রাশিয়ার সাথে যুক্তরাষ্ট্র এবং তার পশ্চিমা সামরিক মিত্রদের দ্বন্দ্ব নতুন মোড় নিয়েছে ইউক্রেন সীমান্তে সৈন্য সমাবেশকে কেন্দ্র করে। স্টকহোমের বৈঠকে রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাবরভ যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের পাশে দাঁড়িয়ে স্পষ্ট করে বলেছেন রাশিয়া তার ঘরের পাশে ন্যাটো সামরিক জোটের নতুন কোনো তৎপরতা কোনোভাবেই সহ্য করবে না।
লাবরভ সতর্ক করে বলেছেন, আমেরিকা এবং ন্যাটো জোট রুশ এই বার্তা অগ্রাহ্য করলে ইউরোপে আবারো যুদ্ধ শুরু হতে পারে। ইউরোপকে আবারো “যুদ্ধের দুঃস্বপ্ন” দেখতে হতে পারে। যদিও এই সতর্ক বার্তা আদতে কোন কাজে আসেনি। নিজেদের অবস্থান থেকে সরতে না রাজি যুক্তরাষ্ট্র। বিশেষজ্ঞদের মতে, রাশিয়া-যুক্তরাষ্ট্রের এই নয়া আধিপত্যবাদের বলি হতে চলেছে ইউক্রেন।
হামলার আশঙ্কায় মার্কিন নাগরিকদের সরিয়ে নেয়া হচ্ছে
এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়া বড় ধরনের সামরিক পদক্ষেপ গ্রহণের পরিকল্পনা করছে বলে খবর পাওয়া গেছে। তবে, যুক্তরাষ্ট্রের এমন দাবি অস্বীকার করেছে রাশিয়া।
চলমান উত্তেজনা ও ‘মার্কিন নাগরিকদের বিরুদ্ধে সম্ভাব্য হয়রানির’ আশঙ্কায় ইউক্রেন এবং রাশিয়া ভ্রমণ না করার জন্যও জনগণকে সতর্ক করেছে মার্কিন পররাষ্ট্র বিভাগ।
বিভাগের এক উপদেষ্টা বলেছেন, “রাশিয়া ইউক্রেনের বিরুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ সামরিক পদক্ষেপের পরিকল্পনা করছে বলে খবর রয়েছে।”
পররাষ্ট্র বিভাগের আরও একজন কর্মকর্তা বার্তা সংস্থা এএফপিকে জানিয়েছেন, ইউক্রেনে এখনও মার্কিন দূতাবাস খোলা রয়েছে; তবে হোয়াইট হাউস থেকে বারবার সতর্কবার্তা দেওয়া হচ্ছে, ‘যেকোন সময়’ হামলা হতে পারে।
ইউক্রেনে এখনও পর্যন্ত মার্কিন দূতাবাস খোলা থাকলেও হোয়াইট হাউস থেকে বারবার সতর্কবার্তা দেওয়া হচ্ছে, ‘যেকোন সময়’ হামলা হতে পারে।
ইউক্রেনে নিযুক্ত মার্কিন দূতাবাস কর্মীদের পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়-স্বজনদের সেদেশ ছাড়ার নির্দেশ দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ওই অঞ্চলে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা ও সম্ভাব্য আগ্রাসনের আশঙ্কায় এমন নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
ইউক্রেনের দূতাবাসের অপরিহার্য নয়, এমন কর্মীদেরও দেশত্যাগের অনুমতি দিয়েছে মার্কিন পররাষ্ট্র বিভাগ। পাশাপাশি ইউক্রেনে অবস্থানরত মার্কিন নাগরিকদেরও নিজেদের প্রস্থান বিবেচনার অনুরোধ জানানো হয়েছে।
কর্মকর্তাদের মতে, “এমন পরিস্থিতি তৈরি হলে, সরকার মার্কিন নাগরিকদের সরিয়ে নেওয়ার মত অবস্থায় থাকবে না।”
সম্ভাব্য সংঘাতের হাত থেকে মার্কিন কূটনৈতিকদের রক্ষা করতেই দেশটির পররাষ্ট্র বিভাগ এমন সতর্কবার্তা দিয়ে যাচ্ছে বলে জানিয়েছে সংবাদমাধ্যম বিবিসি।
কী চাইছে রাশিয়া?
রুশ প্রেসিডেন্ট বহু দিন ধরেই দাবি করে আসছেন যে ১৯৯০ সালে যুক্তরাষ্ট্র তৎকালীন সোভিয়েত নেতা মিখাইল গরবাচেভের কাছে একটা নিশ্চয়তা দিয়েছিল যে ন্যাটো জোটকে পূর্ব দিকে আর সম্প্রসারণ করা হবে না, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র সেই অঙ্গীকার রক্ষা করেনি।
সে সময় থেকে এ পর্যন্ত সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন বা তার প্রভাব-বলয়ের অংশ ছিল; এমন অনেক পূর্ব ইউরোপিয়ান দেশ ন্যাটো জোটের সদস্য হয়েছে।
এর মধ্যে পোল্যান্ড, লিথুয়ানিয়া, লাৎভিয়া এবং এস্তোনিয়ার সরাসরি সীমান্ত রয়েছে রাশিয়ার সাথে।
রাশিয়া মনে করে, এর ফলে তাদের সীমান্তের কাছে ন্যাটোর সৈন্য ও অস্ত্রশস্ত্রের উপস্থিতি তার নিরাপত্তার প্রতি সরাসরি হুমকি সৃষ্টি করছে।
পুতিন চান, পশ্চিমা দেশগুলোকে এ প্রতিশ্রুতি দিতে হবে যে ইউক্রেনকে কখনো ন্যাটো সদস্য করা হবে না, এবং পূর্ব ইউরোপে ন্যাটোর অস্ত্রশস্ত্র দেয়া ও সামরিক মহড়া চালানো বন্ধ করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র এ ধরনের কোন অঙ্গীকার করতে অস্বীকার করেছে।
এর আগে ২০১৪ সালে ইউক্রেনের রুশপন্থী প্রেসিডেন্ট ক্ষমতাচ্যুত হলে রাশিয়া ইউক্রেনের ক্রাইমিয়া অঞ্চল দখল করে নেয়। এর পর থেকে পূর্ব ইউক্রেনে রুশ-সমর্থিত বিদ্রোহীদের সাথে ইউক্রেনের বাহিনীর যুদ্ধ চলছে।
যুক্তরাজ্য অভিযোগ করেছে, রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেনে একজন মস্কোপন্থী ব্যক্তিকে ইউক্রেনের সরকার প্রধান হিসেবে ক্ষমতায় বসানোর পরিকল্পনা করছে।
ব্রিটেনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ব্যক্তিটির নামও প্রকাশ করেছে; যা বেশ অস্বাভাবিক এক ঘটনা। বলা হচ্ছে সাবেক পার্লামেন্ট সদস্য ইয়েভেন মুরায়েভই হচ্ছেন ক্রেমলিনের পছন্দের সেই ব্যক্তি; যাকে রাশিয়া ইউক্রেনে ক্ষমতায় বসাতে চায়।
রাশিয়া এখন ইউক্রেনের সীমান্তে এক লাখেরও বেশি সেনা মোতায়েন করেছে। তবে রাশিয়া ইউক্রেনের ভেতরে ঢুকে অভিযান চালানোর পরিকল্পনা করছে; এমন কথা মস্কো অস্বীকার করেছে।
পুতিন অভিযানের কথা অস্বীকার করলেও দাবি করছেন যে তাকে পশ্চিমা দেশগুলোর এ গ্যারান্টি দিতে হবে যে ইউক্রেনকে কখনোই ন্যাটোর সদস্য করা হবে না। যুক্তরাষ্ট্র এরকম কোন অঙ্গীকার করতে অস্বীকার করেছে।
ইউক্রেন এবং তার পশ্চিমা মিত্ররা ক্রমাগত বলছে রাশিয়া ইউক্রেনে সামরিক অভিযানের পাঁয়তারা করছে। তবে বিবিসির সংবাদদাতা সারা রেইন্সফোর্ড, যিনি সম্প্রতি মস্কো থেকে বহিষ্কৃত হয়েছেন, বলছেন সিংহভাগ বিশ্লেষক এখনও মনে করছেন না যে, রাশিয়া ইউক্রেনে সামরিক কোনো অভিযান চালাবে।
বরঞ্চ ক্রেমলিন স্পষ্ট একটি বার্তা দিতে চাইছে যে ইউক্রেনকে যেন কখনই ন্যাটো জোটের সদস্য না করা হয় এবং তাদের এই ‘রেড লাইন’ ভাঙলে রাশিয়া তা প্রতিহত করতে প্রস্তুত।
পুতিনের জন্য এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি মনে করছেন ন্যাটোতে ঢোকার ব্যাপারে পশ্চিমারা ইউক্রেনের বর্তমান ক্ষমতাসীনদের আশা যোগাচ্ছে। ন্যাটোর পক্ষ থেকে যেভাবে ইউক্রেনকে অস্ত্র এবং সামরিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে তাতে পুতিন প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত। লাল কাপড় দেখলে ষাঁড় যেমন ক্ষেপে যায় অনেকটা তেমন।
পুতিন ভাবছেন এখনই যদি তিনি কিছু না করেন, আগামিকাল ইউক্রেনে ন্যাটো ঘাঁটি হবে। সুতরাং এখনই তাকে তা আটকাতে হবে।
ন্যাটো কে বা কারা?
ন্যাটো হলো বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী ও বড় সামরিক জোট। ১৯৪৯ সালে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ন্যাটোর পুরো নাম নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজেশন। এই জোটের সদস্য হলো ৩০টি দেশ।
জোটটির প্রাথমিক কাজ হলো সকল সদস্যকে রাজনৈতিক ও সামরিক দিক দিয়ে সহায়তা করা। নিরাপত্তার বিষয়টি দেখা।
১৯৪৯ সালে মাত্র ১২টি দেশ নিয়ে ন্যাটো প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিল যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, বেলজিয়াম, কানাডা, ডেনমার্ক, ফ্রান্স, আইসল্যান্ড, ইতালি, লুক্সেমবার্গ, নেদারল্যান্ডস, নরওয়ে ও পর্তুগাল।
প্রসঙ্গত, ন্যাটো প্রতিষ্ঠিত হয় বর্তমান রাশিয়া ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নকে প্রতিহত করতে।
ন্যাটো ও রাশিয়ার দ্বন্দ্ব
বর্তমানে রাশিয়ার সঙ্গে ন্যাটোর দ্বন্দ্বের কারণ হলো রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বলেছেন, ন্যাটো আর কোন দেশকে তাদের সদস্য করতে পারবে না। ৩০টি দেশেই থামতে হবে। পুতিন এ বিষয়ে নিশ্চয়তা চান।
মূলত ইউক্রেন ন্যাটোর সদস্য হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এটিই চিন্তায় ফেলে দিয়েছে প্রতিবেশী রাশিয়াকে। ইউক্রেন ন্যাটোর সদস্য হলে এই জোটের সেনারা ইউক্রেনে অবস্থান নিতে পারবে। যা রাশিয়ার জন্য বড় ধরনের হুমকি।
ন্যাটোর সংবিধানে আছে তাদের কোনো সদস্যের ওপর হামলা মানে সবার ওপর হামলা। আর এই হামলা প্রতিরোধে জোটের সব সেনারা ঝাঁপিয়ে পড়বে।
ন্যাটো প্রথম কোনো সামরিক অভিযানে অংশ নেয় ১৯৯২ সালের বসনিয়া যুদ্ধের মাধ্যমে। এরপর ১৯৯৯ সালে কসোভো যুদ্ধে বিমান বাহিনীর মাধ্যমে দ্বিতীয় অভিযানে নামে তারা। আর তৃতীয় অভিযান শুরু করে ২০০১ সালে আফগানিস্তানে।
২০২০ সালে নর্থ ম্যাসোডোনিয়া সর্বশেষ দেশ হিসেবে ন্যাটোতে যোগ দেয়। আর সম্প্রতি ন্যাটোতে যোগ দেয়ার আগ্রহ দেখিয়েছে জর্জিয়া, ইউক্রেন ও হার্জেগোভিনা।
যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে ইউক্রেন
সীমান্তে আবারও সৈন্য সংখ্যা বাড়িয়েছে রাশিয়া। এ পরিস্থিতিতে তারা যে কোনো সময় ইউক্রেন আক্রমণ করতে পারে বলে আশঙ্কা দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের।
বুধবার (১৯ জানুয়ারি) ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি গোপন সূত্র সিএনএনকে জানিয়েছে,রাশিয়া-ইউক্রেনের সীমান্তে এক লাখ ২৭ হাজার সৈন্য মোতায়েন করেছে। কয়েকদিন আগে সংখ্যাটি আরও কম ছিল।
রাশিয়া সীমান্ত ঘেঁষে ফিল্ড হাসপাতাল, নিরাপত্তা চৌকি প্রভৃতি অবকাঠামো বানাচ্ছে। এছাড়াও, মজুদ করা হয়েছে বিপুল পরিমাণ গোলা বারুদ। যা সবই যুদ্ধের প্রস্তুতির অংশ।
উল্লেখ্য, রাশিয়া-ইউক্রেন ইস্যুতে চলমান উত্তেজনা নিরসনে ইতোমধ্যে তিন দফায় দ্বিপাক্ষিক আলোচনা হয়েছে। কিন্তু গত সপ্তাহে রাশিয়া জানায়, আলোচনা ফলপ্রসূ হয়নি। এরপর থেকেই যুদ্ধের সম্ভাবনায় শঙ্কা প্রকাশ করেছে ইউক্রেন।
এদিকে, রাশিয়া নিজেরাই নিজেদের বিরুদ্ধে উস্কানিমূলক হামলার নাটক সাজিয়ে ইউক্রেনে অভিযান চালানোর ষড়যন্ত্র করছে বলে অভিযোগ করেছে যুক্তরাষ্ট্র।
পেন্টাগনের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, রুশ এজেন্টরা এরকম ‘সাজানো নাটকের’ ষড়যন্ত্র করছে, যাতে এই অজুহাতে মস্কো ইউক্রেনে একটা হামলা চালানোর প্রস্তুতি নিতে পারে। তবে রাশিয়া এই অভিযোগ নাকচ করে দিয়েছে।
ইউক্রেনকে ঘিরে উত্তেজনা প্রশমনের জন্য মার্কিন-রুশ আলোচনার এক সপ্তাহ পর যুক্তরাষ্ট্র এই অভিযোগ তুললো। চলতি মাসের ১৪ তারিখ ইউক্রেনের বিভিন্ন সরকারি ওয়েবসাইটে যে সাইবার হামলা হয়েছে, তার জন্য ইউক্রেন রাশিয়াকে দোষারোপ করছে।
পেন্টাগনের মুখপাত্র জন কার্বি সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় তার ভাষায় ‘রুশ ষড়যন্ত্রের’ কথা তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, রাশিয়া একদল লোককে নিয়োজিত করেছে এমন এক হামলা চালানোর জন্য, যেটিকে তাদের বিপক্ষের কাজ বলে মনে হবে। এই হামলা দেখে মনে হবে এটি বুঝি রাশিয়ার ওপর কিংবা ইউক্রেনের রুশভাষী মানুষের ওপর হামলা, যাতে করে রাশিয়া ইউক্রেনে হামলার একটা অজুহাত পায়।
মার্কিন কর্মকর্তারা দাবি করছেন এসব রুশ এজেন্টদের শহর এলাকায় যুদ্ধের কলাকৌশল এবং বিস্ফোরক ব্যবহারের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে, যাতে তারা রুশপন্থী বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে নাশকতা চালাতে পারে।
ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বলছে, মলডোভার বিচ্ছিন্ন একটি অঞ্চল ট্রান্সডনস্ট্রিয়ায় অবস্থান নেয়া রুশ সৈন্যদের বিরুদ্ধেও একই রকম সাজানো হামলার ষড়যন্ত্র চলছে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৩৫০
আপনার মতামত জানানঃ