয়ার নিয়ন্ত্রণ পুনরায় দখল করতে আইএস ঘারোয়ান কারাগারে আক্রমণ শুরু করে। এ সময় আইএস’র বেশ কয়েকজন যোদ্ধা পার্শ্ববর্তী এলাকায় পালিযে যেতে সক্ষম হয়। পালিয়ে যাওয়ার সময় কারাগারের ফটকের সামনে একটি গাড়ি বোমা বিস্ফোরণ করে। অন্যদিকে, কারাগারে থেকে যাওয়া বন্দিরা সেটির দখল নিয়ে নেয়। এর মধ্যে ৮৫০ শিশু জঙ্গিদের হাতে আটকা পড়ে। তাদের নিরাপদে সরিয়ে আনতে অবিলম্বে এ সংঘর্ষের ইতি টানতে হবে বলে উল্লেখ করেছে ইউনিসেফ।
এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত প্রায় ২০০ বন্দি এবং ২৭ এসডিএফ যোদ্ধা প্রাণ হারিয়েছেন। হতাহতের মধ্যে আটক শিশুদের কেউ আছে কিনা তা নিশ্চিত করতে পারেনি জাতিসংঘের শিশুদের জন্য বিশেষায়িত সংস্থাটি।
এসডিএফ আরো জানায়, ওই ঘটনার পর ৫৫০ আইএস সদস্য আত্মসমর্পণ করেছে। ৪৫ হাজারের মতো বেসামরিক জনগণ বাড়িঘর ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছে, যার মধ্যে অধিকাংশ নারী ও শিশু রয়েছে।
জুলিয়েট টৌমা বলেন, এ পরিবারগুলো এত তাড়াহুড়োর মধ্যে ঘর ছেড়েছে যে এমন প্রচণ্ড শীতের মধ্যেও তারা প্রায় কিছুই নিয়ে বের হয়নি। অনেকে ইতিমধ্যে সিরিয়ার অন্যান্য অঞ্চলের সহিংসতা থেকে পালিয়ে ঘরছাড়া হয়ে এসেছিল।
জেলে বন্দি থাকা যোদ্ধাদের মুক্ত করতে আইএস আক্রমণ শুরু করার পর থেকে কারাগারটিতে কমপক্ষে ১৩৬ জন নিহত হওয়ার খবর দিয়েছে আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমগুলো। কুর্দি কর্তৃপক্ষ পরিচালিত কারাগারে হাজার হাজার আইএস সন্দেহভাজন বন্দি রয়েছে।
প্রতিটি দিনই গুরুত্বপূর্ণ। ভাবতেও কষ্ট লাগে, কী নিদারুণ নৃশংসতা দেখতে হচ্ছে শিশুগুলোকে! তাদের জীবন মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।
মার্কিন জোট বাহিনী সমর্থিত কুর্দি নেতৃত্বাধীন সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্সেস বা এসডিএফ জোট বেশ কয়েক বছর আগে সিরিয়ার বড় অংশ দখল করে। এর পরে আইএস গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে তারা তীব্র লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। ২০১৯ সালের মার্চ মাসে আইএস-কে আঞ্চলিকভাবে পরাস্ত করার ঘোষণা দেওয়া হয়।
তবে আইএস সেলগুলো এখনও সক্রিয় এবং নিরাপত্তা বাহিনী ও বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে মারাত্মক হামলা চালিয়ে আসছে সশস্ত্র সংগঠনটি। ১০০ জনেরও বেশি আইএস যোদ্ধা কারাগারটিতে হামলা চালায়। পাশাপাশি মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোটের বিমান হামলায় ভয়ানক লড়াই শুরু হয়।
যুক্তরাজ্য-ভিত্তিক পর্যবেক্ষণ গোষ্ঠী সিরিয়ান অবজারভেটরি ফর হিউম্যান রাইটস, এসওএইচআর জানিয়েছে, গত বৃহস্পতিবার থেকে কারাগারে সংঘর্ষে ৮৪ আইএস যোদ্ধা, সাত বেসামরিক এবং নিরাপত্তা বাহিনীর ৪৫ জন কুর্দি সদস্য এবং কারারক্ষী নিহত হয়েছে।
জাতিসংঘের শিশু দাতব্য সংস্থা ইউনিসেফ জানিয়েছে, যুদ্ধের মধ্যে কারাগারে আটক প্রায় ৮৫০ শিশুর জন্য তারা উদ্বিগ্ন। শিশুদের নিরাপত্তা চরম বিঘ্নিত হচ্ছে। শিশুদের মধ্যে রয়েছে ১২ বছরের কম বয়সী অনেক শিশু। যুদ্ধে জোরপূর্বক শিশুদের ব্যবহার করারও অভিযোগ করেছে ইউনিসেফ।
এসডিএফ বলছে, আইএস যোদ্ধারা একটি ছাত্রাবাসে লুকিয়ে ছিল। শতাধিক শিশু যাদের আইএসের সাথে জড়িত থাকার সন্দেহে আটক করা হয়েছিল। তাদের ‘মানব ঢাল’ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। সন্ত্রাসীরা যদি বাচ্চাদের আঘাত করে তবে পাল্টা হামলার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে এসডিএফ।
মার্কিন সরকার সমর্থিত সংগঠনটি জানাচ্ছে, তাদের বাহিনী কারাগারের আশপাশের এলাকা বন্ধ করে দিয়েছে এবং কারাগারের গেটের মধ্যে অবস্থিত আইএস যোদ্ধারা আর পালাতে পারবে না। আইএসের শিশুরা একটি বিপর্যয়কর অবস্থার মধ্যে পড়েছে।
বার্তা সংস্থা এএফপি জানিয়েছে, কারাগারে আটক শিশুদের আত্মীয়রা বলছেন, যথাযথ প্রমাণ ছাড়াই এবং এসডিএফে জোরপূর্বক যোগদান প্রতিরোধ করার জন্য তাদের আটক করা হয়েছে। আইএসের একটি কৌশল জোরপূর্বক শিশুদের নিয়োগ করা।
শিশুদের অপহরণ করে তারা আত্মঘাতী বোমা হামলা চালানোর জন্য বা বন্দিদের হত্যা করার প্রশিক্ষণ দিয়েছে। আইএস শিশুদের খিলাফতের শাবক নামে অভিহিত করে। ওইসব শিশুদের উত্তর-পূর্ব সিরিয়ার কুর্দি-চালিত কারাগারে ৫০টিরও বেশি দেশের হাজার হাজার আইএস যোদ্ধার সাথে রাখা হয়েছে।
২০১১ সালের মার্চে আরব বসন্তের পরিপ্রেক্ষিতে সিরিয়ার একনায়ক বাশার আল আসাদের পদত্যাগের দাবিতে দেশটির বিভিন্ন শহরে রাস্তায় বিক্ষোভে নামে সাধারণ জনতা। বাশার আল-আসাদ সামরিক উপায়ে এই বিক্ষোভ দমন করতে চাইলে দীর্ঘস্থায়ী গৃহযুদ্ধের মুখে পড়ে দেশটি।
জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের এক তথ্য অনুসারে, যুদ্ধের ফলে ১০ বছরে তিন লাখ ৫০ হাজার দুই শ’ নয়জন নিহত হয়েছে। এর মধ্যে ২৬ হাজার সাত শ’ ২৭ জন নারী ও ২৭ হাজার এক শ’ ২৬ জন শিশু।
দশ বছর চলমান এই গৃহযুদ্ধে দেশটির জনসংখ্যার অর্ধেকই বাস্তুচ্যুত হয়। জাতিসঙ্ঘের তথ্যানুসারে এক কোটির বেশি লোক যুদ্ধের কারণে বাস্তুচ্যুত হয়।
এছাড়া যুদ্ধের কারণে অন্তত ৬৬ লাখ সিরিয়ান গত ১০ বছরে দেশ ছেড়েছেন। দেশ ত্যাগ করা এই সকল সিরিয়ান নাগরিক প্রতিবেশী তুরস্ক, জর্দান, লেবানন, ইরাকসহ বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিয়েছেন। এর মধ্যে শুধু তুরস্কতেই ৩৭ লাখ শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছেন।
এদিকে সিরিয়ার বড় দুই শরণার্থী শিবিরে বিপজ্জনক পরিস্থিতির মধ্যে বড় হচ্ছে শিশুরা। এতে নষ্ট হচ্ছে তাদের জীবন। সুন্দর ভবিষ্যতের বদলে অন্ধকারে ধাবিত হচ্ছে তারা। এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক মহলকে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে আন্তর্জাতিক এনজিও সেভ দ্য চিলড্রেন।
সেভ দ্য চিলড্রেনের নতুন এক প্রতিবেদনে সিরিয়ার শরণার্থী শিবিরগুলোতে বসবাসরত শিশুদের বিপজ্জনকভাবে বেড়ে ওঠার বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। দেশটির দুটি বড় শরণার্থী শিবির আল-হোল ও রোজ ক্যাম্পে শিশুদের কোনো শিক্ষার ব্যবস্থা নেই। শিশুশ্রমিকের সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে আশংকাজনকহারে। সেইসঙ্গে সহিংসতা ও খুনের ঘটনা যেন নিত্যদিনের বিষয়।
সহিংসতার কারণে গত বছর এখন পর্যন্ত ৬২ শিশুর মৃত্যু হয়েছে আল-হোলে। শিবিরিগুলোতে শিশু-কিশোরদের বিভিন্ন দল একে ওপরের সঙ্গে সহিংসতায় লিপ্ত হয়েই থাকে। এসব ঘটনায় অনেকে গুরুতর জখম হয়ে মৃত্যুকোলে ঢোলে পড়ে। সেইসঙ্গে মাদকের ছড়াছড়ি তো আছেই।
এছাড়া আগুনের কারণেও ঘটছে অকাল মৃত্যুর ঘটনা। বিশেষ করে রান্নার চুলা থেকে সবচেয়ে বেশি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে।
বর্তমান বিশ্বে শরণার্থী সমস্যার সবচেয়ে দুঃখজনক চিত্র এটি। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের ফলে এই শরণার্থীদের মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে। উন্নত দেশগুলো যে অর্থ ও ত্রাণ সহায়তা করছে তা খুব সামান্য। যে কারণে সিরিয়ান শরণার্থীদের দুর্দশা চরমে পৌঁছেছে। আন্তর্জাতিকভাবেও রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট তৈরি করেছে সিরিয়ান শরণার্থীরা।
সিরিয়ার শরণার্থীদের শিশু ও নারীরা পড়েছে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে। ইউরোপের কয়েকটি দেশ সিরিয়া শরণার্থীদের জন্য মানবতার হাত বাড়িয়ে দিলেও আর্থিকভাবে সচ্ছল, উন্নত ও সামরিক শক্তিধর দেশগুলো সিরিয়া শরণার্থীদের ব্যাপারে নিয়েছে কৌশলী ভূমিকা। তাদের আশ্রয় দিতে চাচ্ছে না সব সময় মানবতার বুলি আওড়ানো বেশির ভাগ দেশের রাষ্ট্রনেতারা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২৩০৩
আপনার মতামত জানানঃ